অামাদের দেশের রক বা ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাস বোধহয় আমরা সবাই কমবেশি জানি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে শ্রদ্ধেয় আযম খান আর তাঁর ব্যান্ড উচ্চারণের হাত ধরে এদেশে পপ মিউজিক প্রবেশ করে। পরবর্তীতে তাঁর সাথে ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজ আর ফিরোজ সাঁই যোগ দেন। তাঁরা মূলত পপ মিউজিক-কে সাধারন মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলেন। আরও পরে কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, সুব্রত বড়ুয়া, নাসিম আলি খান সহ চট্টগ্রামের কিছু তরুণ সোলস গঠন করেন। তাঁদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে চট্টগ্রামেরই নকীব, পিলু, বগি, রেজা প্রমুখ রেনেসাঁ গঠন করেন। শুরুর দিকে বেশ কয়েক বছর ব্যান্ডগুলোর কার্যক্রম চট্টগ্রামভিত্তিক ছিলো। এই সময় হোটেল আগ্রাবাদে নিয়মিত লাইভ কনসার্ট হতো যেখানে ব্যান্ডগুলো মূলত ইংরেজি ব্যান্ডের গান পরিবেশন করতো।
রক মিউজিকের এই জোয়ার বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মেধাবী তরুণ মাকসুদ বন্ধু ফোয়াদ নাসের বাবু, খোকা, পিয়ারু, সেলিম হায়দার আর রোমেলকে নিয়ে ফিডব্যাক গঠন করেন। প্রথমদিকে শেরাটন (তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) বলরুমে ইংরেজি গান পরিবেশন করলেও পরবর্তীতে মাকসুদের উদ্যোগে তারা বাংলা মৌলিক গান করা শুরু করেন। ফিডব্যাকের পাশাপাশি কামাল, ফরিদ, পাবলো প্রমুখ অন্যান্য বন্ধুদের সাথে বারোক গঠন করেন। পরবর্তীতে কামাল আর ফরিদ উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ পাড়ি জমালে তাদের জায়গায় প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের দুই ছেলে শাফিন আর হামিন যোগ দেন, সেই সাথে ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে আগলি ফেইসেস রাখা হয়। পরে কিবোর্ডিস্ট মানাম যোগ দিলে আরও একবার ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে মাইলস রাখা হয়। মাইলসের প্রকাশিত প্রথম অ্যালবামে সব ইংরেজি গান ছিলো।
আশির দশকের শুরুর দিকে নওগাঁর তরুণ জেমস রক মিউজিশিয়ান হবার স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথমে আগ্রাবাদ হোটেল, পরবর্তীতে চট্টগামের আজিজ বোর্ডিংয়ে বসবাস শুর করেন। পরে স্থানীয় তরুণ ফান্টি আর স্বপনের সাথে পরিচয়ের সুবাদে তারা তিনজন মিলে ফিলিংস গঠন করেন। একই সময় চাটগাঁয়ের ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে আইয়ুব বাচ্চু গিটারিস্ট হিসেবে সোলসে যোগ দেন। ১০ বছর বাজানোর পর সোলস ছেড়ে ফিলিংস ছেড়ে আসা স্বপন, টুটুল (জনপ্রিয় শিল্পী এসআই টুটুল) অার জয়-কে নিয়ে বাচ্চু এলআরবি (লিটল রিভার ব্যান্ড) গঠন করেন। কিন্তু একই নামে অস্ট্রেলিয়ায় একটি ব্যান্ড থাকায় পরবর্তীতে ব্যান্ডটি লাভ রানস ব্লাইন্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ওদিকে দুনিয়া কাঁপানো ব্রিটিশ হেভি মেটাল ব্যান্ড আয়রন মেইডেন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকার অপেক্ষাকৃত কম বয়সী কয়েকজন তরুণ - আরশাদ, শোয়েব, ইমরান, মাহবুব আর মাঈনুল মেটাল ব্যান্ড রকস্ট্রাটা গঠন করেন। প্রথমদিকে শুধু আয়রন মেইডেনের গান কভার করলেও পরবর্তীতে মাকসুদের পরামর্শে তারা বাংলা গান করা শুরু করেন। সেই পথ ধরে ১৯৮৬ সালে রকস্ট্রাটা তাদের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ করে যা একই