আমি পথে ঘাটের মেয়ে এইরকম নিজের সম্পর্কে ভাবতেই পারি, যেহেতু চাকরিজীবন শুরু হয়েছে কিশোরী কাল থেকে, ইন্টারে পড়তে পড়তে দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিতে নিতে উনাদের নানান ধরনের আদেশ উপদেশ দিতে দিতে নিজেরে ৪০/৪৫ বছরের আদর্শশিক্ষিকা মনে করতে ভালো অনুভব করতাম।
এগুলো খুবই হাস্যকর ব্যাপার,এগুলো পেরেশানির ব্যাপারও,এগুলো মাঝে মাঝে সহ্য হতো না।
তবু করতাম কারন যেকোন একটা কাজ করতে হবে এই জন্যা, অথবা আমি চঞ্চল,কিংবা কাজ করতে পছন্দ করি, বাবার সাথে চ্যালেঞ্জও একটা ছিল,নয়তো এটাও হতে পারে জীবনে কিছু করতে চেয়েছি, জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী, ক্ষণস্থায়ী সময় কাজে লাগাতে কিছু একটা করাই উচিত।
সবার উপকার করতে হবে, সবার পাশে থাকতে হবে, এই ধরনের নানারকম তুচ্ছ অথবা গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা-চেতনার মধ্য দিয়ে রাস্তা পার হয়ে রিকশার জন্যত দাঁড়ালাম।
ইফতারি আর একঘন্টা পর, সেই কারণে কিনা কে জানে কিংবা এদিকটায় মার্কেট বন্ধ থাকার কারণে, যে কারণেই হোক রাস্তাঘাট অসম্ভব রকম ফাঁকা।
সদ্য রাস্তা পাকা করা হয়েছে, সারা শহরের বিভিন্ন এলাকার একসাথে খনন কাজ ঝুলেছিল অনেকদিন।
এখন নতুন রাস্তা ঝকঝকে মসৃণ ও সুন্দর গাঢ় রংয়ের কালো, কিছু দূরে একটা মেয়ে একা দাঁড়িয়ে ঘনঘন আমার দিকে তাকাচ্ছে, সে সুন্দরী, হাতে ভার্সিটির ব্যাগ, কাগজ,কলম, লম্বা বড় ছবি আঁকার খাতা সম্ভবত শান্তা মারিয়াম পড়েন।
তার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম একা বলেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন আমাকে দেখে, ভরসা পাচ্ছেন উনি একা মেয়ে নন আরো একজন মেয়ে আছেন রাস্তায়, এর কারণ কিছু দূরেই চার পাঁচজন যুবক দাঁড়িয়ে, well it's not a big deal, তারা অভদ্র নয়।
আমাদের দেশের মেয়েরা এবং পুরুষেরা দিনে দিনে ভীতু হয়ে যাচ্ছেন, বহুবার এই জিনিস আমি উপলব্ধি করেছি।
কিছুদূরেই এক রিক্সাওয়ালা তার রিকশা নিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে এলেন।
বেলা পড়ে গেছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে, শপিংমলগুলো নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে, ক্রেতা নেই বললেই চলে, আশেপাশে ইফতারের আয়োজন চলছে।
হেডফোন দিয়ে পুরোনো দিনের একটা গান শুনছি, "কেউ বলে দখিনা কেউ বলে মাতাল বাতাস আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস।"
গানে মগ্ন এমন সময় সেই রিক্সাওয়ালা অত্যন্ত কনফিউজড চেহারা নিয়ে বললেন কোথায় যাবেন আপা? রুগ্ন শুকনা কালো লম্বা সহজ-সরল চেহারা ওনার, আমি রিকশায় ওঠে বসতেই সুন্দর করে হুট লাগিয়ে দিলেন।
উনার বয়স খুব বেশী হইলে ২২/২৩ হবে, বিচিত্র কিছু একটার প্রভাব তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে, সে ভাবছে এবং খুবই ধীরগতিতে রিকশা চালাচ্ছে।
এরকম পরিস্থিতিতে হঠাৎই পেছনে ফিরে বললো টাকা-পড়ে আছে আপা নিয়া নেই? চোখে মুখে শয়তানের হাসি।
যেদিকে দেখালো সেখানে দশ টাকার একটা নোট ভাঁজ করে পড়া, গান শুনার তালে তালে
একবার ভাবলাম বলি রাস্তায় পড়া টাকা নিতে হয় না, তারপর মনেহল ওতো গরীব, মাত্র ১০ টাকা, নিক না।
সামান্য দূর গিয়ে রিকশা থেকে রিকশাওয়ালা নেমে পড়লেন এবং এখান থেকেই সিরিয়াস নাটক শুরু হলো, ওয়েল এই সম্পর্কে আমি বলবো তারা অনেক কাঁচা অভিনেতা,তারা বললাম কারন অনুমান করছি তারা অনেকজন ছিলেন।
