somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধের গল্প : আফরিন

২৬ শে মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৫:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবি: গুগল।।

আফরিনের বছর দেড়েক হল তার কোল জুড়ে এসেছে এক মেয়ে শিশু, শখ করে তার শাশুড়ি তার প্রথম নাতির নাম রেখেছে ফাতিমা। ফাতিমার বাবা চাকরীর সুবাদে তখন দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন। সময় ১৯৭১ আফরিন তখনো কিশোরী কেননা মাত্র ৬ বছর বয়সে সে বধু বেসে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে সে সময় এত অল্প বয়সে বিয়ে হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু না এবং আফরিন তের বছর ৫ মাস বয়সে তার বড় মেয়ে ফাতিমার জন্ম দেন।


কিন্তু সহজ সরল আফরিন কি জানি কি দোষে শাশুড়ির মন কিছুতেই জয় করতে না পারায়; তার শাশুড়ি কোন কারনে অকারনে পুত্রবধুকে তার বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।


বাপের বাড়িতে এসে একদিন সে বুঝে অবুঝে জ্ঞানে অজ্ঞানে যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন। যদিও তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি আসলে উনি কি করেছিলেন, তিনি যা বুঝলেন চারদিকে শুধু গণ্ডগো্‌ একদল পুলিশের মত দেখতে আসলে পুলিশ না তারা মাথায় সবুঝ রঙের উঁচা হ্যাট পড়ে বড় বড় ব্যাচ বুকে লাগিয়ে, কাঁধে বড় বড় বন্দুক নিয়ে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ায়, লুটপাট করে খায় দায় এবং যখন তখন গ্রামের সহজ সরল মানুষদের ধরে নানা ভাবে অত্যাচার করে গুলি করে মেরে ফেলে।
তারপর আশেপাশের লোকজনের কান্না দেখতে দেখতে কি এক আনন্দ করতে করতে চলে যায় তাদের নিজস্ব ঘাটিতে।


মাঝে মাঝে দেখা যেত রাস্তায় অচেনা পুরুষ যুবার লাশ পরে আছে, কিংবা ছোট ছোট নালায় খালে বিলে পাঁচ ছয়টা মানুষের মাথা ভেসে আছে, কিন্তু উনাদের (পাক হানাদার বাহিনীর) ভয়ে সেই সকল লাশ গ্রামের মানুষজন সৎকার করতে সাহস করত না।


এমনি এক সময়ে রাতে আফরিনের বাপের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় লিচু, ফারুক, নিজাম আর হারুন নামের চার যুবক।
ফারুক আর নিজাম আফরিনের মামাতো এবং লিচু পাশের গ্রামের আর হারুন হল চাচাতো ভাই। এরা এসে আফরিনদের বলল আমাদের একটু সাহায্য করতে হবে, বলেই কোন কিছুর অনুমতি না নিয়ে লাফ দিয়ে লিচু হাতে একটা পোঁটলা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে; তাদের ধানের গোলার ভেতর রেখে; বাইরে এসে বলে, সাহায্য তেমন কিছু না একটা জিনিশ রাখছি আপনাদের ধানের গোলায় সকালে ওইটা সেলিম অথবা রাকিবরে দিয়া (আফরিনের ছোট দুই ভাই) পাঠাইয়া দিয়ে্‌ আমরা রাস্তায়ই থাকবো কোন অসুবিধা হবেনা।
আর ভয়ের কিছু নাই বলে ওরা আফরিনদের বাড়ির পেছনে যে বেত গাছের কাঁটার ঝাড় আছে যে জন্য ওই পথ দিয়ে কেউ যাতায়াত করেনা সেই পথ দিয়ে ওরা কোথায় যেন চলে গেলো।


ওরা চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষন পর সামান্য একটুক্ষণ গোলাগুলির আওয়াজ হল, সেই সামান্য আওয়াজে আফরিনের বাপ কাঁপতে কাঁপতে তার দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো কিংবা ঘাপটি মেরে পরে রইলো। পরিস্থিতি মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না আফরিনের বাপের কাছে, কে জানে কাল ভোরে হয়তো তার মাথাটাও ওই নালায় ভাসতে দেখা যাবে।


আফরিনের বাবা বরাবরই ভিতু প্রকৃতির মানুষ!

সেই রাতে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে শেষ রাত অবধি দূর থেকে এক পেঁচা ডেকে ডেকে কি এক গভীর আলাপন করে যায় যে! আফরিন তার কিছুই বুঝতে পারেনা!!
সারা বাড়ি নিশ্চুপ, গাছের পাতাগুলো যেন নড়তে চড়তে ভয় পাচ্ছে। ভোর হয় হয় এমনি এক সময়ে আফরিন অনুভব করে আর শুয়ে থাকলে চলেনা।
ছোট ভাই দুটো একটার বয়স ছয় আরেকটার আট বছর। এরা ছোট এরা বাবা মায়ের মতই ভিতু, কাজেই সেই পোঁটলা নিয়া তারই বের হয়ে ভাইদের কাছে পৌঁছাইয়া দিতে হবে বুঝতে পেরে এগিয়ে যায় আফরিন ধানের গোলার দিকে। ওটা থেকে বের করে পোঁটলাটা, ভেতরে বুলেট ভর্তি!!
বুলেট বুঝতে পারে কেননা গ্রামের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো দেখতে দেখতে এসব অনেক ডাল ভাত হয়ে গেছে! লাশের পাশ থেকে টার্গেট মিসিং হওয়া বুলেট কুড়িয়ে কত শিশুরা যে খেলা করে বেড়ায়! ওদের হাতে দেখে দেখেই আফরিন বুলেট চিনেছে, বুলেটের পোঁটলাটা কোমরে পড়নের কাপড়ে পেঁচিয়ে নিয়ে কোলে নেয় ফাতিমাকে।


