somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

রোকসানা লেইস
স্রোতের অজানা টানে সমুদ্র বালিয়াড়ি বেয়ে বোহেমিয়ান- গৃহকোন, জীবন যাপন ফেলে চলে যায়। তুমি দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনে বাঁধতে চাও জোছনা গলে হারিয়ে যায় সুখ । আছড়ে পরা ঘূর্ণিজল মনে বাজায় অচেনা সবুজ দিগন্ত ..

পরিবর্তন ভাবনা চেতনা

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকালবেলা বসেছিলাম ফুপুর গায়ে হেলান দিয়ে। কত বয়স হবে ছয় সাত। হঠাৎ গানের আওয়াজ আসল আমরা বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, রাস্তা দিয়ে কিছু ছেলে খালি পায়ে গান গেয়ে যাচ্ছে, তাদের হাতে কিছু ফুল। ফুপু বললেন, এখনের ছেলেরা অলস হয়ে গেছে। ভাইরা আগে অন্ধকার থাকতে প্রভাত ফেরী করত। শহীদ মিনারে ফুল দিতে যেত।
ঢাকার হোস্টেলে থাকি, সুপার জানালেন, মেয়েরা কাল খুব ভোর বেলা তৈরী হবে। শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাবো। একুশে ফেব্রুয়ারি বকসিবাজার থেকে শহীদমিনার খালি পায়ে হেঁটে গেলাম ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। সারিবদ্ধ দলবদ্ধ অনেক মানুষ ধীর এবং শ্রদ্ধাশীল একটাই শব্দ মুখে আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।
সময়টা নব্বইয়ের শুরুর দিকে। বিশ ফেব্রুয়ারির রাত, টিএসসি তে কবিতা পরিষদের উৎসব কমিটির রুমে অনেক কবির ভিড়। সবাই গল্প করছেন। রাত বারোটায় শহীদমিনারে ফুল দিয়ে আজ বাড়ি ফেরা হবে। মেয়েরা অনেকেই চলে গেলেন।
আনোয়ারা সৈয়দা হক, মারিয়া মান্নান, আমরা তিন বোন, সুমি, আরো দু চারজন মেয়ে ছিলেন, দুঃখিত নাম মনে নেই। এবং প্রবীন এবং তরুণ পুরুষ কবিরা। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আমরা শহীদ মিনারের দিকে হাঁটছি। ফুলের বিশাল রীদ কবিতা পরিষদের নাম লেখা ব্যানার।
মাইকে তুমুল আওয়াজ হচ্ছে শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। আবৃত্তিকার কেউ কবিতা পরেছেন। কেউ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী আসার বারতা ঘোষনা করছেন। ফ্লাড লাইটের আলোয় চারপাশ দিনের মতন আলোকিত। আমাদের দল শহীদমিনারের শুরুর দিকে দাঁড়িয়ে আছি। সরকার প্রধানদের ফুল দেয়া শেষ হলে লাইন মতন সবাই শ্রদ্ধা জানাবে।
কিন্তু সরকার দল চলে যাওয়ার সাথে সাথে পিছনের সবাই তুমুল ধাক্কাধাকি শুরু করল যেন এক সেকেণ্ডের মধ্যে তাদের শহীদ মিনারে পৌঁছাতে হবে। কে কোথায় যাচ্ছে তাদের ধাক্কায়, তারা কার উপরে পরছে এ সবে ভ্রক্ষেপ নেই। পিছনের দীর্ঘ লম্বা মানুষের সারি যেন আমাদের উপর এসে উঠে পরবে। এমন অবস্থা হলো।
আমাদের দলের ছেলেরা হাত ধরাধরি করে একটা ঘের তৈরি করে মেয়েদের মাঝখানে রেখে একটা আলাদা বৃত্ত তৈরি করে সবাইকে এক সাথে রাখার চেষ্টা করছিল। নিজেরা ধাক্কা খেয়ে উল্টে পাল্টে পরে যেতে যেতেও দেয়াল টাকে মজবুত রাখল সেখানে নারী আছেন, সেখানে সম্মানিত বয়স্ক কবিরা আছেন।
সামনে শামসুর রাহমান, ফয়েজ আহমেদ, নিমেলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক সবাই উল্টে পরে যাচ্ছিলেন ধাক্কার সাথে।আনোয়ারা সৈয়দা হক, আমরা তিন বোন এবং অন্য মেয়েরা মিলে মনে হলো আমাদের একদেহ হয়ে গেল। টের পেলাম আমার স্যান্ডেলে কারো পা পরেছে। পটাস করে ছিড়ে গেল ফিতা। অন্য স্যান্ডেলটাও খুলে দিলাম রাস্তায়। আমার ছোট ভাই বকুল, সেটা কুড়ানোর চেষ্টা করছিল। আমি বললাম বাদদে। পরে গেলে পায়ের নিচে তুই চ্যাপ্ট হয়ে যাবি।
আমরা বেরিয়ে গেলাম, শহীদ মিনারে না যেয়ে। যাদের শহীদ মিনারে পৌঁছানোর তাগদা তাদের জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে। প্রবীণ কবিরা চিরে চ্যাপ্টা হয়ে কোন মতনে ফুল দিয়ে বেরিয়ে এলেন নাস্তানাবুদ হয়ে। নিয়ম রক্ষা হলো। কিন্ত অন্তরের শ্রদ্ধাবোধ কতটা রক্ষিত হলো।এই হলো শহীদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নমুনা। ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়ার ইচ্ছা আর কখনো হয়নি।এরপর থেকে আমরা পরিবারের লোকজন মিলে, শহীদমিনার অঞ্চলের সব রাস্তায় আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গনো একুশে ফেব্রুয়ারি গান গেয়ে ঘুরতাম নিজেদের মতন বিশে ফেব্রুয়ারির রাতে। বই মেলা থেকে ফেরার পথে বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত। কিন্তু শুনতে পেতাম জোড় হিন্দি গান চলছে মেড়ে মেড়ে ঢাকার পথে। ছুটির দিনের আমেজে মানুষ একুশ উজ্জাপন করছে মাইকে হিন্দি গান বাজিয়ে।
