নিজেকে বোঝাটাই বোধহয় সবচেয়ে কঠিন । নিজের ভেতরে যে আরেকটা নিজ থাকে তার কাছে যাওয়াটাই মহা দুষ্কর ।অনেক দুর্গম তার পথ । চোখ বন্ধ করে ভাবলে হয়ত তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায় কিন্তু তার অবয়ব প্রত্যক্ষ করা সাধনার ফল । হয়ত সবাই পারেনা হয়ত অনেকেই পারে । সে অন্তরআত্না অনেক অস্থির, চঞ্চল আর বর্ণচোরা । তাকে বুঝিনি বলেই হয়ত আজ এত মাশুল ।
নিজের সম্বন্ধে কিছু লিখব ভাবছি । কিন্তু আমার কোন ভাল গল্প নেই তাই হয়ত কলম দিয়ে বেরুতে চায়না । উপক্রমণিকা পড়লে মনে হতে পারে আত্না-সত্বা নিয়ে অভিসন্দর্ভ লেখার প্রস্তুতি চলছে, তাই না ? আসলে সেরকম কিছু না । শুরু করার কিছু পাচ্ছিলাম না তাই আর কি ! আমি জীবনে কখনই ভাল কাজ করছি বলে মনে হয় না । মূল্যবোধ বা মূল্যায়ন কোনটাই আমার ভেতরে কখনই ছিল না । ভালবাসাকে মনোহারি দ্রব্যের চেয়ে বেশি কিছু ভাবিনি কখনো । চিত্ত প্রফুল্ল রাখার প্রবণতাই আজ আমাক প্রায়শ্চিত্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে ।
দেড় বছর আগের কথা , আমরা তখন রেলওয়ে কলোনির পেছনে থাকতাম । এলাকার বখাটেরা মিলে ঠিক করলাম পিকনিক করব, সাথে একটু ভালমন্দের ব্যবস্থা ও থাকবে ( পিকনিক না ছাই ভালমন্দ গেলাই ছিল মূল লক্ষ ) । সমস্যা দাঁড়াল টাকা , আমরা যা চাদা দেব তা দিয়ে ভাত-তরকারির বেশি কিছু হবে না । সুতরাং বাইরের থেকে টাকা না তুলে উপায় নেই । যথারীতি টাকা তুলতে নেমে পরলাম । তিনদিন পর দেখা গেল আমরা বেশ ভাল চাঁদাবাজি করতেই জানি । অ্যাচিভমেন্ট ইজ ওভার ফ্রম টারগেট ।
চাঁদা তোলার সময় যে একটা চমৎকার ভুল হয়ে গেছে তা বলতেই ভুলে গেছি । আমি নিচে দাঁড়ানো ছিলাম ওরা ওপরে টাকা চাইতে গিয়েছিল । নিচে এসে শোভন একটা চমৎকার বোকা মেয়ের বর্ণনা দিল ।
বলল, বস গেট রেডি টু প্লে ইট ।
ফোন নম্বর কই পাব ?
আমি জোগাড় করে দেব ।
তো মালটা কেমনরে ?
অনেক সিম্পল, খেইলা মজা পাবি ।
মেয়েটার নাম নিশু । রাতভর মাল খেয়ে টাল হয়ে নিশু নিশু বলে চিল্লিয়ে এলাকা ফাটালাম । দিনের বেলা স্বভাবমত যাচ্ছেতাই স্বপ্ন দেখলাম । সারাদিন ঘুমিয়ে সন্ধ্যেবেলা দাত ব্রাশ না করেই চলে গেলাম চা সিগ্রেটের নেশায় । চায়ে চুমুক দিতেই শোভন এসে আমার পাশে বসল,
ফোন করছিলি ?
কাকে ফোন করব ? আমি বিচলিত হয়ে জবাব দিলাম ।
পিনিক কাটতে না কাটতেই সব ভুইলা গেলি ?
মানে ?
