somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাহিত্যপাঠঃ বুদ্ধদেব বসুর 'রাত ভ'রে বৃষ্টি' (১৮+)

১২ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(১)
১৯৬৭ সালে প্রকাশ । বছর তিনেক না যেতেই ১৯৭০ উপন্যাসটির উপর নেমে এলো চূড়ান্ত দুর্যোগ । বিচারালয়ে অশ্লীল বলে চিহ্নিত হল । পাণ্ডুলিপিসহ সবগুলো কপি ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়া হল । রাষ্ট্রীয় কাঠগড়ায় নতজানু কল্লোল যুগের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসুর কলম । কতিপয় সমাজ-অনুগামী, সমাজবিরোধী — কেউই বাদ রইল না, সবাই থু থু ছিটাতে থাকল । এখন প্রশ্ন-- কী এমন ছিল উপন্যাসটির ভিতর ?

"হয়ে গেছে-- ওটা হ'য়ে গেছে, এখন আর কিছু বলার নেই । আমি, মালতী মুখোপাধ্যায়, একজনের স্ত্রী আর একজনের মা, আমি ওটা করেছি । করেছি জয়ন্তর সঙ্গে, জয়ন্ত আমাকে চেয়েছে, আমিও তাকে । নয়নাংশু হয়ত ভাবছে আগেই করেছিলুম, কিন্তু না-- আজই প্রথম । আজ রাত্রে-- চার ঘণ্টা আগে । এই বিছানায় । যেখানে মালতী এখন শুয়ে আছে ।"

এভাবেই উপন্যাসটির সূচনা । এইটুকু পড়ে যে কোনো পাঠকের পক্ষেই চমকে ওঠা অস্বাভাবিক নয় । সমাজ-নিষিদ্ধ প্রেমের ঝাঁঝালো একটা গন্ধ, শিউরে উঠে সমস্ত শরীর । বিস্ময় বেড়েই চলে ! প্রশ্নও চলে- এভাবেও কি বলা যায় ? এত খোলামেলাভাবে ?
হ্যাঁ, 'রাত ভ'রে বৃষ্টি' উপন্যাসে বুদ্ধদেব কোনো চাতুর্যতার আশ্রয় নেন নি । ইনিয়ে বিনিয়ে কিংবা জটলা পাকিয়ে তিনি জীবনকে বিমূর্ত জটিল শিল্পরূপ দেন নি । জীবন যেমন— ঠিক তেমনিভাবে তাকে আঁকতে চেয়েছেন । জীবনের সঙ্গে যে সত্যগুলো আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে, সেগুলোকে দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করে গেছেন । যে প্রেমকে সমাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে নির্মমতার সাথে, সেই পরকীয়া প্রেমকে আশ্রয় করে গড়ে তুললেন উপন্যাসের আখ্যান ।

অংশুর স্ত্রী মালতী । জয়ন্তের প্রেমিকা মালতী । মালতীকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের যাবতীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সূচনা । তবে মালতী তার অনুভূতির সাথে অকপট । জয়ন্তের সঙ্গে সঙ্গমের পর নির্দ্বিধায় মালতীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়--

"খিদে পেলে খেতে হয়, প্রেম পেলে প্রেম করতে হয়..."

যা কিছু নগ্ন তাকে পোশাক পরাবার চেষ্টা করেন নি এই সাহিত্যস্রষ্টা । বরং নগ্নতার ভিতর দিয়েই তিনি সৌন্দর্যকে মূর্ত করে তুলতে চেয়েছেন । ঘুমন্ত স্ত্রী মালতীর শারীরিক সৌন্দর্য নয়নাংশুর চোখে এভাবেই ধরা পড়ে-

"আলো জ্বেলে দেখলুম সুন্দর একটি ছবি । মালতী ঘুমিয়ে আছে, শাড়িটা উঠে গিয়ে নিটোল একটি পা দেখা যাচ্ছে হাঁটু থেকে পাতা পর্যন্ত, আঁচল সরে গিয়ে একটি স্তন সম্পূর্ণ বেরিয়ে পড়ছে-- সম্পূর্ণ গোল, নধর, উর্ধ্বমুখ । একটি শ্যামবরনী ভেনাস-- বতিচেলির সদ্যতরুণী নয়, বরং টিৎসিয়ানোর কোনো ছাত্রের আঁকা পক্বযুবতী, সারা ঘুমন্ত শরীরের মধ্যে ঐ একটি অনাবৃত স্তন যেন চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, রূপের চেতনা ও স্পর্ধা নিয়ে, লোকদের অভিনন্দন নেবার জন্য । চুপচুপে ভেজা ঠাণ্ডা শিটানো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে আমার বেশ লাগছিলো, যেন চোখ দিয়েই কিছুটা তাপ কুড়িয়ে নিচ্ছিলাম ।"

