somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাস্তিকের ধর্ম ও মৌলবাদ

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৯:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মানুষের চেতনার উন্মেষের সাথে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে তার প্রশ্নগুলিই বস্তুত সভ্যতার ভিত্তি গড়ে তুলেছিল বলা যায়। আর সেই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই সভ্যতার এগিয়ে চলা। সেই চলার পথে মানুষ যখন যেরকম উত্তর খুঁজে পেতে সমর্থ হয়েছে সেরকমই বিস্তৃত হয়েছে তার জ্ঞানভাণ্ডার। নতুন কালের নতুন উত্তর এসে সংশোধন করে নিয়েছে অতীতের অপূর্ণ ও ভুল উত্তরগুলি। আর এই পথেই এগিয়ে চলেছে অনুসন্ধিৎসু মানুষ। এবং এইটাই বিজ্ঞানের পথ। দর্শনের পথ! দূর্ভাগ্যের বিষয়, সকলেই যে এই পথের পথিক তা নয়। বস্তুত অধিকাংশ মানুষই এই পথে হাঁটেন না। কারণ এই পথ সাধনার পথ। ধৈর্য্যের পথ। বিশ্রামহীন নিরন্তর পরিশ্রমের পথ। সংশয় আর অবিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে অজানার অন্ধকারের আতঙ্ককে জয় করে তাকে অর্জন করতে হয় নিত্য নতুন আলোর দিশা। সেই আলোই তাকে তার জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলতে সক্ষম করে । আর সেই জ্ঞানভাণ্ডারের সুফল ভোগ করে আবিশ্ব মানুষ। এই যে নিরন্তর নিত্য নতুন প্রশ্ন আর তার সঠিক ও নির্ভুল উত্তর খোঁজার মানসিকতা ও উদ্যোম; এর ঠিক বিপরীতে রয়েছে সাম্ভব্য অসাম্ভাব্য, কাল্পনিক ও মন গড়া ধ্যানধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা অটল কোনো বিশ্বাসের কাছে নিজ নিজ মৌলিক চিন্তা ভাবনার অমেয় শক্তিকে বন্ধক রেখে নিশ্চিন্তে বসে থাকার অলস মানসিকতা। না এই পথ এগিয়ে চলার পথ নয়। এই পথ সমৃদ্ধির পথ নয়। এই পথ থেমে থাকার পথ। এই পথ বনসাই মানসিকতার পথ। আর পরিতাপের কথা, আবিশ্ব অধিকাংশ মানুষই এই পথের পথিক। কারণ এই পথে কোনো পরিশ্রম নেই। রয়েছে অন্ধ বিশ্বাসের নিশ্চিন্তি। আর বেশির ভাগ মানুষই সেই নিশ্চিন্তিকেই বরণ করতে ভালোবাসে আজীবন। হ্যাঁ এই পথই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার পথ। এই পথই ঈশ্বর বিশ্বাসের পথ। এই পথ চলার পথ নয়। এই পথ থেমে থাকার পথ।

