আমার ৩ বছর ৭ মাস বয়সী মেয়ে ইউটিউবের পোকা। প্রথমদিকে শুধু নার্সারি রাইমসগুলো দেখতো। আমার এক শ্যালিকা আছে, অামার মেয়ের চেয়ে বছর দুয়েক বড়। দুইজনের গলায় গলায় ভাব। তো এক আত্মীয়'র গায়ে হলুদে অামার সেই ছোট্ট শ্যালিকা তার আপুদের সাথে হিন্দি গানের তালে তালে নেচে বেশ প্রসংশিত হলো। তাই দেখে আমার মেয়ে মায়ের কাছে বায়না ধরলো ইউটিউবে তাকে ওই গানগুলো বের করে দিতে, সে-ও নাচবে। এর পর থেকে বাসায় মেয়ের একমাত্র কাজ - ওই গান চালিয়ে নাচার চেষ্টা। খেয়াল করলাম অল্প কয়দিনেই মুদ্রাগুলো সে ধরে ফেলছে। এই ক্ষেত্রে তার মা আর দাদীর উৎসাহ ছিলো চোখে পড়ার মতো।
অামি প্রথম থেকেই আমার স্ত্রী আর মায়ের কাছে বিষয়টির বিরুদ্ধে অামার পরোক্ষ অবস্থান জানিয়ে আসছি। কিন্তু তাঁরা সব সময়ই 'বয়স কম, পরে গিয়ে এই শখ না-ও থাকতে পারে' - ইত্যাদি বলে অামার অসন্তুষ্টিকে এড়িয়ে গেছেন। অামি নিজে গান-বাজনা/ব্যান্ড-বাদ্যি নিয়ে জীবনে অনেকটা সময় কাটিয়েছি আর সব সময়ই বলে এসেছি, শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে আমার সন্তানরা জীবনে যা খুশি করবে, তাতে আমরা কখনো বাঁধা দিবো না। কিন্তু অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্ত্রী'র অনুরোধে কয়েকটা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর এবং নৃত্যরত বাচ্চা মেয়েগুলার প্রতি উপস্থিত পুরুষদের চাহনি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করার পর আমি জোরেশোরে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলাম। এমনকি মেয়ের আগ্রহ দেখার পর যেই অামি হিন্দি গানের বিপরীতে অামাদের দেশীয় নৃত্যশিল্প চর্চার জন্য মেয়েকে ছায়ানটে ভর্তি করাবো ভাবছিলাম, সেখান থেকেও সরে আসলাম। এখন নাচের প্রতি তার অার কোন আগ্রহ নাই। আপনারা চাইলে অামার সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অামার মন কোনভাবেই এতে সায় দিলো না।
এই কাহিণী বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, অামরা বাবা-মারা চাইলেই আমাদের সন্তানদের কি শেখাবো আর কি শেখাবো না - অল্প বয়সেই তার একটা প্রাথমিক ভিত্তির ওপর তাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি। 'কি শেখাবো' এর তালিকায় ভাষার স্থান একদম প্রথমদিকে।
যদি কিছু মনে না করেন, ইত্যাদি, শুভেচ্ছা, মাটি ও মানুষ (বর্তমানে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ) - বিটিভি'র এই অনুষ্ঠানগুলো অামরা সেই কবে থেকে দেখে আসছি। অনুষ্ঠানগুলোর যাঁরা উপস্থাপক, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে আমাদের মনে যেমন সন্দেহ নাই, তেমনি ইংরেজিটাও যে তাঁরা ভালোই জানেন, সে বিষয়েও অামরা বোধহয় অনেকটাই নিশ্চিত। এখন অাপনাদের কাছে অামার প্রশ্ন - এঁরা কি নিজেদের উপস্থাপনায় কখনো ইংরেজি ভাষাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন? ইংরেজিতে নিজেদের পারদর্শিতা জাহির করার চেষ্টা করেছেন? অথবা, বাংলা আর ইংরেজির মিশ্রনে তৈরী বাংলিশে কখনো কথা বলেছেন? আমার তো মনে পড়ে না। ইত্যাদি-তে একটা অংশ ছিলো, সেখানে বরং ইংরেজি ভিডিও বাংলায় ডাব করে দেখানো হতো।
কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ, ইমদাদুল হক মিলন, জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী আলি যাকের, আফজাল হোসেন, হুমায়ুন ফরিদি, বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, রফিকুল অালম, মাকসুদুল হক - এঁদের সাক্ষাৎকার তো টেলিভিশনে অজস্রবার দেখেছি। এখনো মন্ত্রমুগ্ধের মতোই শুনি। শুনি আর স্বপ্ন দেখি তাঁদের মতো করে বাংলায় কথা বলার। ড. মোঃ ইউনুস আর ড. জাফর ইকবালের বাংলায় তো অাঞ্চলিক টানও আছে। কিন্তু কি সুমধুর সেই টান! মাননীয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী'র বাংলা ভাষণও চমৎকার। ধরাবাঁধা রাজনৈতিক ভাষণের বাইরে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে নিজ পরিবার অথবা আমাদের সোনালী ইতিহাস সম্পর্কে তিনি মাঝে মাঝে অনেক কিছু শেয়ার করেন। ভালো লাগে শুনতে।
দেশ ছেড়ে বাইরে যাই। ভারতীয় সংস্কৃতি আর রীতি-নীতি'র প্রতি আমাদের এই যে সাগরসম অনুরাগ, অামরা কি তাদের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'ক্রাইম পেট্রোল' দেখি? অনুষ্ঠানটির প্রধান সঞ্চালক অণুপ সোনি কেন এতো চমৎকার হিন্দীতে কথা বলেন? এই ২০১৭ সালে এসে শুদ্ধ হিন্দীতে কথা বলে নিজেকে 'ক্ষ্যাত' প্রমাণ করার তার কোন দরকার ছিলো না। লোকটার নির্ঘাত মাথা খারাপ! এছাড়া, অমিতাভ বচ্চন, জাভেদ আখতার, অন্নু কাপুর, মনোজ বাজপাই - এই ইংরেজি না জানা লোকগুলা সুযোগ পেলেই হিন্দীতে কথা বলেন। কেন? ওই একই কারণ। মাথা খারাপ।
আবার দেশে ফিরে আসি। অাজকের লেখার অনুপ্রেরণা ফেসবুকে দেখা খাবার-সম্পর্কিত একটা প্রোমো। তরুণদের বর্তমান ক্রেজ ইউটিউবার রাবা খান কিছু একটা সেল করার চেষ্টা করছেন। তার উপস্থাপনার ঢং নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু সেইইইই বাংলিশ।
টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম - মিডিয়ার প্রত্যেকটা জায়গায় এই অসুস্থ চর্চা। কেন? সব দায়িত্ব কেন বাবা-মাকে নিতে হবে? এই যে এতো এতো টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন আর হাজারো ফেসবুক পেজ - তরুণদেরকে বাংলায় আগ্রহী করে তোলার জন্য এদের কি কোন দায়িত্ব নাই? কি করছে এরা? প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই অামাদের ভাষা ইতিহাস সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের অজ্ঞতা ফলাও করে প্রচার করা হয়। সেই ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করার আগে কি আমরা একবারও ভাবি আপলোড হওয়া মানেই বাইরের দেশের মানুষের কাছেও সেটা নিমিষেই পৌঁছে যায়? অামরা কি ভেবেছি, অান্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে তখন তারা হাসাহাসি করে?! 'নিজের পায়ে নিখুঁতভাবে কুড়াল মারার উপায়' শীর্ষক কোন প্রতিযোগিতা থাকলে অামরা নিঃসন্দেহে প্রথম স্থান দখল করতাম।
জানি, অনেকেই আমার লেখাগুলো পড়েন আর ভাবেন - ব্যাটা সেই প্রথম থেকে শুধু অভিযোগই করে যাচ্ছে। আপনার চিন্তা একদম সঠিক। কিন্তু অামি যে আজকাল গর্ব করার মতো কিছু পাই না। ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের তীর্থভূমি এই বাংলাদেশে হজ্জ্বের মতো বিষয় নিয়েও যখন সাধারন মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়, তখন আমি আর কোন কুল-কিনারা পাই না, কোন আশাও দেখি না।
ভালো হোক সবার...
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ২:৩৯