[কিছুদিন পরেই হতে যাচ্ছে উপমহাদেশের সবচে আলোচিত রাজনৈতিক ঘটনা দেশভাগের ৭১বছর। কেন হল এই দেশভাগ, তার উত্তরগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি এখানে। পড়েছি ইতিহাসের বই আর অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিদের ভাবনা, তাতে নিজের কিছু পর্যবেক্ষণ যোগ করে ও সাজিয়ে তৈরি করেছি এই লেখাটি]
দেশভাগের সময় আমরা ভারতীয় বা সবাই মিলে এই বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের নাগরিক, এই পরিচয়টি ছাপিয়ে কেন ধর্মীয় পরিচয়টি প্রধান হয়ে উঠেছিল? আমরা তো ব্রিটিশ শাসনের সময় হিন্দু মুসলিম একত্রেই ছিলাম, তাহলে কোন ব্যাপারটি আমাদের আলাদা করে দিল?
এর কারণকে এক শব্দে বলা যায় বৈষম্য।
দীর্ঘ দুইশ বছরে এই অঞ্চলে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ও তাদের নিজেদের স্বার্থে পর্যায়ক্রমে হিন্দু মুসলিম বৈষম্য এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে, যা তাদের জাতীয়তাবাদী (ভারতীয়) পরিচয় ছাপিয়ে সাম্প্রদায়িক ( হিন্দু মুসলিম) পরিচয়কে বড় করে তোলে। ঠিক যেমন পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ছিল চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য, যা এক করে দিয়েছিল শোষিত পূর্ব পাকিস্তানিদের আর শাসক ক্ষমতাশালি পশ্চিম পাকিস্তানিদের। একইভাবে সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য একত্র করে দিয়েছিল ভারতের সকল 'অবহেলিত' মুসলমানদের। বিপরিতভাবে, একত্র হয়ে গিয়েছিল সকল 'সুবিধাপ্রাপ্ত' হিন্দুরা। বাংলায় ছিল প্রকট হিন্দু মুসলিম বৈষম্য আর ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্র বাংলা অঞ্চলটিই মূলত দেশভাগে সবচে বেশি ভূমিকা রাখে। তাই এখানে দেশভাগের কারণ খুঁজে বের করতে বাংলা অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করছি।
ব্যাপারটা আরো সহজভাবে বুঝানো যায় এভাবেঃ A, B, C, D এই চারজনের মধ্যে A, B ধনী। কিন্তু C, D গরিব। কাজেই ধনী A এর সাথে ধনী B এর মধ্যে ঐক্য যতটা সহজে হবে, বাকি দুইজন গরিব মানুষের সাথে তত সহজে হবে না, কারণ গরিবদের স্বার্থ ধনীদের থেকে ভিন্ন। ধনীরা শোষণ করবে, গরিবরা শোষিত হয়।
কাজেই ইংরেজদের দীর্ঘদিনের চালুকৃত বৈষম্যকরণের ফলে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে যে বৈষম্য ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, দুশ বছররের মাথায় এসে তাতে দেখা যায় স্পষ্ট পার্থক্য, যা পরবর্তিতে তাদের নিজ নিজ স্বার্থে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলে।
যদিও দেশভাগের পেছনে ধর্মীয় কারণকে সবচেয়ে বড় করে দেখা হয়, কিন্তু আসল কারণ ধর্ম নয়। ধর্ম এখানে কেবল একটি "টুল" মাত্র। দেশভাগ কোন দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম, বিপ্লব বা নির্দিষ্ট আদর্শবাদ দ্বারা হয়নি। বরং চেয়ারটেবিলে আলোচনার মাধ্যমে হয়েছিল। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে নয়, বরং তাদের মনকে ধর্ম দিয়ে প্রভাবিত করে দেশভাগ ত্বরাণ্বিত করা হয়েছিল। সে কথা পরে বলব।
১৯৪০সালে লাহোর প্রস্তাবে সর্বপ্রথম দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে, আর মাত্র সাত বছরের মধ্যেই দুইটি 'জাতি' পেয়েছে তিন খণ্ডে দুইটি দেশ। মাত্র সাত বছরের মধ্যে দেশভাগ বাস্তবে রূপ পেলেও এই চিন্তাটি গড়ে ওঠতে সময় লেগেছে। অনেকদিনের অনেক ঘটনার চূড়ান্ত রূপ দেশভাগ।
একে মোটাদাগে ভাগ করা যায় দুইটি পর্বে। ১৭৫৭সাল থেকে উনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ছিল বৈষম্য গড়ে ওঠার কাল, আর ১৯০০- ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ ও দেশভাগের চূড়ান্তরূপ প্রদান।
ইংরেজরা ১৭৫৭সালে পলাশির যুদ্ধে জিতে অবসান ঘটায় বাংলার নবাবি শাসনের। তখন এদেশে শাসন ক্ষমতা ছিল মুসলিমদের হাতে, কিন্তু বাংলার অভিজাত, ব্যবসায়িদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। অর্থাৎ সমাজের উচুতলায় একটা ব্যালেন্সড অবস্থা ছিল।