আফরিনের বাবা মা দুই ভাই কাঁপছে থরথর করে কেননা তারা বের হতে গিয়ে দেখে পুরা বাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে পাকহানাদার বাহিনী। তাদের কাছে খবর আছে এ বাড়িতে গতকাল মুক্তিযোদ্ধা এসেছিল!! একটা মুক্তিকে ও জীবিত ছাড়া যাবেনা!

তারা বাড়ি তল্লাশি করা শুরু করে দিয়েছে!
আফরিন ফাতিমাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে,

কেয়া রে! কাহা যা রাহি হো হাক দেয় মিলিটারি।
কেঁদে ওঠে ফাতিমা মিলিটারির হাক শুনে! না পেটে রাখা বুলেটের খোঁচা লেগে কে জানে।

আফরিন কোন মতে বলে,' শশুরাল!'
ওর চোখ দিয়েও পানি পড়ছে, কাঁদছে, ভয়ে কাঁদছে, ফাতিমার জন্য কাঁদছে, ছোট দুই ভাইয়ের জন্য কাঁদছে, ভিতু বাবার জন্য কাঁদছে! সহজ সরল মায়ের জন্য কাঁদছে! হতে পারে আজই সবার জীবনের অন্তিম দিন!!


আফরিনের কান্না দেখে না কি জানি কি মনে করে আফরিন কে যেতে বলে ওরা! বের হয়ে দৌড় দৌড় দৌড়!

আধ মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছে লিচু, ফারুক, নিজাম আর হারুন নামের চার যুবক অস্র হাতে সুসজ্জিত! বুলেট যা আছে হয়ে যাবে! বাকীগুলো হাতে এলে আরও নিশ্চয়তা অপারেশন জিতে যাওয়ার! কাল ইচ্ছে করে আফরিনদের বাড়ি গিয়েছে ওরা! জানত খবরটা ঠিক পৌঁছে যাবে হানাদারদের কাছে, তবে যত যাই বলিস বুলেট ও বাড়ি রেখে আসা ঠিক হয়নি হারুন বলে ওঠে! যদি ধরা পরে ওদের কাউকে জীবিত ছাড়বেনা!

দুশ্চিন্তার এই মুহূর্তে পৌঁছে যায় আফরিন, চিন্তায় অস্থির হারুন বলে কই বুলেট কই! আফরিন বের করে দেয় পোটলাটা, অতগুলো সাথে রাখা নিরাপদ না বলেই কিছু তোমাদের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলাম! বলে লিচু!

বাড়িতে আর আছে কে কে!

ছোট দুই ভাই আর বাবা মা!

উনাদের কিছু হবেনা বুবু তুমি চিন্তা করোনা আমরা আছি আশেপাশেই, ওরা সার্চ করে যাওয়ার পথে আমরা আক্রমন করব! আমাদের দেশ স্বাধীন করে ছাড়বই বুবু!
আফরিন কিছু বোঝে কিছু বোঝে না।।


ঘণ্টা খানেক একভাবেই বসে থাকে আফরিন, তারপর একসময় ফাতিমাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দুই পাশে ধানের খেত সবুজ মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।

দূর থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে অনেকক্ষন, এক লোক হেঁটে আসছে তার হাতে একটি রেডিও, তাতে বেজে চলেছে
''জয় বাংলা বাংলার জয় হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়!কোটি প্রান একসাথে জেগেছে অন্ধ রাতে নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়।''

দেশের এই গণ্ডগোলের সময় কোন পাগল এই কাণ্ড করছে! পাক বাহিনী দেখলে জীবিত রাখবে!! ভাবতে ভাবতে আফরিন সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবিস্কার করে এই তার ছিরা পাগল আর কেউ না স্বয়ং ফাতিমার আব্বা!!

কাছে আসতেই প্রথম যে কথাটা আফরিন তাকে বলল আপণে কি পাগল হইছেন? এইভাবে পথের মধ্যে শব্দ করে কেউ রেডিও চালায়! হানাদার বাহিনী শুনলে আপনেরে জীবিত রাখবে!! হেসে ফাতিমাকে কোলে নিয়ে আরেক হাতে জড়িয়ে ধরে আফরিনকে। আমার এত সাহসী বউ থাকতে ভয় কি!
ততক্ষনে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন সাক্সেসের খবরটা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১০:৩৭
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×