২০১০ সাল।
কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানির (কাফকো) আবাসিক কলোনি নির্মাণে আমি কনসালটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। চট্টগ্রামের আনোয়ারার এই এলাকাটির ভূপ্রকৃতি দারুণ বৈচিত্রে সমৃদ্ধ। যেমন টিলাময় তেমনি এখানে আছে সাগরসঙ্গমরতা কর্ণফুলীর মোহনা অথবা ঔপনিবেশিক স্মৃতি-ছায়া বিজড়িত প্রাচীন জনপদ। আমরা প্রায়ই সিইউএফএল জেটিতে বসে, (যেখানে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র খালাস করা হয়েছিলো) কর্ণফুলীর সান্ধ্য হাওয়া খেয়ে খেয়ে আর সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে সারাদিনের কর্মক্লান্তির রেশ ধুয়ে মুছে নিতাম। আর খানিক বাদেই অগুনতি জাহাজের বিষণ্ণ বাতিতে মোহনাঞ্চল যেন এক মায়ার শহরে রূপ নিতো। মন ভেসে যেতো শত বর্ষ আগে নোঙ্গর করা কোন বণিকের টিমটিমে বাতিজ্বলা কিস্তি ও তার কেতনে। নিবিড় নীরবতা নেমে আসতো আমার অস্তিত্বে!
এক ছুটির দিনে আমরা কোরিয়ান ইপিজেডের অধিগ্রহণ করা লালরঙা বিস্তীর্ণ টিলাময় বনাঞ্চল ঘুরে দেখতে বের হই। বুনো পরিবেশে শেয়াল,বনবিড়াল আর বেজী ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের দেখা পাই। দুপুর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে ঘন এক শাল-আকাশিয়া বনের ছায়াতলে বিশ্রামের জন্য বসেছি। আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। এমন সময় বাইনোকুলারের দৃষ্টিসীমায় দৃশ্যমান হয় এক অপরূপ নীলাভ জলাধার। দু’চোখ ভরে তার সৌন্দর্য অবলোকন শেষে পরিশ্রম সার্থক মনে হয়। মনের আয়নায় ভেসে ওঠে “আরণ্যকের” সেই নেশা ধরানো গহীন-শ্বাপদ বনাঞ্চল আর তার সরোবরের ছবি। সুখের আবেশ-নীরবতা ভর করে আমার অস্তিত্বে!
কিন্তু ঘড়ির কাঁটা কখনো থেমে থাকে না। ক্যালেন্ডারের ধুলো মাখা পাতারা লুকায় নতুন পাতার নীচে। পরিযায়ী সুখেরাও কখন উড়াল দেয় অগভীর জীবন জলাধার হতে। একবার খুব কাছের একজন মানুষ খুব কষ্ট দিয়ে আমার জীবনটাকে নীরবতার নদীতে ভাসিয়ে দেয়। তাই নীরবতার নেপথ্য গল্পগুলোও সবসময় সুখের হয়না। সে ইতিহাস কখনও হয় হতাশার, কখনও প্রহসনের কিংবা প্রবঞ্চনার। পরিবার-ক্যারিয়ার কিংবা সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে আমিও যখন অন্য দশজন তরুণ-তরুণীর ন্যায় নীরব আর বিমর্ষ এমনি এক বিপন্ন সময়ে নীরবতার অতলস্পর্শী মর্ম নিয়ে আসেন একজন মানুষ।
তিনি ডঃ শাহাদুজ্জামান। (প্রিয় কথাসাহিত্যিক)। দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় (২-১২-২০১০) তারিখে তার "নীরবতা" বিষয়ক লেখা পড়ে আলোড়িত-অভিভূত হয় আমার আহত হৃদয়। এ যেন একটি শব্দের ছায়াতলে জীবনের মানে অথবা বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাওয়া। তিনি যেমন বলেছেনঃ “আমাদের সবার জীবনেই টুকরো টুকরো নীরবতার বহু মুহূর্ত আছে, যা আমাদের কাছে মূল্যবান। আছে কখনো স্বেচ্ছা নীরবতা, আছে কখনো অপারগ নীরবতা”। কিংবা "কারও জীবনে এমন এক মুহূর্ত উপস্থিত হয়, যখন নীরবতা একটি ভারী পর্দার মতো পৃথক করে রাখে পরস্পরকে"।
তাই নীরবতা কখনও আনন্দের আবার কখনও বেদনার নীলগিরিতে তার গোপন বসবাস। কবি রফিক আজাদ যেভাবে অপেক্ষার নদীকে প্রতীক্ষার সাগরে এনে মিলিত করেছেন, প্রিয় লেখক শাহাদুজ্জামানও তেমনি বিষণ্ণতার বাথান হতে নীরবতার সবুজ সম্ভাবনা জাগিয়ে রেখে চির অম্লান হয়ে থাকবেন আমাদের মন মণিকোঠায়।
ফটো কার্টেসিঃ প্রথম ছবিটি নেট থেকে নেয়া। অনেক ছবি ছিল, হারিয়েছি। ২ ও ৩ নং টা অবশ্য আমার হাতেই তোলা।
উৎসর্গ এবং কৃতজ্ঞতাঃ ডঃ শাহাদুজ্জামান ও তার সহধর্মিণী পাপড়ীন নাহার ।
২১/০৪/২০১৬, মিরপুর- ঢাকা ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ রাত ১২:১২