সেই অধ্যাপকের কথা ভেবে আমার এখন আর শুধু দুঃখ হয় না । মাঝে মাঝে মায়াও হয় ! যিনি একটা বিলেতি কুত্তা কিম্বা বিলাই পোষেন । তার সঙ্গে গুনগুন করেন দিনরাত । হাঁটতে চলতে ফিরতে তাকে সঙ্গে রাখেন । তাকে কোলে নিয়ে কিংবা পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অ্যান্টন চেকভের গল্পের বই পড়েন । তার সঙ্গে একই টেবিলে খান, একই বেডে ঘুমান ।
অধ্যাপক, আপনি সত্যিই খুব দুর্ভাগা ! পৃথিবীতে সাতশ’ কোটি মানুষের বসবাস । অথচ আপনার দৈনন্দিন জীবনের এই জৈবিক কর্মগুলো সম্পাদন করার জন্য একজন মানব-সঙ্গীও আপনার ভাগ্যে জুটল না ।
অধ্যাপকের হয়ত ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় প্রচুর উচ্চাশা ছিল । প্লেনে করে বিলেত যাবেন । কোনো শেতাঙ্গিনীর সঙ্গে তার পরিচয় হবে । প্রেম হবে । একে অপরের হাতে হাত রেখে বাকীটা জীবনে পার করে দিবেন অনাবিল প্রশান্তিতে । কিন্তু সময়ের ব্যবধানে যখন ব্যর্থ হল সবকিছু তখন...
হয়ত এই ব্যর্থতার কালি কিছুটা মুছে দিতেই সব মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, বিলেতি কুত্তা-বিলাইকে আঁকড়ে ধরে মানুষের পৃথিবীতে বেঁচে আছেন অধ্যাপক মশাই ।
অধ্যাপকের কথা বাদ দিন । সাত বছরের শিশু নীলুর ব্যাপারে কী কইবেন আপনারা ?
কিশোর কবি সুকান্ত যাকে স্থান ছেড়ে দিয়ে মাত্র একুশ বছরেই চলে গিয়েছিলেন ।
যে বয়সে শিশুরা দলে দলে ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে মাঠের পর মাঠ চষে বেড়ায় । সমস্ত শরীরে কাঁদা মেখে ঝাপিয়ে পড়ে তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ জলে । সাঁতরে সাঁতরে পার করে দেয় কত শত শৈশবের নদী । নীলুর এখন সেই বয়স । অথচ নীলু নগরের দমবন্ধ ফ্ল্যাটের এক কোণে পড়ে আছে তার পুতুল টমিকে নিয়ে । পুতুল টমির মত নীলুও যেন নীরব নিশ্চল নিষ্প্রাণ ।
অধ্যাপক তো তাও বাঁচার জন্য জন্য একটা রক্তমাংসের প্রাণি জুটিয়ে নিলেন । নীলুর ভাগ্যে তাও জুটল না । জড়পদার্থের সঙ্গে বসবাসরত নীলু কতটুকু মানুষ হয়ে উঠবে, নাকি জড়পদার্থই রয়ে যাবে । সেই জবাব নিশ্চয়ই অনাগত সময় দিবে ।
সভ্যতা যতই এগুচ্ছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই উন্নত হচ্ছে, দালানগুলো যতই উঁচুতে উঠছে— মানুষগুলো ততই ভয়াবহ নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে !
প্রয়োজনে সভ্যতাকে অন্ধ করে দাও, আমি অরণ্যে গিয়ে জংলি বর্বর মানুষের সঙ্গে বাঁচব । লাইব্রেরি আর ল্যাবরিটরিগুলো গুঁড়িয়ে দাও, আমি প্রকৃতির কাছ থেকে শিখব । দালানগুলো সব উপড়ে ফেলো, আমি সমস্ত আকাশটাকে প্রাণভরে দেখতে চাই ।
আসলে আমি বাঁচতে চাই । মানুষের পৃথিবীতে, মানুষের সঙ্গে ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৪:১৭