somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধর্ম সভ্যতা ও রবীন্দ্রনাথ

০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মানবসভ্যতা ও ধর্ম যেন অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। প্রশ্ন হল এরা কতটা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পেরেছে। একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, ধর্মের উপর সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে বা সভ্যতার উপর ধর্ম। তবু এদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক অবিচ্ছেদ্দ আত্মীয়তা। যে আত্মীয়তায় মানুষের ধর্মবোধ সভ্যতাকে সুন্দর করে আবার সভ্যতার বিভিন্ন প্রকরণ ও অনুষঙ্গগুলি ধর্মকে গড়ে তোলে এবং সতত চলিষ্ণু রাখে। এই চলিষ্ণু রাখার প্রসঙ্গেই দেখা দেন যুগাবতারগণ। যুগেযুগে তাঁরা আবির্ভূত হয়ে ধর্মকে জীবন্ত করে তোলেন। এঁদের বাইরেও বহু মনীষী মহামানব সব কালেই সব দেশেই ধর্মের নানা ব্যাখ্যা দিয়ে সমাজ সাহিত্যে জীবনে ধর্ম আর সভ্যতাকে পরিপূরক করে তুলতে প্রয়াসী হন।

আমাদের জীবনে সাধারণ ভাবে ধর্মের অভিঘাত সাম্প্রদায়িক আচার আচরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বংশ পরম্পরায় কতগুলি নির্ধারিত ক্রিয়াকর্মের মধ্যেই আমাদের ধর্মবোধ একটি অতি সংকীর্ণ গণ্ডীতেই আবদ্ধ থাকে। এবং সেই আবদ্ধতাকেই আমরা আস্তিকতা এবং ধার্মিকতা মনে করে প্রশ্নহীন একটি মুখস্থ জীবন কাটিয়ে দিতে পারার মধ্যেই ধর্মাচারণের সার্থকতা অনুভব করি, ও আত্মপ্রসাদ লাভ করি। অধিকাংশ মানুষের জীবনেই এ কথা সত্য; সভ্যতার আবহমান প্রবাহতার বাস্তবতায়।

কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ। ক্ষুদ্র আমির গণ্ডী কেটে বৃহৎ আমির অভিমুখী তীর্থযাত্রার দূরন্ত অভিযাত্রী। তিনি প্রচলিত ধারার প্রশ্নহীন অনুকারক নন। তাই তাঁর ধর্মবোধ তো স্বতন্ত্র হতেই হবে। কবি জন্মেছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের একেবারে অন্দরমহলে। বৃটিশ শাসনের একেবারে প্রথম দিকেই হিন্দু ধর্মের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধাচারনের সূত্রপাতে রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে প্রগতিশীল ব্রাহ্ম সমাজ। সেই সমাজের পরবর্তী নেতৃত্বস্থানীয় প্রধান পুরুষ ছিলেন কবির পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফলে শৈশব থেকেই যুক্তিবাদী দার্শনিক আবহাওয়ার মধ্যেই গড়ে উঠতে থাকে রবীন্দ্রমনন। প্রথম দিকে মহর্ষির ধর্ম সাধনা, কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্ব, এ সবই তরুণ কবির উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। যৌবনের প্রারম্ভেই কবি ব্রাহ্মসমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যাখ্যাতা হয়ে ওঠেন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কাছে কবির প্রথম উপনিষদ শিক্ষা। উপনিষদের যুক্তিবাদ এবং গভীর দার্শনিক প্রজ্ঞা তৎসহ অসীম আধ্যাত্মিক উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ ভাবেই প্রভাবিত করেছিল। যা কবির পরবর্তী জীবনে তাঁর ভাবনা রাজ্যে ও কর্মজীবনে বিপুলভাবেই সহায়ক হয়ে উঠেছিল। এর ফলে কবি প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের জীবনে ধর্মের অবক্ষয়ের নিদারুণ প্রভাব সম্বন্ধে গভীর ভাবেই অবহিত হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন সমাজদেহের অভ্যন্তরে ধর্মের কোনো অস্তিত্বই আর অবশিষ্ট নেই। যা আছে তা যুক্তিহীন কতগুলি আচার বিচার যা বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। তিনি দেখলেন সেগুলির ধর্মান্ধ অনুকরণে ও অনুসরণের মধ্যে দিয়ে মানুষ সংকীর্ণ গণ্ডী বদ্ধতায় আটক।

