নীল ফুল চেনা ছিল শুধু অপরাজিতা। প্রজাপতির মতন ডানা মেলে যে হাসত আমাদের বাসায় বাগান জুড়ে। আমার কোরিয়ান বন্ধু বলল ওরা বাটার ফ্লাই স্নো পি নামের এই ফূল ব্যবহার করে প্রসাধন তৈরি করে। খুবই উপকারি ত্বকের জন্য। ফুল দিয়ে প্রসাধনে একমাত্র গোলাপ বিখ্যাত জানতাম, অপরাজিতার ব্যবহার জেনে মুগ্ধ হলাম।
তারপর নীল ফুলের সাথে দেখা হলো ক্যালিফোর্নিয়ায়। ছোটছোট অনেকগুলো ফুল মিলে বিশাল আকারের একটা বল হয়ে ঝুলে আছে গাছে, পাতাগুলো অনেক বড় সে গাছের। কিন্তু তাদের দেখা পাওয়া ভাড় ফুলের আড়ালে লুকিয়ে আছে সব।
সাদা, নীল গোলাপি হাইড্রেনজার গাছগুলো আমার চেয়েও উঁচু বিশাল দেয়াল হয়ে ফুলের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিল। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে স্মৃতির মানসপটে। এক পাশে প্রাকৃতিক বন রেড উডের বিশাল লম্বা গাছগুলো, একপাশে সাজানো হাইড্রেন্জার দেয়াল। প্রথম দেখাটা সব সময় অন্যরকম হয়। মনজুড়ে থেকে যায় আজীবন। এরপর হাইড্রেন্জা ফুটতে লাগল আমাদের বাড়িতেও।
তারপর দেখা হলো ঝুলে থাকা নীল ফুল উইস্টেরিয়ার সাথে। টোকিওয় উইকির বাড়ির সামনাটা কি অদ্ভুত নীল ফুলের বাহার। বসন্ত কেবল শুরু হয়েছে তখন মরা ডালের মতন পরে থাকা লতানো ডালে, পাতা গজানোর আগেই ফুলগুলো মাচার মাঝে ঝুলতে শুরু করছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে নীল নীল সুন্দর ঝাড় বাতি যেন, সাথে দুলছে আমার মন দোদুল দোল। ছবিটা অদ্ভুত সুন্দর হালকা গোলাপী চেরী ফুলের পাপড়ি ঝরে ছড়িয়ে আছে ভূমি রঙিন করে, চলার পথ জুড়ে উপরে দোল খাছে নীল উইস্টেরিয়া।
সে ফুল উইস্টেরিয়ার ঘন জঙ্গলের সাথে দেখা হলো চীনে আবার বেইজিংয়ের পার্কে। একবেলা শুধু সেই সুন্দরের রূপে ডুবে কাটিয়ে দিলাম।
অতপর দেখা হলো নীল বনভূমি, ফেইরি টেল নামে খ্যাত পার্কে বেলজিয়ামে। ব্লু বাল্ব নামে পরিচিত, অসংখ্য ছোট ছোট ফুলের সমারোহে বনভূমি নীল অম্বর হয়ে জেগে আছে চোখের সামনে স্বপ্নের মতন। বড় গাছের সবুজ ছায়ায় ঘাসের সবুজ নয় নীল পরীদের মেলা বসে যায় যেন বসন্ত এলে। নীলাভ সৌন্দর্য চারপাশে এক অপরূপ পরাবাস্ত নৈসর্গ, মায়াময় হয়ে জড়িয়ে ছিল।
এই ঘাস ফুলের মতন ছোট ফুলগুলো বিভিন্ন আকৃতি এবং প্রকৃতির হয়। বাগানের মাঝে ভূমি ঢেকে গজায় তারা আপন মনে এমন সুন্দর বনাঞ্চল ক্যানাডা, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম. ফ্রান্স. জার্মানে জাপানের অনেকটা জুড়ে দেখা যায়। এই নীল জমিনের অপরূপ সৌন্দর্য।
তবে এদের দেখার জন্য ঠিক সময়ে যেতে হয় ঐ জায়গায়।