তাই দর্শন ও বিজ্ঞান যখন নিরন্তর এগিয়ে চলেছে জয় করছে এক একটি নতুন শৃঙ্গ, ঠিক সেই সময়ই পৃথিবীর সবকয়টি সাম্প্রদায়িক ধর্মই হিমালয়ের মতো অচল অটল হয়ে থেমে আছে তাদের প্রথম দিনেই। এই যে একটি বিন্দুতে থেমে থাকা, বস্তুত এই থেমে থাকাই মৌলবাদ। মৌলবাদ বনসাই মানসিকতার ফসল। মৌলবাদ জবরদস্তি করে সবকিছুকেই একটি ছাঁচে ঢালাই করার প্রয়াস। মৌলবাদ প্রশ্নহীন আনুগত্যের ফাঁদে মানুষের অমেয় সম্ভাবনাকে আটকিয়ে রাখার অন্যতম শক্তিশালী ও কার্যকরী কৌশল। সেই মৌলবাদই এই মানব সভ্যতার সকল সাম্প্রদায়িক ধর্মের চালিকা শক্তি। সেই মৌলবাদই বলে আমার ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ! আমার ঈশ্বরই সর্বশক্তিমান! আমার ধর্মগ্রন্থই অভ্রান্ত! আমার ধর্মে যারা বিশ্বাসী নয় তারাই নাস্তিক। আমার ধর্মে যারা বিশ্বাসী নয়, তারা নিকৃষ্ট, তারা অন্ধ! স্বর্গের দ্বার তাদের জন্যে খোলা নয়! আর আমার ধর্মে যারা বিশ্বাসী, তারা পার্থিব জীবনে সুখ না পেলেও মৃত্যুর পর তাদের জন্যে স্বর্গসুখের বন্দোবস্ত করে রেখেছেন দয়াময় ঈশ্বর! আর ঠিক এই জায়গাতেই এসে সাম্প্রদায়িক এই ধর্মীয় মৌলবাদের সাথে হাত ধরাধরি করে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ। এবং এইখান থেকেই পৃথিবীর অর্থনৈতিক ইতিহাসের শুরু। যদিও সে অন্য প্রসঙ্গ।

দর্শন ও বিজ্ঞানের সকল শাখাপ্রশাখা উপশাখাতেই নিরন্তর পূর্ব সিদ্ধান্তগুলি, অর্জিত জ্ঞানভাণ্ডারগুলি নিত্য নতুন ভাবে সংশোধিত হয়ে চলছে। আর চলেছে বলেই তা চিরসবুজ অনন্ত সজীব! এইযে সত্যকে নিত্য নতুন ভাবে সম্পূর্ণ করে তোলার মানসিকতা ও প্রয়াস, এতেই মানুষের গৌরব। সবচেয়ে বড়ো কথা এই মানসিকতা ও প্রয়াসই সভ্যতার জীয়নকাঠি। আর এরই বিপ্রতীপে রয়েছে মৌলবাদ। হাজার হাজার বছর আগের ধ্যানধারণা, বিশ্বাস, নীতিমালা, বিধিবিধানকে অভ্রান্ত ধরে তাকেই অন্ধ আনুগত্যে বংশপরম্পরায় একইভাবে অনুসরণ করে যাওয়ার সংস্কার ও বাধ্যবাধকতা। ভাবতে আশ্চর্য্য লাগে সতত পরিবর্ত্তনশীল এই যে জগৎ ও জীবন, সেইখানে সাম্প্রদায়িক ধর্মগ্রন্থগুলিকে অভ্রান্ত মনে করে, ধর্মীয় বিধিবিধানগুলিকে অন্ধ আনুগত্যে অনুসরণ করে নিশ্চিন্তে বসে থাকার মানসিকতা যে মানুষের পক্ষই সবচেয়ে বড়ো অগৌরবের, সেই সহজ কথাটা অধিকাংশ মানুষ অনুধাবন করে না কেন? ধর্মগ্রন্থগুলিকেও, ধর্মীয় বিধিবিধানগুলিকেও যে যুগে যুগে দর্শন ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির আলোতে সংস্কার ও পরিমার্জনের আবশ্যিকতা রয়েছে, সেই অতি প্রয়োজনীয় সত্যটি অনুভব কারার মধ্যে তো ধর্মকে অবমাননা করা হয় না। বরং ধর্মগ্রন্থের প্রতি, ধর্মীয় বিধিবিধানের প্রতি এইভাবেই প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায়। আর এইভাবেই ধর্মকে চিরসজীব রাখা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়! আসলে সাম্প্রদায়িক ধর্মগুলিকে কেন্দ্র করে একশ্রেনীর মানুষের যে পেশা ও ব্যবসা গড়ে উঠেছে, তারাই ভয় পায় এই সংস্কারমুখী মানসিকতায়। তাদের ভয়, মানুষের মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞানের আলো যত বেশি ঢুকবে, তত মানুষকে নিজেদের বশে রেখে দুইয়ে নেওয়া যাবে না। আর সেই কারণেই ধর্মের এই ঠিকাদাররাই মানুষের অন্ধবিশ্বাসে পোষকতা দিয়ে নিজেদের ব্যাবসাটিকে সতত সচল রাখে। আর তাদের এই পেশার সমৃদ্ধির প্রয়োজনেই মৌলবাদ একটি অপরিহার্য হাতিয়ার তাদের কাছে।