তিনি দেখতে পেলেন এই প্রশ্নহীন অনুকরণ ও অনুসরণ এবং অন্ধ আনুগত্য প্রবৃত্তি সমাজদেহে ও ব্যক্তি জীবনে ধর্মকে আর সজীব থাকতে দেয় না। ধর্ম কেবলি কতগুলি প্রাতিষ্ঠানিক আচার বিচার পদ্ধতির অন্ধভাবে প্রতিপালনের নিছক ক্রিয়াকর্মই হয়ে ওঠে মাত্র। যার সাথে ব্যক্তি জীবনের যোগ হয় নিতান্তই পোশাকি। এই সব ধর্মীয় আচার বিচার পালন, এই বিশ্বজগতের সাথে ব্যক্তি জীবনের কোনো সংযোগ সেতু হয়ে উঠতে পারে না। এবং এইগুলিই মানুষকে কেবলি ছোট ছোট গণ্ডীতে আবদ্ধ করে ফেলে। বাধা দেয় বিশ্বমৈত্রীর পথে হাঁটতে। বিচ্ছিন্ন করে তোলে প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠীকেগুলিকে, সাম্প্রদায়িক বিভেদের শক্তিতে। এসবই হয় কালের খেয়ায় বংশ পরম্পরায়।

ধর্ম সম্বন্ধে,এই সংকীর্ণ গোষ্ঠীবদ্ধতার সীমানায় ধর্মান্ধ ভাবে শুষ্ক আচার বিচারের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য ও বংশ পরম্পরায় তার অনুকরণ ও অনুসরণ, রবীন্দ্রনাথের সংবেদনশীল ও প্রগতিশীল আধুনিক মনকে গভীর ভাবেই পীড়িত এবং ব্যথিত করেছিল। তিনি অনুধাবন করলেন প্রকৃত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার অভাবজনিত কারণ এবং সমাজের সকল স্তরে সার্বিক শিক্ষা বিস্তারের অভাবই এই পরিণতির জন্য দায়ী। তাঁর সুবিশাল কর্মকাণ্ডে এবং সৃষ্টিশীল সাহিত্যজীবনে তাই তিনি বারবার নানা ভাবে সমাজের প্রচলিত ধর্ম গুলির এই সীমাবদ্ধতার প্রতি মননশীল আলোকপাত করে গেছেন। আচারবিচারের ঘেরাটোপ থেকে বেড়িয়ে প্রকৃত ধর্মবোধে উদ্বুদ্ধ হতে নিরন্তর অনুপ্রাণিত করে গেছেন।

"আত্মপরিচয়" গ্রন্থে এক স্থানে কবি বলছেন,সকল মানুষেরই আমার ধর্ম বলে একটা বিশেষ জিনিস আছে। কিন্তু সেইটাকেই সে স্পষ্ট করে জানে না। সে জানে আমি খ্রীষ্টান, আমি মুসলমান, আমি শাক্ত, আমি বৈষ্ণব ইত্যাদি। আসলে মানুষের জীবনদর্শন বা চরিত্র, যা তার ব্যক্তিত্বের ভেতর থেকে জেগে ওঠে, তাই তার ধর্ম”।