রিকশার চেইন পড়ে যাচ্ছে, বার বার পড়ে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সে মুখে কিছু বলেন নাই, আমি নিজে থেকে জিজ্ঞেস করেছি চেইন পড়ে যাচ্ছে কিনা, বার বার রিক্সার কিছু একটা ঠিক করা অবস্থায় ছিল যেহেতু।
সে কম্পিত হাতে কাজ করতে করতে অন্যথ এক রিকশাওয়ালাকে বলল যাবে কিনা, আমি বললাম কার জন্য রিকশা ঠিক কর? আমার জন্য? কেনো? তোমার রিকশা ঠিক হবেনা?? সে উত্তর না দিয়ে আবার তার রিকশা নিয়ে চলতে শুরু করলো এবং কিছুদূর গিয়ে আবার চেইন পড়ে গেল মনেহয়।
আমি গান শুনতে শুনতে আমার রিকশাওয়ালার ছেলটার ঠিক করে দেয়া অন্যর রিকশায় উঠলাম,গান তখনো শুনছি "কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে পলাশের মাস আমি বলি আমার সর্বনাশ।"
আশেপাশে লোক তেমন নেই, রিকশাও এই একটাই ছিল।
চলতে চলতে উনি থেমে গেলেন, কেনোনা আগেরজনকে কেনো অযথা টাকা দিছি তার রিকশায় তো যেতে পারি নাই।
আমি যতবারই তারে বলি আমি নিজে থেকে দিছি সে ততই আগেরজনরে খোঁজে, একটা বোঝাপড়া করতেই হবে।
আগেরদিন পেছনেই ছিলেন সেও রিকশাওয়ালার সাথে বোঝাপড়া করতে চায়,
কাজেই সে ঝগড়া করতে এসে কম্পিত হাতে সেই কুড়িয়ে পাওয়া ১০টাকার ভাঁজ খুলেন।
টাকার নিচে ছিল সাদা কাগজ, তার নীচে চিরকুট, সেখানে লেখা এক লাখ ৭০ হাজার টাকা মুল্যের সোনার বিস্কুট উনার অজানা পথচারীর বন্ধুর উদ্দেশ্যে উপহার দিয়েছেন, এবং উনার নাম মতিন চন্দ্র বাবু। (ভেতরে গোল্ডের বিস্কিট।
আমি ওটার ছবি তুলে ওকে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার স্বর্ণ নিয়ে চলে যাও রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করো না, যাও তো যাও।
সে গেলো না পেছনে পেছনে কখনো কখনো সাথে সাঠে আসতেই থাকলো, আমার রিকশাওয়ালা এই প্রসঙ্গে বললেন, আপনার উছিলায় পাইছে ওইটা তো আপনার জিনিষ, উনার কথা শুনবার জন্য কান থেকে হেড ফোন খুলে দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করি কি বলছেন, আমি কিংবা পুরান রিকশাওয়ালা কেউ বলিনাই টাকা ক্যামনে কখন পেয়েছে, কিন্তু অতি চালাক মাঝবয়সী এই প্রবীণ রিকশাওয়ালা জানেন সোনার বিস্কুট আমার উছিলায় পাইছেন।
উনার একেরপর এক লোভনীয় প্রস্তাব চলতেই থাকে, ১৫ হাজার টাকা হলে বিস্কিটটা নিয়ে নেন, কমপক্ষে তিন লাখ টাকা দাম হবে।
১০ হাজার টাকা হইলেই ও দিয়া দেবে।
আপনি না নিলে আমি নিয়া নেই, আমি আজকেই দশ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে তুলছি।
উনারা নিঃসন্দেহে টোপ গেলার জন্য ভুল মানুষকে পছন্দ করেছেন যে কিনা দুই লক্ষ টাকা দূরে থাক দুই কোটি টাকা ও পায়ে মাড়িয়ে চলে আসতে পারে, যার নিজের জীবন নিজের কাছে তুচ্ছ কিংবা যে নিজের জন্য একদিন ও বাঁচার আশা করে না কিন্তু অপরের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য শত বছর বাঁচার আশা করে।
এক পর্যায়ে আমি তার রিক্সা থেকে নেমে গেলাম, অনেক নাটক হয়েছে।
বোঝাই যাচ্ছে এটা সমঝোতার মাধ্যমে ছিনতাই করার নতুন কৌশল।কম দামে লক্ষ্ টাকার গোল্ড কেনার টোপে পা দিবেন না, সামনে ঈদ সবাই রাস্তাঘাঁটে সাবধানে চলাফেরা করবেন।
এটা দেখতে আর্টিফিশিয়াল গোল্ডের মতন। লোহার তালা হাতে নিলে যেমন ভারী লাগে, এটাকে তেমন ভারী লাগছিলো।ওটা ছিল লোহা অথবা তামার তৈরি।
একই রকম প্রতারনা নিয়ে নিউজঃ
চিঠি যখন ভয়ঙ্কর
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:০২