somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : রুম্পা

১৯ শে মে, ২০১৭ রাত ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত মাসের ২৯ তারিখেই খবর এলো । বাবা আর পারছেন না । নিরুপায় মা ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন ! মামার কাছে আটবার হাত পেতেও হাজার খানেকের বেশি পাওয়া যায় নি । আমি বুঝে গেলাম । নিজের বোঝাটা এবার নিজের কাঁধেই তুলে নিতে হবে ।
চাকরি ? এই মুহূর্তে কোথায় পাব ? কার কাছে চাইব ? কে দিবে ? আমি বহুবার বহুজনের মুখ থেকে শুনেছি , ওসব ইদানিং লাইন লবিং ছাড়া হয়ই না । তার মানে আমার মত ভার্সিটিপড়ুয়া নিম্নমধ্যবিত্ত লাইন লবিংহীন ছাত্রের পক্ষে চাকরিটা এখন অনেকটা দুঃসাধ্যই ! তার চেয়ে সহজ, যে দু'কলম বিদ্যা শিখেছি তার জোরে একটা টিউশনি খুঁজে নেয়া । বেশি কাঠখড় পোড়াতে হল না । পেয়ে গেলাম টিউশনিটা । যা দিবে বলেছে , চলে যাবে কোনোমতে ।
প্রতিদিন সন্ধে ৭টায় বেরিয়ে পড়ি । রিক্সায় ২০ টাকা ভাড়া । সুতরাং হাঁটতেই হবে । হেঁটে হেঁটে আধঘণ্টা লাগে । ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টা । ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের ঘর্মাক্ত ক্লান্ত মুখের প্রতিচ্ছবি দেখে ভালোই লাগে । নিজের ঘামের টাকায় নিজের পেট চলছে ! তৃপ্তিটাই অন্যরকম ।

সেই শুরুর দিন থেকেই টিউশনিতে যেতে একটা মেয়েকে চোখে পড়ে । রাস্তাজুড়ে ভরাট অন্ধকার থাকলেও তাকে চিনতে আমার কষ্ট হয় না । নিতান্তই সাধাসিধে । পরনে ঢিলেঢালা জামা-পাজামা । মাথাটা ওড়নায় ঢাকা । এদিক-ওদিক বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই । পথের দিকে চোখ নিচু করে হাঁটছে তো হাঁটছেই । সেও যে আমার মত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে সংগ্রামরত কেউ একজন, আমার বুঝে নিতে মোটেই কষ্ট হয় না ।
সেই সন্ধ্যায় ভয়ানক বৃষ্টি শুরু হল । আমি তখন মাঝপথে । সঙ্গে ছাতা নেই । দৌঁড়ে কোথাও গিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচব, সেই সম্ভবনাও নেই । সুতরাং ভিজতেই লাগলাম । ক্ষণকাল পর পর মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের তীব্র ঝলকানি ! ঝলকানো বিদ্যুতের আলোয় হঠাৎ মেয়েটির মুখ চোখে পড়ল । এই প্রথম আমি ওর মুখ স্পষ্ট দেখতে পেলাম । ওর মাথায় ছাতা । আমি ওর সমান্তরালে পাশাপাশি হাঁটছি । বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েই চলেছে । মেয়েটি থমকে দাঁড়ায় । আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমি চমকে উঠি ! একটা অচেনা ছেলেকে ডেকে নিশ্চয়ই ছাতার নীচে ঠাঁই দিবে না ! হঠাৎ যাত্রী ছাউনিটা আমার চোখে পড়ে । একদম ফাঁকা । আমি হুটহাট ঢুকে পড়ি । মেয়েটিও ।