এই "মানুষের ধর্মেরই" অন্তহীন সুর বাজিয়ে গিয়েছেন কবি তাঁর বিস্তৃত সৃজনশীল বাঁশিতে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শ্যামল সেনগুপ্তের মতে, কবির ধর্মচেতনায় বৈষ্ণবের প্রেমভক্তি, বৌদ্ধের মৈত্রী-করুণা কিংবা খ্রিস্টানের ক্ষমাশীলতা একাকার হয়ে রাবীন্দ্রিক মানবধর্মেরই..রূপ..গ্রহণ..করেছে।

"Talks In China" গ্রন্থে কবি বললেন, "The specific meaning of dharma is that principle which holds us firm together and leads us to our best welfare. The general meaning of this word is the essential quality of thing."

এই যে সার্বিক সুস্থতার লক্ষ্যে সমবেত উৎকর্ষতার উদ্বোধন, রবীন্দ্রনাথের "মানুষের ধর্ম" -এর এই হল ভরকেন্দ্র। এইখান থেকেই গড়ে উঠবে আধুনিক সভ্যতা। তেমনি স্বপ্ন দেখতেন কবি। এই কারণেই তিনি বারবার মানুষের ধর্মবোধ জাগ্রত করার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। যে ধর্মবোধকেই তিনি মনুষত্ব বা সভ্যতা বলে বুঝতে চেয়েছেন। যে ধর্মবোধে মানুষের সাথে মানুষের সাথে মানুষের আত্মীয়তায় গড়ে উঠবে বিশ্বমৈত্রী। বসুধৈবকুটুম্বিকম।

সমাজ প্রচলিত ধর্ম ব্যবস্থা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ দেখি কাদম্বিনী দেবীকে বোলপুর থেকে লেখা (২০শে আষাঢ় ১৩১৭) পত্রে; কবি বলছেন, "...আমাদের দেশে ধর্মই মানুষের সাথে মানুষের প্রভেদ ঘটিয়েছে, আমরাই মানুষের নাম করে পরস্পরকে ঘৃণা করেচি, স্ত্রীলোককে হত্যা করেচি, শিশুকে জলে ফেলেচি, বিধবাকে নিতান্তই অকারণে তৃষ্ণায় দগ্ধ করেচি, নিরীহ পশুদের বলিদান করেচি, এবং সকল প্রকার বুদ্ধি যুক্তিকে একেবারে লঙ্ঘন করে এমন সকল নির্থকতার সৃষ্টি করেচি যাতে মানুষকে মূঢ় করে ফেলে। আমরা ধর্মের নামেই অপরিচিত মুমূর্ষুকে পথের ধারে পড়ে মরে যেতে দিই পাছে জাত যায়। (এ আমার জানা)" কেন এমন..হয়..প্রশ্ন..করেছিলেন..কবি।

উত্তরও তিনিই দিয়েছেন। হেমন্তবালা দেবীকে দার্জিলিং থেকে লেখা (৯ই কার্তিক ১৩৩৮) এর পত্রে। বলছেন, "মানুষের ধর্ম মানুষের পরিপূর্ণতা, এই পরিপূর্ণতাকে কোনো এক অংশে বিশেষভাবে খণ্ডিত করে তাকে ধর্ম নাম দিয়ে আমরা মনুষ্যত্বকে আঘাত করি। এই জন্যেই ধর্মের নাম দিয়ে পৃথিবীতে যত নিদারুণ উপদ্রব ঘটেচে এমন বৈষয়িক লোভের তাগিদেও নয়। ধর্মের আক্রোশে যদি বা উপদ্রব নাও করি তবে ধর্মের মোহে মানুষকে নির্জ্জীব করে রাখি, তার বুদ্ধিকে নিরর্থক জড় অভ্যাসের নাগপাশে অস্থিতে মজ্জাতে নিস্পিষ্ট করে ফেলি- দৈবের প্রতি দূর্বল ভাবে আসক্ত করে।" এই ভাবে ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে মনুষ্যত্বের অপমানের মধ্যেই তিনি সভ্যতার অসুস্থতার কারণ খুঁজেছেন।

