মসজিদের গ্রাম নাকি শহর?
বেরাইদ পরিচিত মসজিদের গ্রাম নামে। গ্রামটি পড়েছে ঢাকার পূর্বপ্রান্তে, গুলশান থেকে পাঁচমিনিট গাড়িদূরত্বে, বালুনদের তীর ঘেঁষে।
কিন্তু গ্রাম হলেও আদতে তার আদল প্রায় শহর বা মফস্বলের মত। ঢাকার রাজপথের পাশে থাকা অসহায় ফুটপাথের মত সরু একটিই পথ এই গ্রামে, যা কিনা একমাত্র প্রধান সড়ক। তাতে দিব্যি চলছে রিকশা আর মানুষজন। দুপাশে বেড়ে উঠেছে আধুনিক-পুরাতন ধাঁচের চারপাঁচতলা দালানকোঠা, তার নিচেই দোকানপাট। সেখানে গাছগাছালি চোখে পড়ে কম। এমন নাগরিক পরিবেশ যেখানে, সে এলাকা কিভাবে একটি গ্রাম নামে পরিচিত হতে পারে
মসজিদের গ্রামের শহুরে রূপ ( অনেক চেষ্টা করেও এটা সোজা করতে পারলাম না :/ উলটো করে দেখুন!)
জহির রায়হানের 'একুশের গল্পে' আজিমপুর ছিল ছায়াসুনিবিড় একটি গ্রাম। গল্পটি লেখার অর্ধশতবছর পর আজিমপুর জায়গাটি এখন পুরোদস্তুর শহর। গ্রাম বলে কোন মানুষই আজিমপুরকে ঠাহর করতে পারবে না। সে মাপের নগরায়ন বেরাইদে না হলেও, যতগুলো হাইরাইজ বিল্ডিং এখানে আছে তাতে একে গ্রাম বলতে কষ্ট হয়। এই তো সেদিনই বেরাইদ পেয়েছে নগরের মর্যাদা, যুক্ত হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড হিসেবে। সুতরাং শহরের দালানকোঠা বুকে নিয়েও বেরাইদের প্রবেশপথে কেন লেখা থাকে, 'মসজিদের গ্রামে আপনাকে স্বাগতম'!
এর উত্তর আসলে এই বাক্যেই দেয়া আছে। বেরাইদের মসজিদগুলো যখন তৈরি হতে শুরু করে, তখনো আমাদের ঢাকা শহর মুঘলদের রাজধানি হয়নি। পূর্ববাংলায় তখন সবে ইসলাম ধর্মের ব্যাপ্তি শুরু হয়েছে, নানাপ্রান্তে গড়ে উঠেছে মসজিদ। তখনকার সময়ে যোগাযোগব্যবস্থার সহজ মাধ্যম নদীপথ। তা ধরে বালুনদের তীরে বেরাইদের জনবসতিতে ছড়িয়ে পড়ল ইসলাম, গড়ে উঠতে শুরু করল মসজিদগুলো। আর যখন এগুলো তৈরি হতে থাকল, তখন থেকে কয়েক শতকব্যাপী বেরাইদ ছিল একটি অজপাড়া গ্রাম।
বেরাইদের প্রাচীন মসজিদ।
কাজেই, বেরাইদ তার বাইরের রূপ পাল্টালেও যুগযুগ ধরে মানুষের মুখে উচ্চারিত 'মসজিদের গ্রাম' নামটির চল এখনো সেখানে রয়ে গেছে।
মিষ্টি শিঙ্গারা
খিলগাঁয়ের ত্রিমোহনি থেকে বালু নদ এঁকেবেঁকে উত্তরে চলেছে, নৌপথে এগিয়ে গেলেই পড়বে বেরাইদ গ্রামটি। সেরকম হিসাব মাথায় রেখে আর সড়কপথের ঢাকাই জ্যাম থেকে রেহাই পেতে আমরা ত্রিমোহনি পৌছি।
কিন্তু লাভ হয়নি। ত্রিমোহনি থেকে আরো পূর্বদিকে কায়েতপাড়া, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় যাওয়া যায়, কিন্তু উত্তরে যাবার জন্য কোন লোকাল ট্রলার নেই।