মানে নিশু, তোমার আনরিলিজড ক-লি-জা ! খুবতো চিল্লাইছিলি ।
আইম সরি দোস্ত, আইম সরি , কই দে , ফোন নম্বর দে ।
আমার উৎফুল্লতা থামিয়ে দিতে ও আমাকে আমার মোবাইলের ইনবক্স দেখতে বলল ।
রাতে শুয়ে শুয়ে মেয়েটাকে ফোন দিলাম । পর পর দুবার বিপ হবার পর সে ফোন ধরল । অভিজ্ঞ বেড়ালের হাতে ইদুর পরলে যা হবার তাই হল । আমি ছদ্মনামে চালিয়ে গেলাম । কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের ভেতর বেশ ভাল একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল । একটু পর পর খোজ বার্তা, গভীর রাত পর্যন্ত গুটুর গুটুর , আর দেরি করে ঘুম থেকে ওঠাকে আমি ওর অভ্যেস করে দিলাম ।
নিশু আমার ছ্য় সাত বছরের ছোট হবে । অল্প কয়েক মাস হল সে ব্যক্তিগত ফোন ব্যবহার শুরু করছে । কলেজের গণ্ডি এখনও পার হয় নি । খুব সরল, আর আত্নকেন্দ্রিক, শুধু শুনতেই তার ভাল্লাগে , সহজে কিছু বলতে চায়না, আমি নাকি অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলি, তার সারাদিন শুনতে ইচ্ছে করে । নিশুর জগত বলতে তার মা-বাবা আর ছোট ভাই । একটু একটু করে সেই জগতের ভেতরে নিশুর অজান্তেই চলে যাচ্ছিলাম । সে বুঝতেও পারেনি কি এক পরিকল্পিত গহ্বর তাকে গিলে নিচ্ছে ।
যখন বুঝতে পারলাম সময় আমার হাতে চলে আসছে, এখন যা বলব তাই হবে তখন আর দেরি না করে নিশুকে বলে ফেললাম । নিশু কোন জবাব দিল না । কি এক অদ্ভুত কারনে অনেকক্ষণ কেদে ফোন রেখে দিল । ভোর রাতে একটা বার্তা পাঠাল,
" তাহলে এই ছিল তোমার উদ্দেশ্য
না , আমকে আর কখনো ফোন
দিবা না । আমি আমার বাবা-মাকে
কখনো কষ্ট দিতে পারব না । ভাল থেক ।"
আমিও একটা বার্তাতে লিখলাম,
"আমিতো তোমার বাবা-মাকে
কষ্ট দিতে বলিনি, তবে আমার
কথাও একবার ভাবা উচিৎ
ছিল । আমি সারাজীবন
তোমার অপেক্ষায় থাকবো ।
অনেক ভালবাসি তোমাকে"
আমি জানতাম ও পারবেনা । দুইদিন যেতে না যেতেই ফোন দিয়ে ব্যাপক আবেগের কথা শুরু করল । আমি চুপচাপ শুনছিলাম শুধু । ও বারবার কাঁদছিল আবার হাসছিল । একটা কিশোরীর প্রথম ভাললাগা , প্রথম স্বপ্ন , প্রথমবারের মতো কাউকে ভালবাসা যে আকাংখার সীমানা পেরিয়ে কতদূর যেতে পারে তা অনেক কাছ থেকে অনুভব করেও উপলব্ধি করতে পারিনি ।
সত্যি বলতে কি নিশুর সাথে আমার সম্পর্ক শুধু ফোনেই সীমাবদ্ধ ছিল । প্রথমবারেরমত আমরা একটা ফুচকার দোকানে দেখা করি । ও ফুচকা খুব পছন্দ করে । অবশ্য শুধু ও না বাঙালি মেয়ে বলতেই হয় আইস-ক্রিম নয় ফুচকা !
আমি সেদিন আকাশ ভেঙ্গে পরছিলাম অথবা আকাশই আমার উপর ভেঙ্গে পরছিল । সত্যিকারের জলপরী কেমন আমি তা জানি না কিন্তু নিশুকে দেখে আমার ভাষা হারানোর মত অবস্থা হয়েছিল । আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে একটা ছুঁচো বিড়ালের হাতে এমন বিলাতী ইদুর এসে জুটল । চোখ ফেরাতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল । সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল বিশ্বাস করতে, যে এটা স্বপ্ন না বাস্তব ! আমি অর্ডার দিচ্ছিনা দেখে নিশুই ফুচকার অর্ডার দিল । আমার নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
ফুচকার সবচেয়ে মজার উপাদান কোনটি, জান ?
আমি দাত বের করে শুধু মাথা নাড়লাম, কি বলব খুজে পাচ্ছিলাম না ।
ও বলল, টক পানি ।
আমি আবার মাথা নাড়লাম । তবে হ্যাঁ সুচক ।
নিশুর সৌন্দর্যে সেদিন ইদুর-বেড়ালের সমীকরণ বদলে গিয়েছিল । সেইদিন আমাকে পুরো চল্লিশ মিনিট সে বৃত্তের ভেতর আটকে রেখেছিল । কে জানতো সেই চল্লিশ মিনিট ই এক সময় অনন্ত কাল হয়ে ঘিরে রাখবে সীমাহীন বেদনায় ।
ধীরে ধীরে সম্পর্ক আরো গভিরে চলে যায় । ফোন থেকে মনে, মন থেকে শরীরে ছড়িয়ে পরে ভালবাসা । তার সমস্ত বিশ্বাস আর ভালবাসার উপযুক্ত প্রতিদান যে এমন হবে সে কখনো তা কল্পনা ও করেনি । আমি সম্পর্ক ঢিলেঢালা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । এক জিনিস কতদিন আর ভাল্লাগে ! আমার খেলা তো শেষ । নতুন ইদুরের সন্ধান করতে হবে যে ।
আমি নিশুর সাথে যথেষ্ট খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করলাম । ওকে মোটেও গুরুত্ব দিতাম না । যতভাবে এড়িয়ে চলা যায় তার সবই করাতাম । ও শুধু কাঁদত আর বলত " তুমি কেন এমন করতেছ আমার সাথে । প্লিজ এমন কোরো না, আমি সহ্য করতে পারিনা " । তবে ও আমাকে আবেগের ছলে কখনই আটকাত না । আমি আমার অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি চালিয়ে যেতাম ।
ও আমার কাছে একটা চরম বিরক্তিকর বস্তুতে রুপ নিল । ওর ঘ্যান ঘ্যান আর ভাললাগছিল না । তাই ওকে একদিন ফুচকার দোকানে ডেকে নিয়ে আসলাম । ও সেদিন খুব সাদাসিধে একটা পোষাকেই এসেছিল । ওকে ফুচকা খাওয়ার কথা বললাম, কিন্তু খেল না । দোকানের একেবারের পেছনের টেবিলে গিয়ে বসলাম কারন আজ সব সত্যি ওকে বলে দেব, এসব শুনে ও কান্নাকাটি করতে পারে, লোকজন দেখলে কি ভাববে, এই ভেবে পেছনে বসা । জানালার দিকে তাকিয়ে , পা দোলাতে দোলাতে আমি সব বলে দিলাম । খুব রিফ্রেশ লাগছিল নিজের কাছে । যাক ঝামেলাতো যাবে ।
আমি যেমনটা ভাবছিলাম তা হলনা । ও শুধু আমাকে একটা প্রশ্নই করছিল, " তার মানে তুমি আমাকে এখন আর ভালবাস না ?"
