somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পথে ঘাটে পর্ব (২৪)

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




সেদিন অনেক ঝড় হয়েছিলো ঢাকার রাস্তা ঝরে পরা পাতার সাথে বৃষ্টির বড় বড় ফোটার সাথে একাকার হয়ে আকাশ ভেঙ্গে পানি নামার, গাড়ির চাকার সাথে রাস্তার পানির ঘর্ষণে সাময়িক ফোয়ারার দৃশ্যটি ছিল সত্যিই মুগ্ধকর। তখন সময় রাত দুইটা, ফিরছিলাম সমরিতা হাসপাতাল থেকে সেইখানে আপুর লাইফ সাপোর্টের তৃতীয় দিন চলছে।

হসপিটালের সামনে থেকে আমাদের গ্রুপের ২০/২৫ জন যে যেভাবে পারছে ট্যাক্সি, সিএনজি, প্রাইভেট কার ম্যানেজ করে চড়ে বসেছেন।

কে কই! কার সাথে কে কোন গাড়িতে উঠবে সেই পরিকল্পনা ছাড়াই যে যার মতন উঠে পড়েছিল, যা অত্যন্ত ভুল, রাত; পুরুষ; মহিলা এইগুলা মাথায় রেখেই গাড়িতে লোক বণ্টন করা উচিৎ ছিল, কিন্তু সেই সব চিন্তা করার বুদ্ধি কারো মাথায় ছিলনা, আসলে এই জন্যই বলা হয় বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে, মানুষ বিপদের মধ্যে আরও বিপদে পড়ে, মাথা ঠাণ্ডা না রাখতে পারার জন্য।

আমি যে প্রাইভেট কারে উঠলাম সেটায় আমার মা, মেঝো বোনের মেয়ে চড়ে বসেছে, ড্রাইভারের পাশের সীটে বসেছে মেঝো আপুর ছোট ছেলেটা।
ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টি মানেই জীবনেও ছাড়বেনা এই ধরনের জ্যাম। বাচ্চাগুলা অবুঝ ছোট, ওদের খালি আম্মু চাই সেই চিন্তা, আর কিছু; না ওরা দেখছে; না শুনছে। একই অবস্থা আম্মুর ও, তার দিকে তাকিয়ে মনে হলনা সে আশেপাশে কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন।

গাড়ির ড্রাইভার সেই পান্থপথ থেকে শুরু করে জ্যামে ঠেলে ঠুলে যেতে যেতে কোন বিশেষ একজনকে বার বার কল করছেন, কথা বলছেন, কল ধরছেন, কথা বলছেন, বলেই যাচ্ছেন, সে কোন মুহূর্তে কই আছেন, কই যায় এই সবই হচ্ছে কথা।
কণ্ঠ জড়ানো নেশাগ্রস্থ, ও মদের পচা গন্ধ যুক্ত, আমি ঠিক তার পেছনেই বসায় এবং প্রাইভেট কার নিম্নমানের হওয়ায় ড্রাইভারের সীট পেছনের সীট এর কাছাকাছি।
তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম, বেশ কিছু প্রশ্ন, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, সেকেন্ডে সেকেন্ডে কই আছেন এই ইনফরমেশন দেয়া থেকে বিরত রাখতে।

জানালো গাড়ি তার নিজেরই, ভাড়ায় চালায়, দুরের ট্রিপগুলোতে বেশি যায়, সে গাড়ি চালালে কি হবে আসলে শিক্ষিত, ব্যবাসায় লস খেয়ে আজকে ভাগ্যের দোষে সে ড্রাইভার, মাথায় ঘন কালো চুল, ঠোঁট সিগারেটে পুড়ে পুড়ে কালচে, আর রিয়ার ভিউ আয়না আমার দিকে ঘুরানো।

সে যেমন আমাকে দেখতে পাচ্ছে আমিও তাকে দেখতে পাচ্ছি। চেহারা হাইড করতে চাইলে ওড়না মুখে টেনে দিলে হয়, সেটা করলাম না, যদি তার ছিনতাই বা আরও খারাপ কিছু মাথায় এসে থাকে, তবে তাকে আমার চেহারা দেখতে দেয়া উচিৎ, ব্যাপারটা নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা ও হতে পারে যে আমার চেহারার মায়া ভাব বেশি।

বেশির ভাগ মানুষ সেই মায়া উপেক্ষা করতে পারে না।
কিন্তু সে ক্রিমিনাল কিংবা মাতাল, কাজেই আসলে সে যেকোন কিছু করে বসতেই পারে। আমার আম্মু খোঁচা দিয়ে চাপা গলায় বললেন, কেন আমি ড্রাইভারের সাথে কথা বলছি, ড্রাইভারের কথাবার্তা তার পছন্দ হচ্ছে না, কাজেই আমি যেন চুপচাপ থাকি এবং যার তার সাথে যেন এইরকম আসর বসিয়ে গল্প না করি এই রকম অর্থ প্রকাশে, তার কুনই দিয়ে খোঁচা দিয়ে আমায় চুপ করালেন।

কাজেই ড্রাইভার ফোন দিয়ে আবার লোকেশন বলতে শুরু করলেন, ইতিমধ্যে আমরা মহাখালি ফ্লাইওভার পার হয়ে, বনানীর সিগন্যালে এসে থেমে আছি, বৃষ্টি থামেনি, হাজার হাজার গাড়ির ভেতর আমাদের দলের লোকজনের গাড়ি চিনতে পারলাম নাহ।
অবস্থা যে ইনসিকিউর সেইটা জানাতে যাকে যাকে ফোন দিলাম, কেউই রিসিভ করলো না কিংবা ঝড় বৃষ্টির কারনেই হয়তো শুনতে পেলনা, জ্যাম ছেড়ে আমরা এমইএস ক্রস করার পর পর মেইন রোড থেকে সরে নিকুঞ্জর ভেতরের রাস্তায় গাড়ি হুট করে নিয়ে গেলো ড্রাইভার, এবং কিছুটা সামনে এগিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো।

