অসিতের কথা শুনে আমরা ধাক্কামতন খেলাম। মেজাজ গরম করা ধাক্কা। আজ সকালবেলা হুটহাট তার কথা শুনে এই বাসে উঠে পড়াতেও এতটা রেগে ফায়ার হইনি। কিছুদিন আগের সেই 'ময়লা শার্ট দিয়ে ভালোবাসার মেয়ে সন্ধান' জাতীয় ভূত নামার পর তার মাথায় চেপেছে আরেক ভূত।
'তোরে কি পাগলে পাইছে? এই সকাল সকাল তোর ইচ্ছা হইল আর আমাদের নিয়া আসলি এই বাসে!' সাথে থাকা প্রসূন রাগ প্রকাশ করে। সে তার বিখ্যাত আইলসামি ছেড়ে কষ্ট করে এসেছে, তাই এমন কথা বলার যথাযোগ্য অধিকার রাখে।
'তোরাও তো পাগল, আমার কথা শুইনাই চইলা আসলি।' অসিত স্বল্পবাক কিন্তু পাল্টা কথায় কম যায় না!
'সেটা তো আসছি এজন্য যে আমরা ভাবলাম সবাই মিলে যাই,নতুন কোথাও ঘুরব বইলা। কিন্তু তোর মাথায় যে এই পাগলামি ভর করবে আগে তো বলস নাই।' আমি বলি ভ্রমণবাসনা নিয়ে।
'আগে বললে মনে হয় আসতি না কারণ বিশ্বাসই করতি না আমার কথা' অসিত বলে। কথা সত্য অবশ্য, যেটা বুঝি পরে।
'হাহা। এখনো যেন খুব বিশ্বাসযোগ্য কথা বলতেছিস। সারাদিন কি যে হাবিজাবি ভাবিস কে জানে! ফেসবুকে মেসেজের ট্যাং শব্দ শুনলে তোর মনে হয় বুঝি একটা মেয়ে টুন করে তোকে ডাকল। কে বিশ্বাস করবে এই কথা!'
অসিত বলে, 'এটা তো কিছুই না। পড়তে গেলে যখন বই নিয়া বসি তখন মনে হয় বইয়ের আলো নিভা যাবে!'
বইয়ের আলো নেভা মানে? আমি আর প্রসূন অবাক।
'ঐযে ফেসবুকে বড় পোস্ট পড়ার সময় স্ক্রল না করলে যেমন মোবাইলের আলো নিভা যায়, সেইরকম আর কি।'
'খাইসে তুই তো সাংঘাতিক! কিন্তু ফেসবুক নিয়া নারীপ্রসংগ কেমনে চইলা আসে, মেসেজ টোনে নারীকন্ঠ!' আমার পালটা প্রশ্ন।
প্রসূন লেইম জোক করে। 'ওর বোউ সারাদিন ওর কানের কাছে হয়তো বলবে, আমাকে ভালবাসবে না? তোমার ঠ্যাং ভেঙে দেব। ঠ্যাং ঠ্যাং। ঐটা থেকে মনে হয় মেসেজের ট্যাং শব্দকে বউয়ের হুমকি ভাইবা ভুল করে!'
আমি হা হা করে হাসতে থাকি। তবে অসিত নিশ্চুপ। বলে, 'ভাবছিলাম আরো কিছু কমু, কিন্তু তোদের এপ্রোচ সুবিধার না।' মনে হয় আরো পচানি খাওয়ার ভয়ে অসিত থেমে যায়।
কিন্তু আমরা জোরাজুরি করি। ফেসবুক প্রসঙ্গ চলুক। বিনোদন পাবার এত সহজ উৎসকে নিরুৎসাহিত করা ঠিক না! এদিকে আমাদের বাস চলছে সমগতিতে। হঠাত আয়োজিত এ সফরে বাসে আমরা তিনজন একসারিতে বসে আছি। ধুমিয়ে গল্প করছি দেখে আশেপাশের মানুষজন বিরক্ত হতে পারে। কিন্তু আমাদের ভ্রূক্ষেপ নেই।
অসিত আবার শুরু করে।
'কিছুদিন ধরে তো দেখছিস, আমি বেশ লাইভে আসতেছি। মানে ফেসবুক লাইভ আরকি। কোন কারণ ছাড়াই। কিন্তু কেন? কারণ আমার মনে হয়, আমি যখন ফেসবুক লাইভে আসি, তখন ওপার থেকে কোন এক মেয়ে হয়তো আমাকে দেখতেছে। আমার চেহারা দেইখা কথা বলতে চাইতেছে। কিন্তু আমি তাকে না দেইখাও অনুভব করতে পারতেছি। এটা স্পর্শের বাইরে...যেন একটা বর্ণনাতীত ব্যাপার...
