somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রূপের ডালি খেলা - (আমার সোভিয়েত শৈশব )

৩০ শে জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



তখন আমরা ভাবতাম যে কারাভান্নায়া রাস্তায় নিশ্চয় ঠুন- ঠুন ঘন্টি বাজিয়ে যায় ক্লান্ত ধূসর উট , ইতালিয়ানাস্কায়া রাস্তায় ইহাকে কালো-চুল ইতালিয়ানরা , আর চুমকুড়ি সাঁকোতে সবাই চুমু খায়। পরে মিলিয়ে গেছে ক্যারাভান আর ইতালিয়ানরা, রাস্তাগুলোর নাম পর্যন্ত এখন অন্য। অবিশ্যি চুমকুড়ি সাঁকোর নামটা এখনো তাই আছে।
আমাদের পাড়ার আঙিনাটা ছিল পাথরের খোয়ায় বাঁধানো। খাওয়া পড়েছিল সমান ভাবে নয়, কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। জোর বৃষ্টি হলে নিচু জায়গাগুলো জলে ভোরে যেত, উঁচু গুলো থাকতো পাথুরে দ্বীপের মতো। জুতো যাতে না ভেজে তার জন্যে আমরা দ্বীপ থেকে দ্বীপে লাফিয়ে লাফিয়ে আসতাম। তাহলে বাড়ি পৌঁছতাম ভেজা পায়েই।

বসন্তের আঙিনাটা ভোরে উঠতো পপলারের ঝাঁঝালো রাজনের গন্ধে , শরতে আপেল। আপিলের গন্ধটা আসতো মাটির টোলের কুঠুরি থেকে , সবজি জমা থাকতো সেখানে। আঙিনাটা আমরা ভারী ভালোবাসতাম। কখনোই একঘেয়ে লাগতো না। এছাড়া অনেক খেলা জানতাম আমরা। খেলতাম লুকোচুরি , ডাংগুলি,বল ছোড়াছুড়ি, ভাঙা টেলিফোন।এসব খেলা আমরা পেয়েছিলাম একটু বড়ো ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে। কিন্তু আমাদের নিজেদের বানানো খেলাও ছিল। যেমন রূপের ডালি খেলা
কার মাথা থেকে এটা বেরিয়েছিল জানি না, তবে আমাদের বেশ মনে ধরেছিলো। পুরোনো পপলার গাছের দলটা জুটলেই নির্ঘাৎ কেউ না কেউ বলে উঠত :
" আয় রূপের ডালি খেলি !"
সবাই দাঁড়াতাম গোল হয়ে , ছড়া বলে পর পর গুনে যেতাম কে মাঝখানে দাঁড়াবে :
' এনা, বেনা , রেস...'
কোনো এক দুর্বোধ্য ভাষার এই কথা গুলো ছিল আমাদের ঠোঁটস্থ :
‘কুইন্তের , কন্তের , জেস!’

কেন জানি আমার সাত নাম্বার ফ্ল্যাটের নিনকাকে মাঝখানে দাঁড় করতে ভালো বাসতাম , চেষ্টা করতাম ছড়াটা গিয়ে ঠিক ওর কাছেই শেষ হয়। চোখ নামিয়ে সে তার ফ্রকে হাত বুলাতো। আগে থেকেই তার জানা থাকতো যে তাকেই মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতে হবে রূপসী হয়ে।
এখন আমরা বুঝি যে সাত নম্বর ফ্ল্যাটের নিনকা ছিল অসাধারণ অসুন্দর:
চওড়া খাঁদা নাক ছিল তার, মোটা মোটা ঠোঁট, তার চারিপাশে আর কপালে রুটির গুঁড়োর মতো ছুলি। বিবর্ণ চোখ। সোজা সোজা অঘোম চুল। হাঁটতো পা ঘষে ঘষে , পেটটা সামনে এগিয়ে দিয়ে। কিন্তু এসব আমাদের চোখে পড়তো না। যে ন্যায়পর অজ্ঞতায় আমরা তখন ছিলাম তাতে ভালো মানুষকে ধরা হতো সুন্দর আর খারাপ কে অসুন্দর !

আর সাত নাম্বার ফ্ল্যাটের নিনকা ছিল গুণী মেয়ে , তাকেই আমরা সুন্দরী করতাম।
মাঝখানে গিয়ে ও দাঁড়ালেই খেলার নিয়ম অনুসারে আমাদের 'মুগ্ধ' হতে হত ---
প্রত্যেকেই আমরা প্রশংসা করতাম বইয়ে পড়া কোনো না কোনো কথা দিয়ে।
কেউ বলতো :
'কী সুন্দর গলা , রাজহাঁসের মতো।
' রাজহাঁসের মতো নয় , মোরাল গ্রীবা,' সংশোধন করে দিয়ে আরেকজন খেই টানত,
'কী সুন্দর প্রবালের মতো ঠোঁট ...'
' কী সুন্দর সোনালী চাঁচর। '
' চোখ ওর ইয়ে ... ইয়ে....'
' কেবলি তুই ভুলে যাস ! সাগরের মতো নীল। '

