তিনি (বস/মহিলা) আমাকে ডেকে বলল দেখো ময়না পাখি তুমি যতই পাখনা মেলে উড়া উড়ি কর তোমাকে কিন্তু অবশ্যই আমার স্টোরি লিখতে হবে এবং স্টোরির পেহলা কদম বনানী কবরস্থান। আমি গত পাঁচ বছর ধরে সেখানে রোজ যাই তোমাকেও সেইখানে যেতেই হবে, না বোধক কিছু বলে লজ্জা দেবে না।
আমি অবাক খুশি হয়ে না করে দিতে দিতে বললাম, না হবে কেন বিচলিত নারী আছি আমি আছি।
সেই কথা মত কাজের প্রেসার দেখিয়ে নানা তালবাহানা ছলচাতুরি করে, অতি ব্যস্ত দিন কাটাতে কাটাতে বেশ কয়দিন একদম হাওয়া হয়ে যেতে যেতে দেখলাম সেও নাছোড় বান্দা পিছু ছাড়ি ছাড়ি করে ডুবন্ত নৌকা কি করে যেন ভাসিয়ে রাখলো, এবং গতকাল এলো সেইদিন।
এক সহকর্মীর নতুন রোগের আলামত দেখা দিয়েছে, তাকিয়ে থাকার আলামত, উনি আমার দিকে এতই তাকিয়ে থাকে যে আমার ধৈর্য তলানিতে গিয়ে ঠ্যাকায় ডিরেক্টর স্যার এর কাছে বিচার দিয়ে নানারকম ভালো ফলাফল আশা করে থাকতে থাকতে দেখি ডিরেক্টর স্যার(নিজ ডিপার্টমেন্ট বস)অফিসে আসে নাই, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আজ আর তাকিয়ে থাকার ভেতর থাকবনা, শেষ বেলাটা বিচলিত নারীর সাথে কবরস্থান পরিদর্শনেই যাব, আমি এক কথার মানুষ সেই কবে কথা দিয়েছি!।
বনানী কবরস্থান কাছাকাছি এরিয়ায় মৃত্যু ভয় বাড়ানোর জন্যও এত এত বছরে একবার অন্তত যাওয়া উচিত ছিল।
উনার রুমে উকি দিতেই উনি খুশিতে ডগমগ করতে করতে বলল ও মাই গড ইতি তুমি বিলিভ করবেনা আমি মাত্র মোবাইলটা হাতে নিয়েছি।
কি জানি কি মিরাকল হয়েছে বুঝতে না পেরে হাল্কা গলায় বললাম ওয়াাআআআও।
সে বলল ওয়াও না এই দেখো ড্রাইভারের নাম্বার আমি তাকে এখুনি কল দিচ্ছিলাম গাড়ি বের করতে। এতে আমার খুশি হওয়ার কিছু হয়েছে ভেবে ভেবে হুম বলতেই সে
হেসে বললেন অযু আছে? অযু করে আসো বেবি, অনলি দুই মিনিট।
পড়িমরি করে ছুটে অযু করতে যেতে যেতে ফেইজবুক নোটিফিকেশন চেক করতে করতে দেখলাম কিছু দরকারি ইনবক্স এসেছে সেগুলোর রিপ্লাই সেই মুহূরূর্তেই না দিলেই নাহ! আমিতো প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেরই নাগরিক আমাকে এত টাইম মেইনটেইন করলে একটু কেমন দেখায় নাহ!!
