somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পথে ঘাটে পর্ব (২২)

১২ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দূর থেকে দেখলাম বাসটা, বাসের দরজার পাশের জানালায় যেখানে হেল্পাররা দাঁড়ায় সেখানে রোদে পোড়া শার্ট আর হাল্কা কোঁকড়া ঘন চুল ফর্সা চেহারার এক ছেলে হেলান দিয়ে রড আকড়ে ধরে দাঁড়ানো।
বাসে উঠতে উঠতে প্রতিদিনের অভ্যস্ত জিজ্ঞাসায় বললাম সীট আছে তো!! ছেলেটি কয়েক মুহূর্ত তাকালো এবং অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল, বাসে উঠে সীটে বসতে বসতেও দেখলাম সেই যে ছেলেটি মুখ ঘুরিয়েছে আর এদিকে বাসের ভেতরের দিকে ফিরেই তাকাচ্ছেনা!

শপিংমলে ক্রেতাকে সেলসম্যান বলে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যাওয়ার মত আমার অস্বস্তি লাগলো ভুল করে কি কোন যাত্রীকে কন্টাক্টর ভেবে সীট আছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম!

এই ভাবনা থেকেই কয়েকবার তাকালাম, খানিকটা চেনা চেনা লাগলো!
মনে পড়লো এই ছেলে বাসের কন্টাক্টরই।একে বহুবার দেখেছি।
ছেলেটিও আমাকে চিনতে পেরেছে, একদিন ওকে ভাড়া দিতে গিয়ে টাকা নীচে পড়ে যাওয়ায় সেই টাকা তুলে দিতে দিতে বলেছিল সরি, সেদিন আমার সাথে থাকা পরিচিত এক মেয়ে বলেছিল আরে বাহ! এখন বাসের হেল্পাররাও সরি টরি বলে দেখছি! বললাম এই ছেলেটা অনেক ভদ্র প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখা হয়।
একদিন বাসে উঠতে যেয়ে দরজা থেকেই পড়ে যাচ্ছিলাম, বৃষ্টির দিন ছিল; হাতে ছাতা ছিল; কাধে অফিসের ব্যাগ ছিল; হাত বৃষ্টির পানিতে ভেজা ছিল; বাসের হ্যান্ডেল ও ভেজা ছিল; ফলে হ্যান্ডেল ধরে বাসে উঠে দাঁড়াতেই হাত পিছলে পুরা শরীরটাই ব্যালেন্স শূন্য হয়ে গিয়েছিলো অন্য হাতে ছাতা ব্যাগ থাকায় কিছুতেই কিছু করতে পারছিলাম না, তখন এই ছেলেই আমাকে ধরে ফেলেছিল, বড় ধরনের বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে।
ওইদিন আমি মরে না গেলেও নিশ্চিত আমার পা দুটো বাসের চাকার নীচে চলে যেত।
এরকম গাড়ির নীচে কিংবা গাড়ি থেকে পড়তে পড়তে একটুর জন্য বেঁচে যাওয়া ঘটনাগুলো পথে ঘাটে চলতে ফিরতে কম বেশি অনেকের জীবনেই ঘটে, অনেকের জীবনেই এমন গল্প আছে যারা বাসের চাকার নীচে চলে যেতে যেতে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছে।
আমার বেলায় ও এই ঘটনা আগে পড়ে বেশ কয়বার ঘটেছে ঘটছে কিন্তু এই ছেলের সাথে বেশ অনেকবার দেখা হয়ে এবং ওর ভালো ভদ্র ব্যবহারের কারনেই মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল। তারপরের ব্যাপারটা বেদনাদায়ক, প্রবল ধাক্কা খেলাম মন বিষাদে ভরে উঠলো যখন দেখলাম ও খুড়িয়ে খুড়িয়ে এটা ওটা ধরে ধরে নিজের ব্যালেন্স রাখছে কোন বাস স্ট্যান্ড এলেই বেশ শব্দ করে যাত্রী তোলার জন্য বিভিন্ন জায়গার নাম বলছে, ও এতটুকুই করতে পারছে কেননা বিস্ময়ের সাথে আবিস্কার করলাম ও এক পা হারিয়েছে।।

