মূল ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে, ছোট ছোট কিছু ঘটনা বলি।
খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আই.ইউ.বি-তে তখন নতুন জয়েন করেছি । তখনও মাস্টার্স-এর সার্টিফিকেট, ট্রান্সক্রিপ্ট তোলা হয়নি, অফিস থেকে জানানো হল, চাকরীর সুবাদে সার্টিফিকেট জমা দিতে। সার্টিফিকেট তোলা হল, এখন ফটোকপির পালা, অফিসে কাগজ আর প্রিন্টার-এর অভাব নাই, তার পরেও ছুটে গেলাম, আই.ইউ.বি-র একমাত্র ষ্টেশনারী ‘জলিল মামা’-র দোকানে। জলিল মামা বুঝেনই আমি এখন আর এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী নই শিক্ষক, আমিও আর কথা ভাঙলাম না, ফটোকপি করা পাতা গুলো অফিসে জমা দিলাম। অনেকেই হইত ভাবছেন অফিসের চেয়ারে বসে হাউস-কিপার-কে বললেই তো ফটোকপি হাজির হয়ে যেতো, ছাত্রী সেজে, পকেটের পয়সা খরচ করে, আবার জ্বলিল মামার দোকানে কেন???
তার কিছু দিন পর ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষা নিলাম। পরীক্ষা শেষে বেঁচে গেলো কিছু খালি কাগজ, গুনে গুনে ফেরত দিলাম হউস-কিপার-এর হাতে। হউস-কিপার খানিক আশ্চর্য হয়ে কাগজ গুলো নিলো। এক সেমিস্টার-এ ফাইনাল পরীক্ষার পর কাগজ ফেরত দিতে ভুলে গেলাম, ইতি মধ্যে ইউনিভার্সিটি বন্ধ, খুব সাবধানে কাগজ গুলি গুছিয়ে রাখলাম এবং পরের সেমিস্টারে ব্যাবহার করলাম।
গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার বাসা বদলের ঝামেলা পোহাতে হলও, সেই সাথে জিনিষ গুছিয়ে গুছিয়ে কার্টুনে ভরারা ঝামেলা। গুছানোর পর মার্কার দিয়ে ট্যাগ না করলে তো সর্বনাশ!!! সেই মোক্ষম সময়ে জানা গেলো ঘরে কিনে আনা মার্কার গুলো শেষ। মুহতারাম বললেন, ‘তোমার কাছে মার্কার নাই?’, বললাম, ‘নাই’,
কলমের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে মার্কার!!!!’
আমি বললাম, ‘এটা আই.ইউ.বি-র মার্কার, আমি আমার কোন প্রকারের ব্যক্তিগত কাজে এই মার্কার ব্যাবহার করিনা, সেটা যদি একটা আচরও হয় তাও। তাই এটা দেওয়া যাবে না।’
মার্কারের গল্প কিন্তু এখানেই শেষ না, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর, মার্কার এর হিসাব হয়ে যায় আরও জটিল। কারণ দিন শেষে হিসেবের খাতায় লিখে রাখতে হয়, ‘ আই.ইউ.বি-র কাছে জা.বি একটা মার্কার পায়, গত মাসে জা.বি-র একটা মার্কার আই.ইউ.বি-র কাজে ব্যাবহার করেছিলাম কিনা!!!!!’
আমি মোবাইল ডেটা ব্যবহার করি না, তাই বাহিরে গেলে আমি অফলাইন, তাই কোন কারণে যদি ব্যক্তিগত কাজে ইন্টারনেটের প্রয়োজন হয়, অফিসে জিজ্ঞাস করি, ‘ইন্টারনেট ব্যাবহার করা যাবে?’