বস্তুত রবীন্দ্রনাথ মানুষের সমগ্রতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সেই সমগ্রতা থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে খণ্ড সত্যের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ করার, প্রচলিত সাম্প্রদায়িক ধর্মগুলির প্রাণান্তকর প্রয়াসের বিরুদ্ধেই ছিল তাঁর অভিযান। এই ভাবে মানুষকে সাম্প্রদায়িক গণ্ডীতে আবদ্ধ করে রাখার বিশ্বব্যাপী মৌলবাদী মানসিকতার বিরুদ্ধেই আজীবন সোচ্চার ছিলেন কবি। ঠিক যে কারণেই আশৈশব লালিত ব্রাহ্ম সমাজেও যখন এই সংকীর্ণতার সাম্প্রদায়িক চরিত্র লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করেছিল, মধ্য যৌবনের সেই পর্বেই সেই ব্রাহ্ম সমাজের গণ্ডীবদ্ধতা থেকেও নিজেকে মুক্ত করে নেন কবি। তিনি এও বুঝে ছিলেন ধর্মবোধ ছাড়া সব ধর্মেরই সাধনা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

তাঁর "চারিত্রপূজা"য় তিনি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বললেন,"মহাপুরুষরা ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করে যান, আমরা তাহার মধ্যে সম্প্রদায়টা লই, ধর্মটা লই না।" তাঁর মতে আপন ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল্যেই অর্জিত হয় প্রকৃত ধর্মবোধ। অন্যের কাছ থেকে ভিক্ষে করে অনুকরণের মাধ্যমে নয়। তিনি বললেন, "কোনো সত্য পদার্থই আমরা আর কাহারো কাছ হইতে হাত পাতিয়া চাহিয়া পাইতে পারি না। যেখানে সহজ রাস্ত ধরিয়া ভিক্ষা করিতে গিয়াছি, সেখানেই ফাঁকিতে পড়িয়াছি। তেমন করিয়া যাহা পাইয়াছি তাহাতে আত্মার পেট ভরে নাই, কিন্তু আত্মার জাত গিয়াছ।" (চারিত্রপূজা) এখানেই তিনি স্পষ্ট করলেন কিভাবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা মানবধর্মের অভিপ্রায়কে ব্যার্থ করে দেয়।

খুব বড়ো একটা কথা বললেন রবীন্দ্রনাথ,"আত্মার জাত গিয়েছে।" অর্থাৎ যে ধর্মবোধ আমাদের আত্মার পূর্ণ বিকাশের পথে আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যায়; সেই ধর্মবোধের অভাবেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা আমাদের আত্মার পূর্ণ উদ্বোধনকে ব্যর্থ করে দেয়। আর তখনই শুষ্ক আচার বিচারের মৃতদেহকে জড়িয়ে আমরা কেবলি সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক গণ্ডীর মধ্য নিজেদেরকে আবদ্ধ করে ফেলি। আবিলতায় মলিন হয়ে হঠে অন্তরাত্মা। মানুষ হিসেবে তখন আর জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে বুকে টেনে নিতে পারি না। বিশ্ব মানবাত্মার প্রঙ্গনে নির্বাসিত রাখি নিজেদের। এইভাবেই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি বিশ্ব মৈত্রীর পথে বাধা সৃষ্টি করে। সভ্যতাকে কলুষিত কর। জাত যায় আত্মার।