ভেতরটা ভীষণ যন্ত্রনায় আক্রান্ত হল ওর বয়স পা হারানোর জন্য মোটেও উপযুক্ত সময় না।
ওর শারীরিক গঠন, চেহারা, ভদ্রতা, সততা যেকোনো ভদ্র সুদর্শন ছেলেকেও হার মানাবে।
ছেলেটিও ইতিমধ্যে দেখেছে যে আমি জেনে গিয়েছি ওর এই নিদারুন কষ্টের ঘটনা।

ও এক বিষাদ মাখা মুখ নিয়ে জানালা গলে বাইরের দিকে মাথা বের করে রাখল, বাইরে প্রচণ্ড বাতাশ ওর চোখে মুখে ঝাঁপটা দিচ্ছে, ক্ষণে ক্ষণে সেখানে চেহারা পরিবর্তিত হচ্ছে কখনো বিষাদ, কখনো হতাশা কখনো জেদ প্রতিফলিত হচ্ছে বার বার!!
ভেতরটা হাহাকারে পূর্ণ হল আমার।

অনেক কথা অনেক প্রশ্ন অনেক কিছুই মাথায় এলো, কীভাবে হল! কবে হল! কেমন করে হল!! কেন হল! পুরা জীবনটা কীভাবে কি করবে ছেলেটি!
এক লোক অতি উৎসাহ হয়ে জানতে চাইল!
- ক্যামনে কি হইছে!
প্রবল অভিমান আর বুক ভর্তি কান্না ঢেকে বাইরের দিকে মুখ করে বলল
- এক্সিডেন্ট করছি!
- কতদিন হইছে?
- অনেকদিন! পঁয়ষট্টি দিন বিছানায় পইড়া ছিলাম আজকেই বাইর হইছি!
আহারে গুনে গুনে একেকটা দিন না জানি কত কষ্টে অতিবাহিত করেছে ও!
আমার মনে পড়লো আনুমানিক দুই মাস আগে বাসায় ফেরার পথে জসিমউদ্দিন রোড এসে দীর্ঘ সিগন্যালে যখন বাস থেমে ছিল তখন কালো গাট্টাগোট্টা এক লোক প্রতি বাসে গিয়ে যাত্রীদের কাছে সাহায্য চাচ্ছিল, বলছিল তার বাসের হেল্পার ছেলেটি এক্সিডেন্ট করেছে পা চাকার নীচে পড়ে একদম পিষে গেছে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া দরকার বিশ্বাস না হলে দেখেন ওই যে ওইখানটায় শুইয়ে রেখেছি দয়া করে কিছু সাহায্য করেন।জানিনা ওই পা হারানো ছেলেটা ওই ছিল কিনা!
আমি সেদিন একটা টাকাও দেইনি, যদিও আমার ভেতরটা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল তবু দেইনি, কারন আমার সাথে এক অতিরিক্ত নাক সিটকানো বান্ধবি ছিল যে এই সাহায্য চাওয়া লোকজনদের ধান্ধাবাজ ভাবে, কেউ কেউ যে মিথ্যা বলে ভিক্ষা করেনা তা বলছিনা, জীবনে আমি যতবার তার সামনে কাউকে সাহায্য করেছি তার কঠিন অহংকারী মুখে তিরস্কৃত হয়েছি।

বেশ অনেকবার ওর বেদনাবহুল চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছে ওর কষ্টের বর্ণনা আমিও যে শুনেছি জেনে গেছে ও।
একে হয়তো আত্মার টান বলে, হয় না এরকম পাশাপাশি দুজন অচেনা মানুষ অথচ দুজনের একজন বিপদে পরলে অথবা সমস্যায় পরলে অন্যজন বুঝে যায়, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।
এরকম এক বিষাদ মুহূর্তে এয়ারপোর্ট এসে এক আকস্মিক ঘটনা ঘটে গেলো!