তবু যার চোখে দেখতে পায় স্পষ্ট। যাদের চেতনায় এখনো তালাচাবি দিতে পারেনি কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মই, যারা প্রশ্নহীন আনুগত্যে কোনো রকম অন্ধবিশ্বাসের কাছে বন্ধক রাখে না তাদের মৌলিকত্ব; তারা তো প্রশ্নবিদ্ধ করবেই সমস্তরকম অচল অটল স্থবির ধ্যানধারণাকেই। সুস্পষ্ট দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোতেই যাচাই করে নিতে চাইবে সবকিছুই। তাদেরকে অবিশ্বাসী বলে, নাস্তিক বলে অভিযুক্ত করা সহজ। কিন্তু অসম্ভব তাদের যুক্তিগুলিকে ভুল প্রমাণ করে খণ্ডন করা! আর তখনই আতঙ্কিত ধর্মব্যবসায়ীদের মৌলবাদী খাঁড়া নেমে আসে অতর্কিতে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয় নিরস্ত্র মানুষের কথা বলার অধিকার। তছনছ করে দেয় মানুষের সমস্ত মৌলিক অধিকার! তবু কিন্তু পরাস্ত করতে পারে না মৌলিক প্রশ্নগুলিকে। তবু কিন্তু ধ্বংস করতে পারে না মুক্ত চেতনার নিরন্তর বিকাশের ধারাটিকে। মানুষটি চলে যেতে পারে, কিন্তু রয়ে যায় তার চেতনার আলোটি। তাই মৌলবাদ তথাকথিত নাস্তিকের প্রাণ নিতে পারলেও মুক্তচিন্তার ধারাবাহিক বিকাশকে বিনাশ করতে পারে নি কোনদিন!

কাল্পনিক ঈশ্বরের উপর অন্ধ বিশ্বাসে ভরসা করার মধ্যে মানুষের কোন গৌরব নেই। মানুষের গৌরব জগৎ ও জীবনকে নিরন্তর অনুসন্ধানের মধ্যেই। মানুষের গৌরব, নিজের মৌলিক চিন্তাভাবনার অমেয় শক্তিকে নিরন্তর পরিপুষ্ট করে তোলার প্রয়াসের মধ্যেই। কে কতটা সফল হলেন সেটা তত বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা নিজের বুদ্ধিবৃত্তির উপর কে কতটা আস্থা রাখতে পারলেন সেইটিই। আর নিজের উপর, নিজ সত্ত্বার মৌলিকতার উপর, নিজ বুদ্ধিবৃত্তির উপর এই আস্থা রাখাই প্রকৃত আস্তিকতা। সমাজ সংসার তাকে যতই নাস্তিক অপবাদ দিক না কেন! বরং নিজের উপর যাদের কোনরকম আস্থা নেই, তারাই আজীবন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে সাম্প্রদায়িক ঈশ্বর বিশ্বাসের অন্ধ আনুগত্যের চোরাবালির উপর। প্রকৃত বিচারে নাস্তিক তো তারাই! তাই সাম্প্রদায়িক ধর্মে আস্থা রাখাই নাস্তিকের ধর্ম! সমাজ সংসার যাই বলুক না কেন। কাল্পনিক বিশ্বাসের অন্ধ আনুগত্যে নিজেকে না ঠকিয়ে জ্ঞানের আলোকিত পথে নিজের মৌলিক বুদ্ধিবৃত্তির উপর আস্থা জ্ঞাপনই আস্তিকের ধর্ম। সময় এসেছে, আমাদের এতদিনের পারিভাষিক এই ভুলটিও সংশোধন করে নেওয়ার।

শ্রীশুভ্র
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৯:৩৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×