ইংরেজ আমলে এই ব্যালেন্স ভেঙে সমাজের হিন্দু মুসলিম বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। দুশ বছরের মাথায় দেখা যায়, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই অঞ্চলের মুসলিমরা ছিল অনেক বেশি গরিব, পক্ষান্তরে একই অঞ্চলের অধিবাসি হয়েও হিন্দুরা ছিল অপেক্ষাকৃত ধনি, শিক্ষিত ও প্রভাবশালি। তবে তার মানে এই নয় সকল হিন্দুরা ছিল ধনী আর সকল মুসলিমরা ছিল গরিব। মূলকথা, দেশে ধনী ও শিক্ষিত মানুষের তালিকা করলে দেখা গেল সেখানে হিন্দুদের স্পষ্ট প্রাধান্য। এর পেছনে মুসুলিম, হিন্দু ও ইংরেজ তিনপক্ষেরই দায় রয়েছে। তবে সবচে বড় যে দায়, তা বোধ করি ইতিহাসের চমকপ্রদ ঘটনাপ্রবাহের ঘাতপ্রতিঘাতগুলোর।
১. ইতিহাসের দায়ঃ মোগল শাসনের দুর্বলতায় ও নবাবি শাসনের অবসানে মুসলমানদের আবেগে আঘাত।
১৭৫৭সালে পলাশির যুদ্ধে বাংলার মুসলিম নবাব ক্ষমতা থেকে চ্যুত হবার পর এবং ১৭৬৫ সালে বক্সারের যুদ্ধে মুঘল, অযোধ্যার মুসলিম শাসকরা পরাজিত হবার পর যখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার দিওয়ানি লাভ করে, তখন শাসনকেন্দ্রে মুসলিমদের প্রভাব স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইতিহাসের নায়ক এখানে ইংরেজরা। আর তার দায় হল ইংরেজ শাসনের প্রতি মুসলিম প্রজাদের আস্থাহীনতা। আবেগের দিক থেকেও মুসলিমরা এ ব্যাপারগুলো মেনে নিতে পারেনি। তার ওপর ইংরেজরা যখন হিন্দুদের নানা সুবিধা দিতে থাকে, সেটা তাদের মনে অবহেলার জন্ম দেয়। তারা সবক্ষেত্রে ইংরেজদের অসহযোগিতা করতে থাকে আর ফলাফলে পিছিয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই, বিপরিত ব্যাপার ঘটে হিন্দুদের ক্ষেত্রে। সেন আমল (৯০০-১২০০) এর দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশ বছর পর তারা হিন্দু পুনর্জাগরনের স্বপ্ন দেখে
২. হিন্দুদের দায় (কিংবা সুযোগগ্রহণ)ঃ চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের কারণে হিন্দু জমিদারদের লাভ। অর্থনৈতিক বৈষম্য।
১৭৯৩ সালে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চালু করে এই ব্যবস্থা। এতে বাংলার হিন্দু জমির মালিকরা রাতারাতি সব জমির একমাত্র মালিক হয়ে যায়। তাদের ক্ষমতা ও আভিজাত্য বেড়ে যায় অনেক। আর দরিদ্র মুসলিম কৃষক, কৃষিকাজ করাটা আগে যাদের ছিল ইচ্ছাধীন, হিন্দু জমিদারির আওতায় আসাতে সেই প্রভুর জমিতে কাজ করতে ও জোরপূর্বক কর দিতে তারা বাধ্য হয়।
এদিকে, আগে রাজস্ব আদায়ের যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল, সেখানে মুসলিমদের সরিয়ে দেয় ইংরেজরা। বদলে তারা অনুগত হিন্দুদের নিয়োগ করে উচ্চপদে। সুতরাং অভিজাত মুসলিমরা আর্থিক সংকটে পড়ে যায়।
এটা ছিল হিন্দু-মুসলিম অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হবার একটি সূচনা।
পরবর্তিতে নীল বিদ্রোহের সময় হিন্দু জমিদাররা ইংরেজদের সহযোগি হয়ে ওঠে। তারাও বাংলার গরিব মুসলিম ও হিন্দুদের কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করে।
৩. মুসলিমদের দায়ঃ ফরায়েজি ও তিতুমির আন্দোলনে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে মুসলিমদের অনীহা। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য।
আপাতভাবে, ফরায়েজি আন্দোলন ও তিতুমিরের আন্দোলন ইংরেজ ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হলেও এর ধর্মীয় প্রভাব ব্যাপক। পূর্ববাংলায় দুদুমিয়ার নেতৃত্বে ১৮১৮-১৮৫৭ পর্যন্ত চলে ফরায়েজি আন্দোলন, ওদিকে পশ্চিম বাংলায় তিতুমিরের নেতৃত্বে ১৮২৭-১৮৩১ পর্যন্ত চলে বিদ্রোহ। এই দুই আন্দোলনে শুদ্ধ মুসলিম হবার ঢেউয়ে বাংলার মুসলমানেরা ধর্মীয় শিক্ষাকে অনেক বেশি আপন করে নিতে থাকে।