এয়ারপোর্ট দাঁড়ানো কোন ট্র্যাফিক পুলিশ বাস স্ট্যান্ড বেশিক্ষন দাঁড়ানোর জন্য বাস ড্রাইভারকে হয়তো থামতে বলেছিল ড্রাইভার থামেনি তাই ট্র্যাফিক পুলিশ বাস আটকাল একজন বাসে উঠলো এবং সদ্য পা হারানো ছেলেটিকে চর থাপ্পর দিতে দিতে বলতে লাগলো নাম গাড়ি থেকে নাম, বাসের যাত্রীরা কেউ কোন প্রতিবাদ করছে না, সবার অফিসে যাওয়ার তাড়া, এবং সচরাচর এমনি হয় কোন কিছু হলে সবাই অতি আগ্রহ নিয়ে ব্যাপারটি উপভোগ করে, যান্ত্রিক এই জীবনে বিনোদনের খুব অভাব তো।

আমি একদম সামনের সারিতে ছিলাম, ইতিমধ্যে ছেলেটির দুর্ভাগ্যে আমি যেহেতু ব্যাথিত আমি অন্যদের মত বিনোদন উপভোগ করতে পারলাম না ট্র্যাফিক পুলিশকে বললাম আপনি কাকে মারছেন কাকে বাস থেকে নামতে বলছেন দেখেন, দেখেন ওর পা নেই, ও এই বাসের হেল্পার ও না, হেল্পার ওই যে একদম পেছনে দাঁড়িয়ে, আপনি শুধু শুধুই ওকে মারছেন। ছেলেটির ও যেন তখন খেয়াল হল বললো আরে আমি নামব ক্যামনে আমার তো পাও নাই!

এই কথা আমি মানতে বাধ্য ওই মধ্যবয়স্ক ট্র্যাফিক পুলিশটি অত্যন্ত ভদ্র কিংবা তার কাছ থেকে ভদ্রতা অনেকেরই শেখা উচিত, সে বিন্দু মাত্র দেরি না করে ছেলেটির কাছে ক্ষমা চাইলো, হাত জোর করে ক্ষমা চাইলো, আমার দিকে ফিরে বলল আমি দেখিনাই যে ওর পা নেই আই এম সরি, ছেলেটিকে কম পক্ষে ১০/১৫ বার বলল আই এম সরি সরি সরি সরি আমি দেখিনি সরি, ড্রাইভারকে বলল শুধু এই ছেলেটির জন্য তোরা আজ বেঁচে গেলি, তারপর ছেলেটিকে আরও বেশ কয়বার সরি বলে নেমে গেলো, আমরা দুজন দুজনের দিকে বিজয়ের দৃষ্টি বিনিময় করলাম।

হায়রে নিস্পাপ ভাই আমার দেখ ভাই আমরা অল্প একটু ভালবাসাতেই কত খুশি তবু প্রকৃতি কি কঠিন কঠিন পরীক্ষায়ই না ফেলে আমাদের।

বাস অনেকটা সামনে চলে এসেছে, কি মনে করে ছেলেটি জানালা দিয়ে পেছনে তাকিয়েই চমৎকার মুখ ভর্তি হাসি দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল পুলিশে এখনো আমার কাছে মাফ চাইতেছে দুই হাতজোড় করে ইশারায় মাফ চাইতেছে।ওর চোখ মুখ আনন্দে ঝক ঝক করছে, পা নেই তো কি হয়েছে ইনশাআল্লাহ ও অনেক ভালো থাকবে। এমন করেই হেরে যেতে যেতে জিতে যাবে, জিতে যাবেই, ওর এই বোনটির দোয়া ওর সাথে থাকবে আজীবন।




সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১:০১
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×