'ইশ্‌ কী বিচ্ছিরি বিষ্টি ! হায় , হায় , আপনি তো একদম ভিজে গেলেন !' একটা আফসোসের স্বর ! বৃষ্টির তীব্র শব্দের ভিতরেও আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম । বিদ্যুতের ঝলকানিতে যখন আমার কাকভেজা দশা নজরে এল একটু মুখ চিপে মেয়েটি হাসছিলও বটে ।
আমি চুপ । কী বলা যায়, খুঁজে পাচ্ছিলাম না ।
'আমি রুম্পা ... ' । মেয়েটিই পরিচয়ের হাত আগে বাড়িয়ে দিল ।
আমি আমার পরিচয়টা না দিয়ে বলে উঠি,
' টিউশনিতে যাচ্ছেন নাকি ?'
প্রশ্ন দিয়েই শুরু করলাম । যদিও এর জবাব আমার জানা । তবুও আলপটা শুরু করা চাই ।
'হুম ।'
'আমিও ।'
তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ ।
হঠাৎ তীব্র আলোর বিস্ফোরণে আমাদের মুখ দুটি যেন সূর্যালোকিত দিনের মত জ্বলজ্বল করে উঠে । বজ্রের আলোতে আমি রুম্পাকে আরো স্পষ্ট দেখতে পেলাম ! এ তো প্রস্ফুটিত যুবতী নারীর মুখ । এ মুখে তো বিনামেঘেই বিদ্যুৎ খেলে যায় । কিন্তু তীব্র মেঘের গর্জনে মাটির সাথে সাথে যখন হৃৎপিণ্ডটাও থরথর কেঁপে উঠল তখন মেয়েটির বিদ্যুৎ-চমকানো মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভিতর একটা অসহায়ত্বের সুরই ধ্বনিত হতে থাকল । একেই কী বলে লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই ।
' কী বাবা ! এটা কী শুরু হইল আপনি ! আচ্ছা, আপনি আর কতটুকু যাবেন ?' বজ্রপাতের আকাশ-ফাটানো আওয়াজ শেষে কান থেকে হাত নামায় রুম্পা ।
'এইতো সামনেই । আপনি ?'
'আরো অনেকটা দূর । উফ্ রাত্রিবেলা মেয়েদের জন্য টিউশনি করাটা কী যে...' রুম্পা থেমে যায় ।
'তাতো বটেই । আপনার পরিবারে কে কে আছেন ?'
'বাবা, মা আর একটা ছোট ভাই । বাবা প্যারালাইজ্ড । ৬ বছর যাবৎ । ' কাতর কণ্ঠে বলে রুম্পা । বৃষ্টির জ্বালাতনে বিপন্ন মুখটা যেন আরো বিপন্ন হয়ে উঠল ।

বৃষ্টি থেমে গেছে ।
'এই যে চলুন । বেরিয়ে পড়া যাক ।' রুম্পা আমাকে তাড়া দেয় ।
আমরা দু'জন আবার সমান্তরালে পাশাপাশি হাঁটছি । বহুক্ষণ চুপচাপ ।
'এই তো চলে এলাম । পরে দেখা হবে ।' আমি থমকে দাঁড়াই ।
'ওকে বাই । আপনি ফিরবেন কখন ?'
' ৯ টার দিকে ।' 'অপেক্ষা করবেন একটু আমার জন্য । আধঘণ্টা ।
' 'হুম । ' বলেই আমি আমার গন্তব্যের মেইন গেটে পা বাড়াই ।
'আচ্ছা আপনার নাম-পরিচয়টা জানা হল না যে ।' আমি এক কদম না এগুতেই রুম্পা বলে উঠে ।
ফেরার সময় বলব, কেমন ?'
'ওকে আসি ।'

হ্যাঁ, 'আসি' । 'আসি' বলেই রুম্পা চলে গেল ! সেই যে গেল ! আজ অবধি রুম্পা ফেরত এল না ! আসবেও না কখনো ।

সেইরাতে আমি রুম্পার জন্য অপেক্ষা করব বলে কথা দিলেও, অপেক্ষা করে নি । পুনরায় বৃষ্টিতে ভিজে যাব বলে আশংকা করতে করতে আমি ওর কথা বেমালুম ভুলে গেছি ! পরের দিন সকালে নির্জন সুপারি বাগানে রুম্পার ছিন্নভিন্ন জামা-পাজমার কয়েক টুকরো পাওয়া যায় । রুম্পার আর বাকীসব কারা যেন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিছে !
ওরা কারা ? ওরা কারা ? আমিও কি ওদের একজন ?



বিঃ দ্রঃ লেখাটি বেশ আগে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম । সেখান থেকে সামন্য কিছু ঘষা-মাজা করে নিলাম ।

ফেসবুক লিংক
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৭ দুপুর ১২:২৭
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিসের সনদের মান নির্ধারণ করা শয়তানী কাজ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪০



সূরাঃ ৯ তাওবা, ১০১ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০১। মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক। মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ মোনাফেকী রোগে আক্রান্ত। তুমি তাদের সম্পর্কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×