হয়তো নারী নয় কোন এক রাজহংসী বেশে
তোমারে সদা স্মরি আমি এ রহস্যময় দেশে'
কবি অসিত জীবনানন্দকে নকল করল নাকি? সে আনমনা হয়ে পড়ে বলতে বলতে।
কিন্তু আমরা এবার থামতে পারলাম না। হো হো করে হেসে উঠলাম। সিরিয়াসলি লেইম অসিত! তুই কি এমন সেলেব্রিটি যে ফেসবুক লাইভে তোর চেহারা দেখার জন্য মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে! আমাদের হাবভাবে এটাই ফুটে ওঠে।
'তুই তো আসলেই মানসিকভাবে অসুস্থরে। মানে ফেসবুক নিয়া এত কিছু, বাস্তব জীবনেরর সাথে তুই ভার্চুয়াল জগতকে মিলাইয়া ফেলছস!' এত সিরিয়াস কথাটা বলেই থেমে যাই, যদি বেচারা অসিত আবার চুপ করে যায়! তাই প্রসূনও সাইকোলজিক্যাল একটা ব্যখ্যা দেয়া শুরু করতে গেলে আমি থামিয়ে দেই।
দেখলাম আমাদের হাসি কিংবা তিরস্কার অসিতকে হারিয়ে যাবার জগত থেকে বাস্তবে আনতে পারেনি। কারণ সে এবার ভার্চুয়াল থেকে আরো উপরের স্তরের ভার্চুয়াল, মানে স্বপ্নজগত নিয়ে কথা বলছে,
'আসলেই মানসিক সমস্যা হইতেও পারে! কারণ ইদানিং স্বপ্নেও আমি ফেসবুক রিলেটেড জিনিস দেখি!
আমি খোচা দেই, 'ফেসবুক+নারী রিলেটেড।' পরে মিলিয়ে দেখি কথা মিথ্যা নয়।
অসিত যেহেতু কবিমানুষ তাই সে ব্যাপকভাবে পড়ে সাহিত্য। কবিতা টুকটাক লিখলেও গল্প তার প্রিয় বিষয়। কাজেই ফেসবুকের সমস্ত সাহিত্য গ্রুপে সে জয়েনড, পেজে তার লাইক। যেসব গল্প তার ভাললাগে সে সব সময় চায় তা ফেসবুকের হোমপেজেই হারিয়ে না যাক। তাই সে পছন্দের গল্পগুলো স্ক্রিনশট নিয়ে রাখে! আমরা তার ইমেজ ফোল্ডারও দেখেছি এসব স্ক্রিনশট এর।
ভাল, স্ক্রিনশট নেয়া মন্দ নয়। তবে সমস্যা তখনই যখন সে স্বপ্নতেও দেখে নিজে স্ক্রিনশট নিচ্ছে। তাই আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাই। কিরে ভাই, এতক্ষণ ভার্চুয়াল জিনিস তোর বাস্তবে ছিল, এখন স্বপ্ন পর্যন্ত চলে গেছে!