এই আত্মার জাত যাওয়ার প্রসঙ্গেই ১৯৩৩ এর ৬ ফেব্রুয়ারি শ্রীনিকেতন মেলায় অস্পৃশ্যতা বর্জনের দাবিতে অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় কবি বললেন, "আমরা মনে করি পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা মন্দির, না সে কারাগার? যারা ঘণ্টা নেড়ে আচার অনুষ্ঠান মেনে পূজা করছে ভগবানের মন্দির থেকে নির্বাসিত তারাই। যারা আকাশের সূর্যের দিকে তাকিয়ে বিশ্ব দেবতার চরণে প্রণাম জানাতে পেরেছে তারাই আজ যথার্থ পূজারী, তারাই স্পৃশ্য। আজ সময় এসেছে মিলবার। ভগবানের আকাশের দিকে চেয়ে পরস্পর পরস্পরকে বুকে তুলে নিতে হবে। পুরানো শাস্ত্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবার দিন চলে গেছে।" আর সেই বিশ্ব মৈত্রীর পথেই ধর্মবোধ সুন্দর করুক সভ্যতা।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনা তাই সভ্যতার সুস্থ সুন্দর বিকাশে মানবাত্মার পূর্ণ উদ্বোধনের কথাই বলে। এই কারণেই তিনি ধর্মের সংকীর্ণ পরিসরে সীমায়িত করেননি নিজেকে। তাঁর ভগবান বিশ্বমানবাত্মার ভগবান হয়ে উঠতে পেরেছে। তাতে লাগেনি কোনো সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া। তাঁর ধর্মচেতনা তাই পূর্ণ মানবতাবাদের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। গোরা উপন্যাসের শেষেও গোরা যেমন পরেশবাবুর কাছে ছুটে গিয়ে অনুরোধ করে, "আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান ব্রাহ্ম সকলেরই। যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না;...।"কবি পেয়েছিলেন সেই মন্ত্র তাঁর আপন ধর্মবোধের অর্জনে। জীবন সাধনায়।

সেই মন্ত্রই তাঁর, ছোট আমির গণ্ডী কেটে বড়ো আমিতে উত্তরণের মন্ত্র। যে কথা বারবার নানা ভাবে বলে গিয়েছেন কবি। ২৭শে আশ্বিন ১৩৩৯, হেমন্তবালা দেবীকে এক পত্রে লিখছেন; "মনুষ্যত্বের বিচিত্র প্রবর্ত্তনাকে অন্ধ অভ্যাসে সঙ্কীর্ণ করে আনাকে অনেকে ধর্মসাধনা বলে, মানবস্বভাবকে খর্ব করা পঙ্গু করাকেই মনে করে সাধুতা। জীবনকে এমন অকৃতার্থ করাই যদি বিধাতার অভিপ্রেত হতো তবে তাঁর সৃষ্টিতে এত আয়োজন কেন? জ্ঞান প্রেম ও কর্মের মধ্যেই নিজেকে বড়ো করে পাওয়ার মধ্যেই মুক্তি। জ্ঞান প্রেম কর্মের পরিধিকে ছেঁটে ছোটো করা আত্মহত্যার রূপান্তর। সংসারের খাঁচায় যারা কষ্ট পাচ্ছে ধর্মের খাঁচা বানিয়ে তারা নিষ্কৃতি পাবে এ কখনো হয় না।"

এই যে জ্ঞান প্রেম ও কর্মের মধ্যে নিজেকে বড়ো করে পাওয়া এর মধ্যেই মানুষের মুক্তি। মুক্তি আমাদের ক্ষুদ্রতর ব্যক্তি স্বার্থবোধের সংকীর্ণ সীমায়িত গণ্ডীবদ্ধ পরিসর থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাই সেই ছোট আমির সংকীর্ণতা থেকে বড়ো আমিতে উত্তরণের এই মন্ত্র দিয়ে গেলেন, জ্ঞান প্রেম ও কর্মের মধ্যে নিজের আত্ম সরূপের সম্পূর্ণ উপলবদ্ধির শক্তির মধ্যে দিয়েই। সেই মন্ত্রেই চেষ্টা করলে আমরাও মিলতে পারব বিশ্বমানবাত্মার প্রাঙ্গনে সকলের সাথে সমান ভাবে। সেই মিলনের লগ্নেই সভ্যতা হয়ে উঠবে পূর্ণ মানবিক। সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবোধের অন্ধকার পেড়িয়ে বিশ্বমৈত্রীর অম্লান আলোয়। যে আলোর হদিস খুঁজে পেয়েছিল গোরা,"গোরা" উপন্যাসের অন্তিমে।