সাথে বাংলাদেশের প্রথম হেভি মেটাল অ্যালবাম ছিলো। আর্তনাদ, রক্তে ভেজা মাটি, কালো রাত, নিউক্লিয়ার স্বাধীনতা গানগুলো দেশের মেটালভক্ত তরুণদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। রকস্ট্রাটা দ্বারা ভীষনভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁদেরই অনুজ বাবনা, কমল, টিপু, রাসেল আর সানজয় ওয়ারফেজ গঠন করে। তাঁদের প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম জনপ্রিয়তার বিচারে রকস্ট্রাটা-কেও পেছনে ফেলেছিলো। ওয়ারফেজ শিরোনামের অ্যালবামটি বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম ডেব্যু অ্যালবামগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সময়ের সাথে ব্যান্ড মিউজিক জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলো। সেই সাথে বাড়ছিলো ব্যান্ডের সংখ্যা। ১৯৮৫ সালে রেনেসাঁর বগি বন্ধু মাকসুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় ব্যান্ডগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশ অ্যামেচার মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে বামবা নামে একটি সংগঠন করার পরিকল্পনা করেন। পরে অবশ্য অ্যামেচার শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। বগিসহ অন্যদের অনুরোধে মাকসুদকে সভাপতি করে ১৯৮৭ সালে বামবা যাত্রা শুরু করে।
নবগঠিত বামবা'র প্রথম পদক্ষেপ ছিলো ১৯৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সাহায্যার্থে 'ফ্লাড এইড, ৮৭' নামক কনসার্ট আয়োজন। মাকসুদের বন্ধু ব্রিটেনপ্রবাসী বাংলাদেশি দুই বোন রেবেকা আর নাওমি সেই সময় দেশে বেড়াতে এসেছিলেন। তাদের মধ্যস্থতায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বলরুমে ফিডব্যাক, সোলস, রেনেসাঁ আর মাইলসের অংশগ্রহণে কনসার্টটি সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান থেকে অর্জিত অর্থ বামবা'র পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির রিলিফ ফান্ডে দান করা হয়। স্থানীয় পত্রিকাগুলো খবরটা আগ্রহের সাথে প্রকাশ করে।
১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ - এই দুই বছরে বামবা বেশ কয়েকটি চ্যারিটি কনসার্টের আয়োজন করে অার সেগুলো থেকে অর্জিত অর্থ ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যার্থে দান করে। এর ফলে সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সংগঠনটির অবদান বিভিন্ন মহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। পাশাপাশি, শুরু থেকেই ব্যান্ড মিউজিককে 'অপসংস্কৃতি' হিসেবে দাবি করে আসা একটি গোষ্ঠীর জন্য এসব আয়োজন ছিলো উপযুক্ত জবাব।
১৯৯০ সালে দেশব্যাপী উত্তাল স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের কারণে বছর জুড়ে বামবার সকল কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়। অবশেষে ১০ ডিসেম্বর স্বৈরাচার শাষক এরশাদ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হন। তার তিন দিন পর, ১৩ ডিসেম্বরের বৈঠকে বামবা'র নবনির্বাচিত সাধারন সম্পাদক, চাইমের খালিদ বিজয় দিবস উপলক্ষে সবগুলো ব্যান্ডকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওপেন এয়ার কনসার্ট আয়োজন করার পরিকল্পনা তুলে ধরেন। প্রথমদিকে অসম্ভব মনে হলেও বামবা শেষমেষ অভুতপূর্ব সফলতার সাথে কনসার্টটি আয়োজন করে। ৩০,০০০ দর্শকশ্রোতার উপস্থিতিতে বামবা কনসার্ট, ৯০ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ৯:৫০