বনানী কবরস্থাণে ঢুকে আমার মনের হাল্কা ভাব পরিবর্তন হতে থাকলো গেট থেকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে ছোট খাটো শুকনা হাল্কা পাতলা সুন্নতি দাড়িওয়ালা এক লোক এসে সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে নিজের পরিচয় দিলো যে উনি এইখানের মসজিদের ইমাম।
তারপর কুশল বিনিময় করে আমার কাছাকাছি থাকতে থাকতে একটু লাজুক কিন্তু দায়িত্ব পালনে স্থির সচেতন স্বরে বলল যে আমরা মরে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের আমলনামা ক্লোজ হয়ে যায়, যা কিছু ভালো কাজ করতে হবে জীবিত থাকতেই করতে হবে। আমি তার কথার উত্তর দিলাম না সেও উত্তর আশা না করে সাথে সাথে আমাদের গন্তব্য কবরটি পর্যন্ত গিয়ে তার মত দূরে সরে গেলো।
চারদিকে খা খা বিসন্নতা এবং অত্যন্ত ভারী পরিবেশ হওয়ায় আমি চারপাশে ঘন ঘন চোখ বোলাতে থাকলাম, তেমন কিছুই চোখে পড়লো না শুধু স্তব্ধ আকাশ শূন্যতা ছাড়ারাআমার সাথের জন তার প্রিয় মানুষের কবর ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, একটু দুরেই ৫/৬ জন লোক কিছু একটা কাজ করছে এদিকে একটি বার ও তাকাল না। আমি তাতে নিশ্চিন্ত হয়ে ছবি তুললাম। হুজুরকে দেখা যাচ্ছে না।
কিছু কিছু কবর কি যে সুন্দর করে বাধাই করা। এরা অনেকেই আমাদের দেশের বিখ্যাত জন। কেউ আবার ক্ষণজন্মা অকালে চলে গেছে প্রিয়জনদের দুঃখে ভাসিয়ে।
ফিরতে ফিরতে দেখলাম একটা এক মাসের বাচ্চার কবর, কি যত্ন করেই না বাধাই করে রেখেছে শিশুটির বাবা মা। বের হতে হতে দেখলাম হুজুর কোত্থেকে যেন হন্ত দন্ত হয়ে খুব কাছে না এসে দূর থেকেই প্রচ্ছন্ন দৃষ্টিতে স্মিত হেসে বিদায় জানালো।
পুরো কবরস্থানের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বের হতে হতে প্রকৃতই আমার মন ভারী হয়ে গেলো।
আমি ভাবলাম আমার মৃত্যুর পর আমার প্রিয়জনদের চোখের জল আমার জন্য সুখকর হবে না, আমি চাই ও না কেউ আমার জন্য কাদুক। যত দিন তারা পৃথিবীতে থাকবে হাসি খুশি আর সুখে থাকুক।
গতকালই প্রথম একসাথে এত কবর দেখেছি।
এ কথা সত্যি যে কবর গুলো দেখে মনে হয়েছে এটা খুবই শান্তির জায়গা।
কেউ একজন তাদের প্রিয়জনের কবরে সযতনে লাগিয়ে দিয়েছে বেলি ফুলের চারা। তাতে ফুলে ভর্তি হয়ে আছে।
ছবি গুলো নেম প্লেট দেখে তুলিনি ছবি তুলতে তুলতে সাথের জনের কথা শুনেছি, হুজুরের দিকে ফিরেছি শূন্য দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়েছি, ছবি গুলো পিসিতে নেয়ার পর দেখলাম এরা প্রায় সকলেই আমাদের দেশের বিখ্যাত চেনা জানা মানুষ।
ক্ষণজন্মা এই ছেলেটি অতি অল্প বয়সেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে।
আরেক অতি অতি ক্ষণজন্মার কবর এটি। এই শিশুটি বেঁচে ছিল মাত্র এক মাস।
প্রায় সবগুলো কবর দেখলাম খুবই সুন্দর করে বাঁধানো।
একটি কবরে দেখলাম ছোট মত টুল করে দিয়েছে বসার জন্য কিনা!! কে জানে।
কেউ একজন যত্ন করে এই কবরের উপর রেখে গিয়েছে গোলাপ, সেগুলো শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছে।
এই কবরের সুন্দর ছড়ানো সবুজ।
কিছু কিছু কবরে একাধিক নেমপ্লেট এটা নাকি এই জন্য যে ক্রয় সুত্রে একি পরিবারের অধিক মৃত্যু হলে তাদের একি কবরে দাফন হয়ে থাকে।
সবশেষে আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাসের অন্ধকার কবিতার শেষের কয়েকটি আমার অতি প্রিয় লাইন--
গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে জাগাতে চাও কেন?
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর ;
তাকিয়ে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
কীর্তিনাশার দিকে ।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো- ধীরে- পউষের রাতে
কোনোদিন জাগব না জেনে-
কোনদিন জাগব না আমি- কোনদিন আর।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:০৯