আমি মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম, না ।
ও মোটেও কাদেনি বরং নিজেই দু-প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়েছিল । আমি একবারই ওর চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম । অস্বাভাবিক গাঢ় লাল হয়েছিল চোখজোড়া ।
কয়েক পিস ফুচকা মুখে দিয়ে ও চলে গিয়েছিল । আমার বুকে কেমন যেন ধাক্কার মতো লাগল । আমি চুপচাপ কিছুক্ষন বসে রইলাম । কিছুই ভাবতে পারছিলাম না । কিছুক্ষন হাটাহাটি করে সন্ধ্যার সময়ই বাসায় চলে গেলাম । কেন যেন কিছুই ভাল্লাগছিল না । ব্যাপক আনমনে লাগছিল । রাতে কিছুই মুখে দিতে পারিনি । বুকের ভেতর প্রচণ্ড ওজন বোধ করছিলাম । বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত গভীর হয়ে গেল । বারবার শুধু নিশুর রক্ত রাঙ্গা চোখ সামনে চলে আসছিল । আমি বুঝতেই পারছিলাম না কেন এমন হচ্ছে । আমার চোখ বেয়ে বেয়ে পানি ঝরছিল । আমার আর বুঝতে বাকি রইল না, আমি নিজেই নিজের ফাদে আটকে গেছি । ভেবে রাখলাম কালই নিশুর সাথে দেখা করব । হাতজোর করে ক্ষমা চেয়ে নেব । বলব, শেষ সুযোগটা থেকে বঞ্চিত কোরোনা, আর কখনো তোমাকে কাদাবনা । প্রমিজ করছি ।
আমি কখনো ওদের বাসায় যাইনি । সেদিন সকালে ওদের বাসায় চলে গেলাম । ওদের বাসার সামনে গিয়েই দেখি পুলিশ । একটু কেমন যেন লাগল । একজন লোককে জিজ্ঞেস করতেই সে সব বলল । ওপর থেকে লাশ নিচে নামাতেই ভিড় বেড়ে গেল । আমি আমার ঘাতক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম । ফুটফুটে মুখ, নির্বাক চেহারা , গতকালকের সেই পোশাকই পড়া, শুধু চুলগুলো এলোমেলো , ঘাড়ের রগগুলো ফুলে শক্ত হয়ে আছে । এগুলো তো আমার চেয়ে বেশি কেউ ছোয়নি, আর কারো চোখে তো এই চোখ জোড়া পড়েনি, সেগুলো আজ বন্ধ, উষ্ণতা আজ অনেক দুরে । আমি নিশুর পৃথিবী ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিলাম । তার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকু অবশিষ্ট রাখিনি । নিশু এত কিছু সহ্য করতে পারেনি । তাই আমাকে চিরদিনের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত উপহারে সিক্ত করে চলে গেছে অনেক দুরে ।
আমি এখন একটা মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আছি, তৃতীয়বার এখানে । প্রায়শ্চিত্ত করছি (!) নিজেকে কষ্ট দিয়ে । জানিনা এটাকি প্রায়শ্চিত্ত নাকি ভাঁড়ামি হচ্ছে ? হয়তোবা এটা ভাঁড়ামিই । হয়তোবা কিছুদিন পর সব ভুলে যাব । হয়তো আবার কারো কাছ থেকে অন্য কোন মেয়ের খোজ নিয়ে নতুন এক্সপেরিমেন্ট শুরু করব । নিশু দ্বিতীয়বারের মতো হাড়িয়ে যাবে ঘাতকের হৃদয় থেকে ।
( বর্ণিত ঘটনা পুরোটাই গল্প )