এবার আসি অফিসের বাইরে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে। সাময়িক কারণে একবার এক পরিবারের আর্থিক হিসাব নিকাশের দায়িত্ব দেওয়া হলও, দিন শেষে আকাউন্টিঙ্গের ব্যালেন্স শিটের মতো হিসাব মিলাতাম। পরিশেষে এক জমজমাট দাওয়াতের আসরে, সকলের সামনে শুনতে হল, ‘ওর তো পাঁচ টাকা দশ টাকা হিসাবের অভ্যাস আসে, আমি আবার এত হিসাব করতে পারি না বাবা!!!’ বয়স তখন অপেক্ষাকৃত কম ছিলও তাই কেমন যেন শিউড়ে উঠেছিলাম, উত্তর দেওয়ারও সুযোগ পাইনি।
আমি খুব হিসাবী মানুষ, অনেকে আমাকে কিপটা না বলতে পেরে ভদ্র ভাষায় বলেন ‘হিসাবী’। আমি, পাঁচ টাকা দশ টাকার না, চার আনা আট আনার-ও হিসাব করি, যদি সেটা হয়ে থাকে অন্যের আমানত। নিজের সম্পদ থেকে কতটুকু হিসাব করি আর কতটুকু সাত আসমানের উপরের ব্যাংক-এ জমাই, সেই হিসাবটা না হয় ডান কাঁধেই থাক, তাও খাতা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে নাকি কবুল করা হবে, সেটাও সাত আসমানের উপরের মালিক-ই জানেন।
এত গুলো ঘটনার মূল ব্যাখ্যা হচ্ছে একটি বাস্তব কাহিনী, যেটা আমি স্কুল জীবনে পড়ে খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম।
হযরত ওমর (রাঃ), তার দুই আত্নীয় ও মোমবাতি—-
মোমের আলোয় কাজ করছিলেন খলিফা উমর রাযিআল্লাহু আনহু । এমন সময় সেখানে আসলেন তার দুই আত্মীয় । খলিফা তাড়াতাড়ি ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন । অন্য আরেকটি মোমবাতি ধরিয়ে অতিথিদের বসতে দিয়ে তাদের খোঁজখবর নিলেন । কৌতূহল চাপতে না পেরে একজন জানতে চাইলেন , আমাদের দেখে কেন আপনি আগের মোমবাতি নেভালেন আর নতুন একটি জ্বালালেন ? খলিফা জবাব দিলেন : আগের মোমবাতি ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি থেকে কেনা । তোমরা যেহেতু আমার আত্মীয় , তাই তোমাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত অনেক আলাপ হবে । আমার নিজের কাজে জনগণের আমানত থেকে আমি কিছু খরচ করতে পারি না । তাহলে আল্লাহর দরবারে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে । তাই নিজের টাকায় কেনা মোমবাতিটি তোমাদের দেখে জ্বালালাম । এই জবাবে আত্মীয়রা হতভম্ব হলেন । তারা এসেছিলেন আত্মীয়তার খাতিরে বিশেষ কোন সুবিধা পাওয়া যায় কি না , সেই অনুরোধ করতে । কিন্তু সামান্য মোমবাতি নিয়ে খলিফার এত বিবেচনা ও সতর্কতা দেখে নিজেদের প্রস্তাব জানাতে তারা আর সাহসই করলেন না । আরেকবার খলিফার কাছে এক লোক অবৈধ সুবিধা চায় । খলিফার সামনে রাখা কিছু কাঠে তখন আগুন জ্বলছিল। খলিফা বললেন , ঠিক আছে । তুমি এই আগুনের ভিতর তোমার হাত কিছু সময়ের জন্য রাখো ; তারপর তোমার অনুরোধ আমি বিবেচনা করবো । লোকটি ভয় পেয়ে বললো , হে খলিফা ; এই আগুনে হাত ঢুকালে আমার হাত তো জ্বলে যাবে । খলিফা বললেন , তুমি দুনিয়ার এই সামান্য আগুনকে ভয় পাচ্ছ অথচ আমাকে তুমি দোযখের অনন্ত আগুনের ভিতরে নিয়ে যেতে চাও ? তদবিরকারী নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে যায়।
(http://imam.gov.bd/node/3662)
সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি এই আদর্শে প্রভাবিত হতো, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের মানুষ গুলি বেকার হয়ে বসে থাকতো, কারণ দুর্নীতি দমন কমিশন থাকার-ই হয়ত আর প্রয়োজন হতো না, আর দাদার আমল থেকে এই প্রবাদ শুনতে হতনা, ‘সারকারি মাল দারিয়া মে ঢাল’।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৮ ভোর ৪:৩৪