এখানে যৌনতা আছে । নারীর স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর বর্ণনা আছে । আদিরসত্মক রোমাঞ্চ আছে । তবুও কেন জানি মনে হয় এটা অশ্লীল নয়, এটা শিল্প, এটা কলমের খোচায় বের করে আনা এক অনিন্দ্য সৌন্দর্য । কোনো সুড়সুড়ি দেয় না— একটা নিটোল অখণ্ড সৌন্দর্যকেই আমাদের সামনে দৃশ্যমান করে তোলে ।
এমন বর্ণনার সঙ্গে উপন্যাসের পরতে পরতে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে । খোলামেলা হওয়া সত্ত্বেও উদ্বৃতিকৃত লাইনগুলো অশ্লীলতাকে অতিক্রম করে গেছে । কারণ একটাই । বুদ্ধদেবের অসামান্য শিল্পবোধসম্পন্ন বর্ণনাভঙ্গি ।

(২)
বুদ্ধদেব বসু একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সম্পাদক, সংগঠক, পৃষ্ঠপোষক । অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো অঙ্গই নেই যেখানে তাঁর পদধূলি লাগে নি । এমনকি যে-কজন তাজা প্রাণ রবীন্দ্র-বলয় থেকে বের হয়ে বাংলাভাষায় নতুন সাহিত্যিক আদর্শের সন্ধান করেছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে উচ্চারিত একটা নাম বুদ্ধদেব বসু । আধুনিক বাংলা-সাহিত্যের এমন পুরোধা ব্যক্তিত্বের হাতেই নাকি এই বিতর্কিত আখ্যানের নির্মাণ । ভাবতেই বিস্ময় লাগে । এটাকে আপনি স্রষ্টার ছেলেবয়সের পাগলামি বলেও উড়িয়ে দিতে পারবেন না । কেননা, উপন্যাসটি লেখার সময় বুদ্ধদেব ষাটের ঘরের প্রবীণ । উপন্যাসটির আখ্যান-চরিত্র-বক্তব্য-গঠনকৌশল-সংকট-জীবনজিজ্ঞাসা-- কোথাও লেখকের আবেগের উচ্ছ্বাস নেই । আছে বুদ্ধির ছাপ, উপস্থাপনায় অভিনবত্ব, পরিমিত শিল্পবোধ ।

মালতী আর নয়নাংশুর বয়ানে এগিয়ে চলা ষাট পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি একদমে পড়তে পাঠকের খুব একটা হোঁচট খেতে হবে না, ক্লান্তির উদ্রেক ঘটবে না । তবে তর্ক চলতে পারে, রুচি-অরুচির তর্ক, শ্লীল-অশ্লীলের তর্ক । ভিতরে ভিতরে নানামাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতের উদ্রেক ঘটতে পারে, প্রেমতত্ত্বের নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত হওয়ার সম্ভবনাও থেকে যায় ।

(৩)
নয়নাংশু আর মালতীর বারো বছরের দাম্পত্য-জীবনে যখন ক্লান্তি এসে গেল, পরস্পর পরস্পরের কাছে তিক্ত অসহ্য হয়ে উঠল, দুটো বিছানা আলাদা হয়ে গেল, প্রেম-কাম-ভালোবাসাবাসি সব ধুয়ে মুছে কেবল অভ্যাসের দাস হয়ে নিয়মের অনুগামী হয়ে একে অন্যের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করছিল, তখনো নয়নাংশুর ভিতরে প্রেমতত্ত্বের নানা তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে । পুঁথির মাধ্যমে প্রাপ্ত ইউরোপিয়ান ব্যক্তিবাদী চেতনা আর তত্ত্বনির্ভর জীবনভঙ্গি দিয়েই পৃথিবীর সবকিছুকে বিচার করে অংশু । এমনকি মালতিকেও সে একই দীক্ষায় দীক্ষিত করতে চায় । মালতী কী চায় তার চেয়ে অংশুর কাছে বড় হিসাবে দেখা দেয় সে মালতীকে কীভাবে দেখতে চায়, গড়তে চায় । আবার অংশুর আইডিয়ার মধ্যে প্রথমে মালতি নিজেকে সমার্পিত করলেও একসময়ে তাঁর ভিতরে আমরা স্বাধীন সত্তার আবির্ভাব হতে দেখি । জ্ঞানে শিক্ষায় রুচিতে মালতি সর্বদা অংশুর চেয়ে অনেক অনেক পিছিয়ে, নিজের পশ্চাদপদতা নিয়ে এক ধরণের হীন্যমন্যতায় কাজ করে মালতীর মধ্যে- তবুও আমরা দেখি কেমন করে মালতীর চোখে একে একে ধরা পড়তে থাকে অংশু চরিত্রের স্থুলতা ! জয়ন্তের কাছে মালতীর আত্মসমার্পণ অংশু টের পায় । তবুও সে চুপ । কারণ, অংশু জানে তার শরীরটা এখন আর মালতীকে টানে না । ভিন্ন কোনো স্বাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে মালতী । আর শরীর বাদ দিলে ভালোবাসার থাকেই বা কী...