অসিত বলতে থাকে, 'আমি দেখি, আমার স্বপ্নে নেওয়া সেই স্ক্রিনশটটায় একটা গল্প আছে। নোট আকারে লেখা। একদম মনে তো নাই লাইন বাই লাইন। তবে আমি গল্পটা পড়ছি তাই থিমটুকু মনে আছে।'
কি সেই স্বপ্নে নেয়া স্ক্রিনশট নেয়া গল্পের থিম? অসিতের ফেসবুকাসক্তি নিয়ে আমাদের বিরক্তি আছে। কিন্তু তা একপাশে রেখে আগ্রহ নিয়েই অসিতের স্বপ্নে নেয়া সেই স্ক্রিনশটে লিখিত গল্পটা শুনি।
কাহিনিটা এক দেশি ছেলে আর বিদেশি মেয়েকে নিয়ে।
ছেলেটি অসিত নিজেই। বিদেশিনী বলতে এলোকেশী স্বর্নাভ চুল আর ধবধবে ফর্সার মেয়ে চোখে ভেসে আসে যেমন, তেমনই।
অসিত যাচ্ছিল বাসে করে, কোন এক অজানা গন্তব্যের দিকে। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে বাসে যেতে যেতে পাকা ধানের ঘ্রানমাখা ঝাপটা তার নাকে এসে লাগল। কিন্তু হঠাৎই সেই গন্ধ ছাপিয়ে তার নাকে এল এক অপার্থিব সৌরভ। অসিত দেখে সামনের সিটে বসে আছে গল্পের নায়িকা সেই বিদেশিনী। তার চুল বাসের বাতাসে উড়ছিল তরতর করে, বাসের জানালা পেরিয়ে ছুয়ে দিচ্ছিল হেমন্তের হাওয়াকে। হয়তো সেই গন্ধমাখা ঘ্রাণ আসছিল সেই এলোকেশ থেকে। অসিত আগবাড়িয়ে তার চেহারা দেখবার সাহস করল না। কেবল স্বর্ণাভ চুল দেখে আর অপার্থিব সৌরভ নিয়েই সে সন্তুষ্ট থাকল।
গল্প এটুকুই।
স্বপ্নের যেহেতু কোন আগামাথা থাকে না তাই আমরা আর জিগ্যেস করি না কেন স্ক্রিনশট নেয়া গল্পে অসিত নিজেকেই আবিষ্কার করে নায়ক হিসেবে। কেনইবা ঘ্রাণ নেবার মতন একটা বিষয় স্বপ্নে এতটা স্পষ্ট রূপ নিয়ে স্বপ্নে হাজির হল! কিংবা কেনইবা এক স্বর্ণকেশীকে অবশ্যই হতে হবে এক বিদেশিনী! যেহেতু আমরা কমবেশি স্বপ্ন দেখি, তাই আমরা জানি স্বপ্নের কোন সঠিক দিকনির্দেশ করা মুশকিল। তবু অসিত যে এতটুকু মনে রাখছে সেজন্য তাকে বাহবা দেই। গল্পটা অবশ্য কমনই মনে হয়।
গল্প শেষে প্রসূন বলে, 'আমি চিনিগো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিণী' তার ব্যাঙ্গাত্মক সুর শুনে স্পষ্টই বুঝি কবিগুরুর এই গান আমাকে খোঁচা দেবার জন্যই বলা! 'তো তুই চিনিস নাকি সেই বিদেশিনীকে?' সে মজা করে অসিতের কাছে জানতে চায়।
অসিত বলে,
'চিনি না, তবে আজকে সকাল সকাল বাসে ছুইটা আসছি স্বপ্নে দেখা সেই বিদেশি বাসযাত্রী মেয়ের চুলের ঘ্রাণ নিতে!'
এতক্ষণ সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তার কথা আমাদের মেজাজের মাত্রায় আলোড়ন তুলল। আমি অবশ্য কিছুটা অনুমান করতে পারছিলাম গল্প শুনার পরেই। আমাদের অবস্থা তখন এরকম, পাগলামির একটা লিমিট আছে! তার স্বপ্নকন্যার চুলের ঘ্রাণ শুকতে এসেছি আজকের সফরে। -_- সত্যি বলতে এটা আগে জানালে আসতাম না আমরা।
অসিত আমাদের রাগ অনুধাবন করে বলে, 'আরে, তোরাই তো একটু আগে ভার্চুয়াল জিনিসকে স্বপ্নে নিয়ে যাওয়াতে বাড়াবাড়ি বলছস। তাই আমি এবার এটাকে বাস্তব রূপ দিতেই আজকের বাসযাত্রায় চইলা আসলাম।' আবারো অসিতের পাল্টা কথার তীর।
আমি বলি, 'অসিত তোর মাথায় আসলেই ছিট আছে! ফেসবুক-স্বপ্ন-ভার্চুয়াল-রিয়েল মিলিয়ে একদম জগাখিচুড়ি বানাইয়া ফেলছস। তোর কি ধারণা আমাদের সামনের সিটে বিদেশিনী বইসা আছে?'