ব্লু আইরিশ ছাড়া আরো নানা রকমের নীল ফুলের সমারোহ আমার নিজের বাগানেই আছে এখন। তবে সবচেয়ে মনকাড়া হলো নীলাভ ল্যাভেন্ডার সুগন্ধ দিয়ে মন জুড়িয়ে দেয়। বিস্তির্ণ মাঠ জুড়ে শুয়ে থাকে আর বাতাসে পাঠিয়ে দেয় ঘ্রাণ আমার জন্য।
দুবছর আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম বেলজিয়ামের ওস্টেন্ড। উত্তর সাগরের দিগন্ত জোড়া পরিচ্ছন্ন বিস্তির্ণ নীলের সাথে উত্তরের লবন হাওয়া মেখে অনেকটা সময় কাটিয়ে খেতে বসলাম সমুদ্রপাড়ের একটা রেস্টুরেন্ট।
স্যামন মাছের দারুন স্বাদের একটা রান্নার সাথে নতুন ধরনের একটা সবজী ছিল মেইন ডিস। চিকোরি নামের এই সবজী আগে কখনো খাইনি। কেমন লাগবে খেতে কে জানে, অজানাকে ওর্ডার করে ঠকলাম না মোটেও।
পরে গবেষনা করে পেলাম। এখানের বাজারে প্রচুর চিকোরি পাওয়া যায় এই বসন্তের সময়। এনডিবা বা বেলজিয়ামের সবজী নামে লিস্টে দেয়া থাকে গ্রোসারী দোকানে।
আরো খুঁজে পেলাম চিকোরির গাছ আমার বাড়ির আশে পাশে ভর্তি। কি সুন্দর নীল নীল ফুল ফোটে্ গ্রীষ্মের সময়। বুনোফুলের কে করে কদর। কিন্তু আমি অনেক তাদের আদরে রেখেছি। ঘাস কাটতে তুলে ফেলিনি। ছবিও উঠিয়েছি অনেক।
আর সেই নীল ফুলের সবজী চিকোরি খেলাম বেড়াতে গিয়ে। বেশ টেস্টি।
চিকোরির সবজি অবশ্য সরাসরি গাছে হয় না। বেশ একটা প্রসেসের মাধ্যমে সবজিটা উৎপাদন করতে হয়।
বসন্তের সময় মূল তুলে বাক্স বান্দী করে রাখতে হয়। সেখান থেকে যা গজায় সেটা চিকোরি। প্রসেসটা চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু হয়ে উঠেনি গতবার। দেখা যাক এবার পারি কিনা। তবে সমস্যা হয় মরে যাওয়া গাছ থেকে মূল খুঁজে পেতে বেশ অসুবিধা। আমি চিনতে পারি না।
আরো একটা নীল ফুলের সাথে ঢলে ঢলে কিছুটা সময় কাটানোর খুব ইচ্ছা। জাকারান্ডার নীলাভ সৌন্দের্যের সাথে একটা সময় দেখা করতেই হবে।
জাকারান্ডা অনেকটা জারুলের মতন মনে হয়। তবে শুনেছি অদ্ভুত মাতাল করা ঘ্রাণ আছে এই ফুলের।
শুনেছিলাম। আমাদের দেশের কোন জমিদার নাকি আফ্রিকায় কচুরিপানা দেখে মুগ্ধ হয়ে তুলে এনেছিলেন। কচুরিপানার নীল ফুল আমাদের মনে তেমন আবেগ জাগায়নি কখনো। অতি সাধারন পুকুুর ডোবায় দেখে। কিন্তু ছোটবেলার খেলার সঙ্গী হয়েছিল ফুলটি। আসলে ওর কারুকাজ লক্ষ করে অবাক হই মনে হয় ময়ূর পেখম মেলে আছে, পাপড়িদলে।
এক সময় ধরনা ছিল নীল কোন ফুল নেই। কিন্তু এখন অযুত নীল ফুল দেখি। কেউ ছোট তো কেউ বড়। অদ্ভুত আকৃতি প্রকৃতি। অর্কিডের নীল রঙ দেখে অভিভুত হয়ে গেলাম।
সব শেষে বলি সাদা ফুলকে নীল রঙে একবার আমি নিজেও রাঙিয়ে নিলাম। নীল রঙে সারারাত রাখার পর ফুল রঙ শুষে নীল হয়ে যাচ্ছে। খেলাটা প্রতি গ্রীষ্মে করি যখন অজস্র সাদা ফুল হয় ভূমি জুড়ে তাদের অনেককে রাঙিয়ে নেই নিজের মতন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ২:৩৩