তার মোবাইলে কল এলো এবং সে রিসিভ করে আ কিংবা উ জাতীয় কিছু একটা বলার আগেই পেছন থেকে তার চুল টেনে ধরে অন্য হাতে তার মোবাইল টেনে নিয়ে ফোন সুইচ অফ করে দিয়ে বললাম, অনেক বাড়াবাড়ি করছেন, এইবার আমি যা বলবো তাই করবেন, গাড়ি স্টার্ট করেন, সোজা সামনের দিকে ফিরে চালান, স্পীড বাড়ান, রাস্তার ডানে নিয়ে চালা্ন, আপনার মোবাইল সুইচ অফ, এবং বাসায় পৌছার আগ পর্যন্ত মোবাইল পাবেন না।

রেগে গেলে আমার ভয়েস ভারী হয়, রেগে গিয়ে ঠাণ্ডা গলায় কথা বললে তা সন্ত্রাসী ধরনের শুনায়। বেশির ভাগ মানুষ তখন ভড়কে যায়। বাচ্চা এবং আম্মুর নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার, কাজেই এটা আমাকে করতেই হল।
তারপর আর জ্যাম যেমন হলনা তেমনি গেঞ্জামও হলনা, আম্মু মোবাইল ছিনিয়ে নেবার পরই টের পাইছেন, আমরা আসলে বিপদে পড়তে যাচ্ছিলাম, কাজেই সে আমাকে কানে কানে জানলা দিয়ে মোবাইল ফেলে দেয়ার বুদ্ধি দিলেন।
মা, খালা চাচী বা এই ক্যাটাগরির পরিচিত অপরিচিতদের সহজ সরল বুদ্ধি বরাবরই আমাকে এটা রিয়ালাইজ করায় যে তারা কোনোদিন বড় হয়ে উঠবে না, তাদের বয়স পাঁচ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

বাকী পথ বিনা ঝামেলায় এলাম পুরাপুরি বাড়ির কাছে গেলাম না , ড্রাইভার চুল টেনে ধরা এবং মোবাইল কেড়ে নিতে গিয়ে তার গালে হাত লাগার পর থেকে উনি ভালোলাগার আবেশ নিয়ে গাড়ি চালিয়েছেন। আসলে মাতালদের মনে কখন কি উদ্রেক হয় আল্লাহ্‌ মালুম।

আমাদের দলের অনেকেই এসে পৌঁছেছে, ড্রাইভারকে ভাড়া এবং তার মোবাইল ফিরিয়ে দেবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি,
সে দূরে একটি টঙের দোকান থেকে মাথায় পানি ঢালছে, চোখে মুখে পানি দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে শার্ট ঠিকঠাক করে, ধীরে সামনে এসে দাঁড়াতে চাইলো। পারলোনা, অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো, এই মুহূর্তে তার মনে কি আবেগ চলছে বুঝতে পারলাম।
বললাম আপনার ভাড়া নিন, সে ফিরলো না, উফ নাটক। ফামিলির সবাই দেখছে ব্যাপারটা, আব্বু, ভাইয়া, দুলাভাই, বোনসহ সবাই এসে পৌঁছেছে, দুলাভাই অতি কিউরিয়াস, ইশারায় ড্রাইভারের সাথে আমার কি হইছে জানতে চাইছেন।
আমি শব্দ করেই বললাম উনার চুল টেনে ধরেছিলাম এবং মোবাইল কেড়ে নিয়েছি কারন সে এখানে ওখানে ফোন দিয়ে লোকেশন বলছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল ছিনতাই।

এইবার নায়ক ঘুরে দাঁড়ালো, অত্যন্ত আবেগময় চাহনি। না আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি তো আমার বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম ও সচিবালয়ে চাকরী করে, আমি অত খারাপ না, এই গাড়ি আমার, আপনি আমার গাড়িতে উঠেছেন, আপনার নিরাপত্তা আমার দায়িত্ব।
দায়িত্তের জন্য গাড়ি নিকুঞ্জ অন্ধকার রাস্তায় নিয়ে থামিয়ে রাখছিলেন?

সে তাৎক্ষনিক জবাব দিতে পারলো না, আমি তার ভাড়া দিয়ে মোবাইল বাড়িয়ে ধরলাম আবার নাটক, সে মোবাইল ফেরত নিবে না, কিছুতেই না, ওইটা যেন আমার কাছেই রাখি।
সবার সামনে খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার। ১০ মিনিট শেধে হাল ছেড়ে দেয়ার পর ড্রাইভার তার নাম, ঠিকানা, নাম্বার, তার মায়ের নাম্বার, তার চোদ্দ গোষ্ঠীর নাম্বার দিয়ে(আমি সেভ করার ভান ধরেছিলাম) এবং যেকোন বিপদে যেন তারে ফোন করি এই বলে মোবাইল নিলেন।
কিন্তু যেতে চাইলেন না। মানুষের কত রকমভাবে স্থায়ী, অস্থায়ী ভালোবাসা হয়। উনার ভালোবাসা হয়েছিল উনার চুল টেনে ধরায়।

(শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৭
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×