এম সি এশারের 'ডে অ্যান্ড নাইট'
রঙ নেই। কমপিউটারের কারসাজিও নেই। থাকবে কী করে? কেন না, তখন যে কমপিউটার তৈরিই হয়নি। স্রেফ খাতা। আর হাতে রইল পেনসিল। আর তাতেই বাজিমাত। অসম্ভবও এখানে সম্ভব। এশারের ছবি।
সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে। জল ওপর থেকে নিচে নামে। সিঁড়ি দিয়ে হাঁটলে ওপরে উঠতে হয়। এগুলো তো ধ্রুব সত্য। উল্টোটা কি সম্ভব ? নাহ্। একেবারেই নয়।
কিন্ত্ত উল্টোটা যদি খাতায় আর পাতায় আঁকা হতে থাকে।
ধুর !
সেটা তো সম্ভবই নয়।
অসম্ভব!
কিন্ত্ত সেই কোনকালে , সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে গিয়েছেন একজন।
ম্যাজিশিয়ান নাকি ?
জাদু জানতেন ?
না। না। কোনওটাই নয়। স্রেফ আঁকতে পারতেন। আর কোনও কিছুই পারতেন না। পড়াশোনা ? বলার মতো রেজাল্ট কোনও দিনই করতে পারেননি। অনেকগুলো বিষয়ে তো রীতিমতো গাড্ডা। ওহ্ না। আরও একটা বিষয় শিখেছিলেন। কারপেন্ট্রি। কাঠের কাজ। ব্যস। কেল্লাফতে।
কীভাবে ? কী নাম ? কে তিনি ?
উত্তর একটাই। এম সি এশার ।
জন্ম ১৮৯৮ সালের ১৭ জুন। নেদারল্যান্ডস -এ। পুরো নাম মারিত্স কর্নেলিস এশার। বাবা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার , নাম জর্জ আরনল্ড এশার। আরনল্ড আর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সারা গ্লেইখমান এর কনিষ্ঠ পুত্র এম সি।
ছোটবেলা থেকে রুগ্ন। ত্বকের সংক্রমণে জেরবার। ১৯০৩ সালে এশার পরিবার লিউভার্দেন থেকে আর্নহেম -এ। সেখানেই স্কুলের চৌহদ্দিতে প্রবেশ এশারের।
কিন্ত্ত স্কুলে গেলে কী হবে ? ছোট্ট এশারের যে শরীর খারাপ। আজ ভালো তো , কাল খারাপ। পড়াশোনায় মন বসে না মোটে। সেকেন্ডারি স্কুল থেকে এম সি -কে সরিয়ে ভর্তি করানো হল স্পেশাল স্কুলে। তখন তার বয়স সাত। খুব একটা লাভ হল না। স্কুল থেকে বাড়িতে দিনের -পর-দিন যে রিপোর্ট আসতে থাকল , তা এম সি কিংবা পরিবারের কারোর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য উপযুক্ত নয়। কখনও সেকেন্ড গ্রেড। কখনও আবার থার্ড। অনেকগুলো বিষয়ে ফেল। ব্যতিক্রম একমাত্র ড্রইং ক্লাস। সেখানে এম সি এশার এক্কেবারে ‘নিউমেরো উনো ’। একনম্বর।
পড়াশোনায় একেবারে হাল না ছেড়ে দিলেও এশার এবার পছন্দের বিষয়গুলোয় মনোযোগ দিতে শুরু করলেন। কৈশোরে পা -দেওয়া এম সি এশার ভর্তি হল হারলেম স্কুল অফ আর্কিটেকচার অ্যান্ড ডেকোরেটিভ আর্টস -এ। আঁকার ক্লাসের পাশাপাশি চলতে থাকল কার্পেনট্রি শেখা এবং পিয়ানো ক্লাস। কেননা , সাদা পাতায় পেনসিল ড্রইং -এর পাশাপাশি এশারকে টানছিল উডকাট্ আর লিথোগ্রাফ। সম্ভব -এর সীমাকে ভেঙেচুরে অসম্ভবকে টেনে আনার চ্যালেঞ্জটা কুরে কুরে খাচ্ছিল তাকে। তাই ...