"ভালোবাসায় শরীরই আসল-- আরম্ভ, শেষ, সব ঐ শরীর । আধা-বয়সী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অত ঝগড়াঝাঁটি খিটিমিটি কেন ? যেহেতু তাদের শরীর পড়ে আসছে ! বুড়ো স্বামী-স্ত্রীরা নানাভাবে উৎপীড়ন করে কেন পরস্পরকে ? যেহেতু তাদের শরীর মরে গেছে । প্রতিহিংসা-- প্রকৃতির উপর প্রতিহিংসা ! ভালোবাসা জৈব, ভালোবাসা যৌন, শরীর না-থাকলে কিছুই থাকে না ভালোবাসার ।"

শুধু অংশু নয় । মালতীর কাছেও শরীরটাই মূখ্য । নিজের দুর্দশাগ্রস্ত দাম্পত্য জীবনের পদাঘাতে পিষ্ট হয়ে মালতীর কণ্ঠেও বাজে আফসোসের সুর--

"যদি ভালোবাসার শরীর না-থাকতো, তাহলে কতই না সুখী হতে পারতাম আমি আর নয়নাংশু ।"

শরীর-প্রেম-যৌনতা-অতৃপ্তি-কলহ-পরকীয়া-প্রতিশোধ সবকিছু নিয়েই দুটো চিন্তার স্রোত প্রবাহমাণ, জিজ্ঞাসারও অন্ত নেই ওদের । যেমন মালতীর , তেমন অংশুরও । তবুও কী অদ্ভুত ! ওরা কেউ বিচ্ছেদের দিকে আগায় না । হয়ত এখানে দেয়াল তুলে রেখেছে তাদের দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা কিংবা তাদের একমাত্র সন্তান বুন্নি ।

তবে রাতভর বৃষ্টি শেষে যখন ভোর হল, টুকরো টুকরো স্মৃতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জীবনের হিসাব-নিকাশ শেষে যখন ঝলমলে রোদে ভরে উঠল ওদের উঠোন, তখন নয়নাংশুর বয়ানে বুদ্ধদেব আমাদের একটা আশার বাণী শুনালেন, চিরায়ত অভ্যাসগ্রস্ত বাঙালি জীবনের জয়ধ্বনি শুনালেন, সমস্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কেবল বেঁচে থাকার মন্ত্র শুনালেনঃ
"ভালোবাসা জরুরী নয়, স্বামী স্ত্রী জরুরী, বেঁচে থাকাটা জরুরী ।"



©️ সালমান মাহফুজ


সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ২:৫৭
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রোএক্টিভিটি এবং কম্পাউন্ড ইফেক্ট: আমার গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শিক্ষা

লিখেছেন মাহদী হাসান শিহাব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১১



আমার গুরুত্বপূর্ন দুইটা লার্নিং শেয়ার করি। এই দুইটা টুল মাথায় রাখলে দৈনন্দিন কাজ করা অনেক সহজ হয়। টুল দুইটা কাজ করতে ও কাজ শেষ করতে ম্যাজিক হিসাবে কাজ করে।

এক.

স্টিফেন কোভের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

লিখেছেন সায়েমার ব্লগ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৩

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ
ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

১।
যৌন প্রাকৃতিক, জেন্ডার নয়।জেন্ডার মানুষের সৃষ্টি (social, cultural construction)। যৌনকে বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ডিল করে, তাঁকে ঘিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্মৃতির ঝলক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি এবং মনের শান্তির খোঁজে

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০১



সরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে একটি ঘূর্ণায়মান পথ জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অবস্থানে আমি খুব শান্তি অনুভব করি। নদীর জল ছুঁয়ে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে এক আন্তরিক সংযোগ অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×