অথচ ঠিক এমন সময়েই বাংলার হিন্দুরা শিক্ষিত হতে থাকে আধুনিক শিক্ষায়। এ সময় একে একে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, এংলো হিন্দু কলেজ , সংস্কৃত কলেজ ও বেদান্ত কলেজ। মোটকথা, কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষাকেন্দ্রে হিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে।
কিন্তু বাংলার অধিকাংশ মুসলিম, যারা গ্রামবাসি ও কৃষক, তারা এ দুইটি আন্দোলনের প্রভাবে যত বেশি ইসলামসংলগ্ন হয়ে পড়ে, ততটাই দূরে সরে যায় ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ থেকে। দিনে দিনে শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৈষম্য দুই সম্প্রদায়ের পার্থক্য আরো প্রকট করে তোলে।
এই শতকের শেষার্ধে যখন সৈয়দ আহমদ খান, নওয়াব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলিমদের মধ্যে ইংরেজ বিদ্বেষ ঘুচিয়ে আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তনের চেষ্টা করেন, ততদিনে হিন্দুরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক এগিয়ে গেছে।
লক্ষণীয় মিল হল, মুসলিম ও হিন্দু দুই ধর্মেই এই সময়ে পুনর্জাগরণ লক্ষ্য করা গেছে। হিন্দুধর্মে একেশ্বরবাদি ব্রাহ্মসমাজ গড়ে উঠেছে। ইসলাম ধর্মে অনৈসলামিক আচার ছেড়ে ফরজ পালনে মুসলমানরা উৎসাহী হয়েছে। কিন্তু অমিল হল, হিন্দুরা শিক্ষা গ্রহণে সমাজে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে কিন্তু মুসলমানেরা পারেনি।
৪. ইংরেজদের দায়ঃ পরিকল্পিত শ্রেণিবিভাজনের মাধ্যমে হিন্দুদের রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি। রাজনীতিতে অধিকার আদায়ে বৈষম্য।
বলা হয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রে হিন্দুরা এগিয়ে যায় অনেকখানি। এই শিক্ষিত হওয়য়া কিন্তু সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙ্গালিদের মধ্যে।
ইংরেজরা দেখেছে, চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের পর বাংলায় বেশ কিছু বিদ্রোহ ও আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৮০০সালে ফকির ও সন্নাসিরা, তারপর ফরায়েজি আন্দোলন ও তিতুমিরের বিদ্রোহ, ১৮৫৫সালে সাওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭সালে সিপাহি বিদ্রোহ, অর্ধশতাব্দির বেশি ধরে চলা কৃষকদের নীলবিদ্রোহ...ইত্যাদি প্রত্যেক বিদ্রোহে লক্ষনীয়ভাবে অংশগ্রহণ ছিল নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের। এর সাথে যদি মধ্যবিত্তরা যোগ দেয় তাহলে এখানে হবে ফরাসি বিপ্লবের মতন অলআউট আন্দোলন।
এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিকে সেইসব সদাসংগ্রামি নিম্নবিত্ত মানুষদের আন্দোলন থেকে আলাদা করতে তাদের জন্য উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করে। সিপাহি বিদ্রোহের পরেই কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইংরেজ অনুগত, সরকারি চাকুরি পেয়ে সুবিধাভোগি একটি বাবুসমাজ তৈরি করে, যা মূলত ভারতের দরিদ্র মানুষদের থেকে জনবিচ্ছিন্ন। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত এই স্পষ্ট পার্থক্যকরণে সমাজে তৈরি হয় পরিকল্পিত একটি শ্রেণিবিভাজন।
পরবর্তিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দুসমাজে জাগ্রত হয় ভারতীয় জাতীয়তাবোধ। তারা তৈরি করে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস, ১৮৮৫ সালে, যাতে ছিল হিন্দু অভিজাতবর্গের প্রাধান্য, কাজেই তা ক্রমে পরিণত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবিদাওয়া আদায়ের মুখপাত্রে। হিন্দুদের মধ্যে এই রাজনৈতিক সচেতনতার ফলশ্রুতিতে মুসলিমরা নিজেদের আলাদা ভাবতে শুরু করে।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ গুগল
সহায়ক জার্নালঃ How a nationalist movement turned communal, Sirajul Islam Chowdhury, 25-08-2017, The Daily Star, লিংক Click This Link
শেষ পর্বে বলব কিছু রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, যেগুলোর গ্রহণের পটভূমি আসলে উপরের ঘটনাগুলোই।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:৪৬