১৯২২। এশারের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর। নেদারল্যান্ডস -এর সীমানা ছেড়ে বাইরের দুনিয়ায় পা বাড়ালেন তিনি। প্রথম গন্তব্য ইতালি। সেখান থেকে স্পেন। দেখে ফেললেন মাদ্রিদ , তোলেদো , গ্রানাদা। স্পেনের কান্ট্রিসাইড মুগ্ধ করল এশারকে। বিশেষ করে গ্রানাদায় মুরদের প্রাচীন কাসলগুলোর কেল্লার প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি। পরে তাঁর ছবিতে মাঝেমধ্যেই বিষয়বস্ত্ত হিসেবে উঠে এসেছে এইসব কেল্লা। কেল্লার বাধানো সিলিং , ফ্রেমওয়ার্ক, বড় বড় থাম , দেওয়ালের গঠন এশারের মনে বড় ধরনের ছাপ ফেলে যায়। কাগজে -কলমে যখন অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন , তখন এগুলোর ডিজাইনকেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। একসময় ভ্রমণ সেরে আবার ইতালিতেই ফিরে আসেন তিনি। বিয়ে করেন। সংসার পাতেন। চলতে থাকে ছবি আঁকার কাজ।
কিন্ত্ত ইতালিতেও একসময় ছন্দপতন। সালটা ১৯৩৫। মুসোলিনির শাসনকালে দেশজুড়ে তীব্র অস্থিরতা। আকাশে -বাতাসে বারুদগন্ধ। বড় ছেলে জর্জকে যখন মাত্র ৯ বছর বয়সে চড়ানো হল ফৌজি উর্দি, তখন ইতালি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন এশার। এরপর পরিবার নিয়ে এশার চলে যান সুইত্জারল্যান্ডে।
ঘর থেকে ঠাঁইনাড়া এশার এই সময় কোনও জায়গাতেই থিতু হতে পারেননি। সুইত্জারল্যান্ড থেকে তাঁরা একসময় চলে যান বেলজিয়ামের ব্রাসেলস -এ। বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘরছাড়া হয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না এশারের। একসময় আবার ফিরে আসেন নেদারল্যান্ডস্-এ। লারেন শহরে তৈরি করেন নিজের স্টুডিও।
এম সি এশারের মৃত্যু ১৯৭২ সালের ২৭ মার্চ। ৭৩ বছর বয়সে।
ওয়াটারফল
এশারের আরেক অসম্ভবের লিথোগ্রাফ। প্রথম প্রিন্ট ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে। পুরোটাই প্যারাডক্স। জলপ্রপাতের জল পড়ছে ওপর থেকে। সেটা তো স্বাভাবিক৷ কিন্ত্ত ওপর থেকে পড়া সেই জলই আবার উঠে যাচ্চে নিচ থেকে ওপরে। উচ্চতা কিংবা তল, একেবারে ঘেঁটেগুলে একসা। এটা গবেষকদের পছন্দের ছবি। মাথা ঘামানোর বিষয়।
ড্রইং হ্যান্ডস্
এশারের কথা বললেই ইঠে আসে এই ছবির উদাহারণ। এটা একটা লিথোগ্রাফ। প্রথম প্রিন্ট ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে। ছবিতে দেখা যচ্ছে একটা কাগজের দু'টো হাত এঁকে চলেছে। এঁকে চলেছে পরস্পরকে। সেটা কীভাবে সম্ভব? উত্তর নেই। অসম্ভব। অসম্ভবের ছবি সেজন্যই।
রিলেটিভিটি
এম সি এশারের বিখ্যাত লিথোগ্রাফ। প্রথম প্রিন্ট ১৯৫৩ সালে। নাম রিলেটিভিটি, কিন্তু এ -ছবিতে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণের টান এবং তত্ত্ব। দ্বিমাত্রিক ছবিতে ত্রি -মাত্রিক পারস্পেকটিভ। একই রকমের, ভাবলেশহীন চরিত্ররা সিঁড়ি দিয়ে হাঁটছে। কিন্তু কে কোন দিকে যাচ্ছে, উপরে উঠছে না, নিচে। দেখে বোঝার উপায় নেই। সিঁড়ির বাইরে আবার বাগান কিংবা পার্কের মতো জায়গাও দেখা যাচ্ছে। সেখানে কয়েকজন বসে আছে। শুধু শিল্পের দিক থেকে নয়, বিজ্ঞানীদের কাছেও ছবিটি দীর্ঘদিনের গবেষণার বিষয়।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৯