সময়টা নব্বয়ের মাঝামাঝি। বিশে ফেব্রুয়ারি বই মেলায় প্রচণ্ড ভিড়। ধুলায় ধুষর। মানুষে মানুষে সয়লাব মেলা প্রাঙ্গন। এক চিলতে হাঁটার পথ নেই মানুষের গায়ে ধাক্কা না খেয়ে। সব্যসাচী স্টলে বসে আছি আমরা অনেকে। রাত দশটা বাজে রূপা বলল, এখন চলো যাই মানুষ কমেছে। ভিড় নাই একদমই। আমরা বেরিয়ে এলাম মেলার গেট থেকে হাঁটতে হবে শাহবাগ পর্যন্ত। গেট থেকে দশপা দূরে আসতেই পেছন থেকে একটা স্পর্শ পেলাম শরীরে। কেউ আমার নিতম্বে হাত ছোঁয়ানোর চেষ্টা করছে। একবার দুবার হওয়ার সাথে ঘুরে ঠাস করে একটা থাপ্পর কসালাম গালে । অন্য লোকজন আচ্ছা মতন ধূলাই দিল তাকে।
আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের কু চিন্তা চেতনা আমাদের সব সৌন্দর্য নষ্ট করে দেওয়ার জন্য আঠার মতন লেপটে আছে। আমরা সেটা পরিস্কার না করে আরো বেশী করে সেঁটে দেয়ার চেষ্টা করি।
আমি অনেক শিক্ষিত মানুষদের দেখেছি তারা মেয়েদের দোষ দেন তুমি গেলে কেন। বা তুমি এমন করে সেজেছো কেন। কিন্তু তারা ঠাস করে চড় কসাতে পারেন না নোংরা বদগুলোকে।
বাড়তে বাড়তে সমাজে চারপাশে এখন এই অসুস্থতা কিলবিল করছে। মেয়েদের রক্ষা করার নামে তাদের দরজা এঁটে ঘরে বন্ধ করে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। কোথাও যাওয়ার অনুমতি নাই। কেউ জোড় করে বের হলে আর কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে সারা জনমের জন্য সে মেয়ের সব বন্ধ হয়ে গেলো। অথচ অসভ্যতা করার মনোভাব নিয়ে যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের এই মনোভাব দূর করার জন্য ছোট বয়স থেকে তাদের শিক্ষিত করে তোলার কার্যক্রম চালু করা হয়না। যাতে অন্যের গায়ে চুরি করে হাত দেয়ার মতন অশিক্ষা বন্ধ হয়। নিজের ব্যবস্থা নিজেকে করতে হয়।
দু হাজার পনেরোয় অনেক বছর বাদে হাঁটছিলাম আমার মেয়েকে সাথে করে বই মেলায়। আমার চোখ ছিল চারপাশে অসভ্য বখাটেদের উপর। তারা আমাদের পরখ করে কিছু বলার আগে আমি যেন অ্যাকশন যেতে পারি তার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলাম। আমি আমার চোখ সেঁটে রাখি ওদের উপর। হাত তৈরি রাখি প্রয়োজনে ব্যবহার করব বলে। যদিও হাতাহাতি মারামরি পছন্দ নয়। কিন্তু এমন ীনাকাঙ্খিত পুরস্থিতিতে এই ব্যবহারই ওদের শিক্ষা দিতে পারে। ওরা আমাদের কাছাকাছি এসে মাথা নিচু করে চলে যায় তাড়াতাড়ি। মেয়ে বলে, তোমার চাহুনি দেখে, ভয় পাইছে। আমি বলি তোর চাহুনি দেখেও ওদের পিলে কাঁপা দরকার। সে ভাবেই চলতে হবে। আমরা কয়েকদিন আপন মনে ঘুরেছি মজা পেয়েছি ওদের ভয় পাওয়া দেখে। এই ভয়টা উল্টা মেয়েদের পাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে সমাজ এবং চুপ হয়ে থাকারও। মেয়েরাও যদি একসাথে প্রতিবাদ করত সময় তাদের পক্ষে কথা বলত। একজন দুজনের প্রতিবাদে কিছু হবে না।
মেয়েকে নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম ওর বয়স যখন ছয়। মহা আনন্দে ফুল দিয়ে এক সুখি মুখ করে নেমে এসেছিল উপর থেকে। সে আনন্দময় মূহুর্ত উপভোগ করতে চাই জাতিয় ভাবে।
আমার মেয়ের যখন তিন বছর বয়স তাকে শহীদ মিনারে নিয়ে গিয়েছিলাম এক দুপুরে। ভাষা শহীদদের গল্প বলে কেন এই মিনার তা চিনিয়ে দিয়েছিলাম। ঘুরে দেখে কথা বলে যখন তাকে বললাম চলো যাই। সে তুমুল প্রতিবাদ করল। ফুল দিলাম না এখনি যাবো কি। তাই তো শহীদদের যে কোন দিন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো যায় ওর কাছেই শিখলাম।





সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:০২
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×