জ্বল জ্বল করে উঠতো নিনকা। ফ্যাকাশে মুখে গাঢ় লাল ছোপ। পেটটা গুটিয়ে নিয়ে সে লীলাময়ীর মতো একটা পা এগিয়ে দিতো। আমাদের কথা গুলো হয়ে উঠতো আয়না, নিনকা তাতে নিজেকে দেখতো সত্যিকারের রূপসী !
' কী সুন্দর চিকন গা। '
'কী সুন্দর বাঁকা ভুরু। '
' ওর দাঁত.... দাঁত....'
'জানিস না ? মুক্তোর মতো দাঁত!'
আমাদের মনে হতে থাকতো সবকিছুই ওর মোরাল, প্রবল, মুক্তোর মতো। আমাদের নিনকার চেয়ে রূপসী আর কেউ নেই।
তারপর আমাদের উচ্ছ্বাসের ঝুলি ফুরিয়ে গেলে নিনকা কিছু একটা গল্প শোনাতো। হেমন্তের ঠান্ডা বাতাসে গা কুঁকড়ে সে বলতো :
'কাল আমি ভাই চান করেছিলাম গরম সাগরে। বেশ রাট হতেই অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে উঠলো সাগর। আমিও জ্বলজ্বল করে উঠলাম। আমি ছিলাম একটা মাছ হয়ে .... না, মাছ নয় , মৎস্য-কন্যা।'

রূপসীরা কি কখনো বলা সাজে যে সে আলুর খোসা ছাড়িয়েছে , অথবা পড়া মুখস্থ করেছে , কিংবা কাপড় কাচতে সাহায্য করেছে মাকে।



'কাছেই হুটুপুটি করছিলো সব ডলফিন। তারাও জ্বল জ্বল করে উঠলো। '
এই সময় কেউ হয়তো আর চুপ করে থাকতে পারতো না। বলতো :
'যা: বাজে কথা ! '
হাত বাড়িয়ে দিতো নিনকা। 'বেশ , শুকে দ্যাখ। গন্ধ পাচ্ছিস ?'
'সাবানের গন্ধ। '
মাথা নাড়তো নিনকা :
' উঁহু, সাগরের গন্ধ! চেটে দ্যাখ হাত -- নোনতা নোনতা। '
চারিপাশে ঘোলাটে স্যাঁতস্যাঁতে অবশ্য, বোঝা যায় না বৃষ্টি হচ্ছে কিনা। শুধু শার্সিতে জাগছে আর ফেটে যাচ্ছে বুদ্বুদ। কিন্তু সবাই আমরা টের পেতাম না - থাকা সমুদ্রটা আছে কাছেই --- উষ্ণ , জ্বল জ্বলে , নোনা।

এই ভাবেই খেলতাম আমরা।
বৃষ্টি নামলে জুটতাম ফটকের তোলে , অন্ধকার হয়ে গেলে ভিড়তাম ল্যাম্পপোস্টের কাছে। এমনকি কড়া শীতেও আমাদের হটাতে পড়তোনা আঙিনা থেকে।

একবার নতুন বাসিন্দা এলো পাড়ায়। আঙিনায় দেখা দিলো নতুন একটি ছেলে।
ঢ্যাঙামতো , হাঁটতো একটু কুঁজো হয়ে , যেন দেখতে চাইতো যে তত ঢ্যাঙা নয়।গালে তার একটা বড়ো লম্বাটে তিল, সেটার জন্যে লজ্জা হতো তার , কথা বলার সময় অন্য গালটা ফিরিয়ে রাখতো আমাদের দিকে। নাকটা তরতর , একেবারে মেয়েলি বড়ো বড়ো চোখের রোঁয়া। চোখের রোঁয়ার জিন্যেও সংকোচ ছিল তার।
আমাদের থেকে দূরে দূরে থাকতো নতুন ছেলেটা। আমরা ওকে রূপের ডালি খেলতে ডাকি। জানতো না খেলাটা কি , রাজি হয়ে যায়। চোখ চাওয়া চাওয়ি করে আমরা ঠিক করে নিলাম রূপসী করবো .... ওকেই। মোরাল গ্রীবা আর প্রবাল ঠোঁটের কথা বলে না বলেই ও ভয়ামক লাল হয়ে পালিয়ে গেল খেলা ছেড়ে।

হেসে উঠে আমরা চেঁচালাম :
'তোকে ছাড়াই আমরা খেলবো !'
কিন্তু ফের যখন গোল হয়ে দাঁড়ালাম , হঠাৎ নিনকা পেছিয়ে এলো :





















চলবে ....



আমার কথা :
কারো না কারো কোথাও এই বইটি মনে হয় কারো কাছে এখনো অমলিন।
খুব ছোট্টবেলার শৈশব টা আঁকড়ে ধরে পরে আছি। আমার সোভিয়েত শৈশব।
সাহস করে লেখাটা এগিয়ে নেবো। অমলিন ভালোবাসা ছড়িয়ে যাক।
আস্তে আস্তে আপডেড আসবে।

রূপের ডালি খেলা - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×