তাইতো কবির ঈশ্বর কোনো মন্দির মসজিদ গির্জার ইট কাঠ পাথরের মধ্যে থাকেন না। তাঁর অধিষ্ঠান ধূলামন্দিরে। প্রচলিত সাম্প্রদায়িক ধর্মগুলির সংকীর্ণতার উর্দ্ধে মনুষ্যত্বের বিবেকী আদর্শে উদ্বুদ্ধ তাঁর জীবনদেবতা। যিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আজও ব্রাত্য, মন্ত্রহীন। এইভাবেই রবীন্দ্রনাথের ধর্ম চেতনা সম্পূর্ণ ভাবেই পরিপূর্ণ মানবতাবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। বিশুদ্ধ মানবিক প্রেমের সূত্রে যা বিশ্বমানবতার বেদীতে বিশ্বমৈত্রী ও বিশ্ব শান্তির কথা বলে। এই ধর্মবোধের উদ্বোধনেই মানব সভ্যতা একদিন পরিপূর্ণ ভাবেই মানবিক হয়ে উঠবে বলে কবির আজীবন প্রয়াস বিশ্বাসের প্রাঙ্গনে। তাই সভ্যতার সংকটেও তিনি মানুষের উপর বিশ্বাস হারাননি।

কবি আমাদের অন্তরাত্মায় নিখিল মানবের আত্মাকে উপলব্ধি করার মন্ত্র দিয়ে সেই "নিখিল মানবের আত্মা" সম্বন্ধে বললেন, "তাঁকে সম্পূর্ণ উত্তীর্ণ হয়ে কোনো অমানব বা অতিমানব সত্যে উপনীত হওয়ার কথা যদি কেউ বলেন তবে সে কথা বোঝবার শক্তি আমার নেই। কেননা, আমার বুদ্ধি মানববুদ্ধি, আমার হৃদয় মানব হৃদয়, আমার কল্পনা মানবকল্পনা। তাকে যতই মার্জনা করি, শোধন করি, তা মানবচিত্ত কখনোই ছাড়তে পারে না। আমরা যাকে বিজ্ঞান বলি তা মানববুদ্ধিতে প্রকাশিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তাও মানব চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ। " (মানুষের ধর্ম) এই মানবাত্মার বাইরে অন্য কিছু থাকা না থাকা মানুষের পক্ষে সমান, কবির মতে। এই সত্যেরই পূজারী তিনি।

সভ্যতার সঙ্কটে বিচলিত হয়েও কবি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাতে চাননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল নদী প্রবাহের ঘূর্ণীর মতোই এ সঙ্কট সাময়িক। মানুষের শুভবোধ জাগ্রত হয়ে মানবধর্মের ঐকান্তিক সম্ভাবনায় সভ্যতা আবার মানবিক গুণাবলির অধিকারী হয়ে স্বধর্মে স্থিত হবে। আর সেই লক্ষেই যে ধর্ম মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে মিলনের সম্প্রীতিতে বিশ্বকে এক করবে, সেই ধর্মেরই আরাধনা করে গেলেন কবি তাঁর আজীবন সাধনায়, মানব সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানব রূপে। মানবতাবাদী কবির ঈশ্বর তাই, মানবপ্রেমের অঙ্গনে আমাদের সাথেই চলেছেন-- সভ্যতাকে আর একটু মানবিক করে আমাদের আত্মসম্মান বজায় রাখার লক্ষে সাহায্যের হাতটি বাড়িয়ে। ঠিক মনের মানুষের মতোই।।

[শ্রীশুভ্র]



সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×