এতক্ষণে বাসে সবাই আমাদের কথাগুলো জেনে গেছে। তাই আমরা তিনজনের বাইরেও বাসের মানুষজনের মাঝে বেশ হাসির রোল শুনা গেল।
কিন্তু অসিত স্থিতধী। বলে, 'আহা, এত রেগে যাইতেছস কেন, জীবনে একটু আধটু পাগলামির দরকার আছে। পাগলামি হল লবণের মতন, তোর স্বাদহীন জীবনে এক নতুন স্বাদ আইনা দিবে!' আবার শুরু কবি অসিতের দার্শনিক বক্তব্য। অবশ্য আমার কাছে এই কথাকেও একটু আগে বলা জীবনানন্দের ছায়াছড়া এর মতন কোন ধার
করা প্রবাদই মনে হয়।
এরপর বাসের বিরতিতে আমরা থামি এক হোটেলে। ততক্ষণে আমাদের ফেসবুক জাতীয় আক্রমণাত্মক আলাপ মিইয়ে এসেছে। আমরা সেখানে বসে ঠিক করি, এরপরে এক জেলাশহরেই আমরা নামব। এতদূর যখন এসেছি, কোন ট্যুরিস্ট স্পট দেখা বাঞ্ছনীয়। আমি ইতিমধ্যে ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশে খোঁজ নেয়া শুরু করেছি কি কি দেখা যায়। দেখা শেষে আজকে দিনের মধ্যেই ব্যাক করতে পারব ঢাকা।
হোটেলে আমরা মিষ্টির অর্ডার দেই, বালুসাই আর চমচম। খাবার শেষ হয়ে যাবার পথেই যেন সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাই। তবে মেজাজ গরম করা না, অবাকমিশ্রিত ধাক্কা।
পাঠক কি ভাবছেন। সেই বিদেশিনী মেয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হল? নাহ, স্বপ্নকন্যারা স্বপ্নেই থাকে, হোক দেশি বা বিদেশি! তাছাড়া বাস্তব জীবন সম্ভবত কল্পনার চেয়েও অকল্পনীয়।
অসিত যাবার পথে হোটেলের লবিতে পায়চারি করা একজন লোককে জোরে ডাক দেয়। তারপর তার সাথে সাক্ষাত করিয়ে আমাদের বলে, 'এই যে দেখ ইনিই সেই লেখক, যার গল্প আমি স্বপ্নে পড়েছি, স্ক্রিনশট নিয়ে।' আমাদের অবাকমিশ্রিত ধাক্কা খাওয়া এখানেই।
অসিতের মুখ ভাবলেশহীন থাকা স্বাভাবিক। কারণ সে একটা মিরাকল দেখতে চেয়েই আজ সকালে বাসে উঠেছে। কিন্তু আমরা অবাক হলাম, অনেক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে মন চাইলো অসিতকে। এই লেখকই যে তোর সেই স্ক্রিনশটের গল্পলেখক তা তুই কেমনে জানলি?
আমাদের চেয়ে খানিক বয়স্ক কিন্তু কৃশকায়, অসিতের স্বপ্নে নেয়া স্কৃনশতে লিখিত থাকা গল্পের লেখকটি। পরিচয়পর্ব শেষে তিনি আমাদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে সপ্রশ্ন চাহনিতে জিগ্যেস করেন,
'কি ভাই কেমন লাগলো আমার স্বর্ণকেশী বিদেশিনীর গল্প, ভাল লিখেছি না খুব?'
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৩