অগত্যা আমরা ত্রিমোহনি ছাড়ি। ঘুরপথে রামপুরা হয়ে নতুনবাজার নামি।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা বামে রেখে আমাদের লেগুনা এগোতে থাকে মাদানি এভিনিউ নামক প্রশস্ত রাস্তা ধরে। চারপাশ ধুধু করছে, কোথাও প্লট ভাগ করা, বসুন্ধরা আর আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের সাইনবোর্ড বেশি চোখে পড়ে। শীতকাল বলে ধুলোর উৎপাতও কম নয়। ঢাকার এপাশটায় শিগগিরই গড়ে উঠবে জনবসতি।
দশ-পনের মিনিটের মধ্যে প্রশস্ত রাস্তার ডানদিকে নেমে যাওয়া একটি ছোট রাস্তা দিয়ে আমাদের লেগুনা প্রবেশ করে। লেগুনা থামে। আমরা বুঝি, এটাই গন্তব্য।
বেরাইদের পশ্চিমে শহরের বাইরে চোখে পড়ে সবুজ প্রকৃতি।
বেরাইদের হৃদয়ে প্রবেশ করি পরে, তার আগে হেটে হেটে বেরাইদের বাইরে পশ্চিমদিকে একটা পথ বেয়ে এগোই। হাটতে হাটতেই আমরা আবিষ্কার করি প্রথম মসজিদটি। চান্দারটেক পশ্চিমপাড়া মসজিদ। মসজিদের গ্রামের প্রথম মসজিদ। ভেতরে যাওয়া হয়না, কেবল দেখি সাদা টাইলসে কালো অক্ষরে লেখা নামফলক। তার বিপরীত দিকেই এ কে এম রহমতুল্লাহ কলেজ, তা পার হয়ে আমরা আসি ছোট বৃজে।
বেরাইদের অন্যতম কলেজ প্রাঙ্গন।
এখানে দূরে একপাশে নিচুজমিতে ফেলা হয়েছে ভবিষ্যৎ নগরায়নের ভিত্তি বালু। আর অন্যপাশে নদী আর জলাশয়। বালুনদের কোন প্রশাখা হবে হয়তো।
হালকা সবুজ প্রকৃতির দেখা শেষে আমরা ঠিক করি মসজিদের গ্রামে প্রবেশ করার। তার আগে প্রয়োজন কিছু খাবার। খিদে মেটাতে আমরা ঢুকে পড়ি সেখানকার ছোট একচালা ছাউনির একটা রেস্টুরেন্টে। সেখানে দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি চলছে। যারা কাস্টমার তারাও বসে খাচ্ছে দুপুরের খাবার। আমাদের এখনি ভাত খেয়ে ভরাপেটে ঘুরাঘুরির কোন ইচ্ছে নেই। তাই কাউন্টারের সামনে থাকা কিশোরের সামনে সাজানো শিঙাড়ার দিকেই নজর যায়। সকালে বানানো শিঙাড়া ঠান্ডা হবে জানি। তবু বোকার মত বলি, শিঙাড়া ঠান্ডা হবে না তো? তখন চুলার পাশে রুটি বানানো রাঁধুনি, যিনি হয়তো প্রধান কর্তা একটা চমকপ্রদ উত্তর দিলেন। বললেন, মিষ্টি শিংগাড়া তো ঠান্ডা হবেই!
বেরাইদের মিষ্টি শিঙ্গাড়া
দুইটি বড় থালায় কিছুটা দুইরকম রঙের শিঙাড়া আগেই চোখে পড়ে, কিন্তু এরা স্বাদে যে একদম দুইপ্রান্তের বাসিন্দা হবে মাথায় আসেনি। ঝাল শিঙাড়া জীবনে কম খাইনি, কিন্তু মিষ্টি শিঙাড়ার নামই শুনলাম এই প্রথম! মিষ্টি যেহেতু আমার পছন্দ আর এখানে এসে নতুন ধরনের খাবার চেখে দেখার লোভে চটপট বসে পড়ি। মিষ্টি আর ঝাল দুইটাই অর্ডার করি আমরা, তবে আগে মিষ্টিটাই নিই।
রসে ভেজানো অনেকটা আমিত্তির মত, পার্থক্য হল এর ভেতরে আছে শিঙাড়ার মতই পুর। আর পুরটি খেয়ে মনে হল যেন গোটা একটা মিষ্টির ভর্তা ভেতরে পুরে দেয়া হয়েছে। মিষ্টি আর আমিত্তির এই চমৎকার সংযোজন পাওয়া গেল বেরাইদের এই অখ্যাত নামহীন একটা হোটেলে এসে। এটা আমাদের এতই ভাল লাগলো যে আমরা বাসার জন্যেও নিয়ে গেলাম মোড়কভর্তি!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:০০