somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মপরিচয়ের সঙ্কট ও বাঙালি মুসলিম

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





বাংলার একটি সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস সম্বন্ধে, অল্পবিস্তর আমরা সকলেই অবহিত। কিন্তু আবহমান কালের ধারাবাহিকতায় আমরা অনেকেই ভুলে যাই যে, আমাদের ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্টই হলো বৈদেশিক জাতির কাছে ক্রমান্বয়ে বশ্যতা স্বীকার করা। আর ক্ষমতাধর শাসকের বশ্যতা স্বীকারের এই ঐতিহ্যই বাঙালির মূল ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার। সময়ের স্রোতে যে কালে যে বৈদেশীক ক্ষমতা বাংলা ও বাঙালির উপর প্রভুত্ত স্থাপন করেছে, বাঙালি তখন তারই বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে প্রশাসকের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়ার প্রয়াস করেছে। ভালোবেসে ফেলেছে। এবং ক্রমে তাকে আত্মস্থ করে নিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে। অনেকেই বলবেন একথা সম্পূর্ণ সত্য নয়, তাঁরা বারো ভুঁইয়ার ইতিহাসের উল্লেখ করবেন। তাঁরা তুলে ধরবেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বলবেন আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের কথা। বলবেন না, পাশাপাশি ভারতস্থিত পশ্চিমবাংলার কথা। বলবেন না আরও আনেক কিছুই। কিন্তু একথা ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য যে, বাংলা ও বাঙালির মূল ইতিহাস বশ্যতা স্বীকারের ইতিহাস। এইখানে আমি প্রখ্যাত গবেষক ও প্রাবন্ধিক ডঃ আহমদ শরীফের ‘বাঙালির ইতিহাস সন্ধানে’ প্রবন্ধের পঞ্চম অনুচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না। উনি লিখছেন; “…..বহুকাল এই দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষ অভিন্ন জাতিসত্তায় সংহত হতে পারে নি। বরং বিভিন্ন বিদেশীয় আঞ্চলিক শাসনে ক্লিষ্ট, আত্মপ্রত্যয়হীন মানুষ আত্মমর্যাদালাভের বিকৃত বাসনায় মিথ্যা পরিচয়ে আত্মতুষ্টির যে পথ অবলম্বন করেছিল তা পরিণামে আত্মহননের নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেননা, এতে জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রায় চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে। ঐ বৈনাশিক সংস্কারের প্রভাব আজো আম্লান। বাঙালীমাত্রেই তাই সত্য পরিচয় স্বেচ্ছায় পরিহার করে আঙ্গীকৃত সরকার ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিকে স্বদেশ এবং শাস্ত্রকার ও শাসকের স্বজাতি বলে জেনে আত্মপ্রোবধ পেতে থাকে। তাই এদেশে বৌদ্ধমাত্রেই ছিল মগধী, ব্রাহ্মণ্যবাদীমাত্রেই আর্যাবর্ত ব্রহ্মবর্তের আর্য। মুসলিম মাত্রেই আরব-ইরানি কিংবা মধ্য-এশিয়। ফলে আজো শিক্ষিত অভিজাত বাঙালিমাত্রেই চেতনায় প্রবাসী ও বিদেশীয় জ্ঞাতিত্বগর্বী, তাই ভিন্নমতের প্রতিবেশীমাত্রেই পর”। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অনেকেই বাঙালির এই ঐতিহাসিকতার প্রামাণ্যতা নিয়েই তর্ক তুলে দেবেন। কিন্তু তাঁদের সেই তর্কে না ঢুকেও বাংলা ও বাঙালির মূল ইতিহাস সন্ধান করলেই ডঃ আহমদ শরীফের প্রতিটি কথারই প্রমাণ পাওয়া যাবে। শরীফের এই বক্তব্য থেকে দুটি প্রধান বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি হল, বাঙালি কোন কালেই ‘অভিন্ন জাতিসত্তা’য় সংহত হতে পারে নি। আর তার মস্তবড়ো প্রমাণস্বরূপ স্বগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই বাংলার মধ্যবর্তী সুদীর্ঘ ও সুদৃঢ় রাজনৈতিক কাঁটাতারের নিশ্ছিদ্র বেড়া। এবং দ্বিতীয় প্রধান বিষয়টি হল বাঙালি চিরকালই ‘মিথ্যা পরিচয়ে’র বলয়েই আত্মতুষ্টি লাভ করতে অভ্যস্থ। আবহমান কালব্যাপি একটি জাতি যদি ক্রমাগত ভাবে বিভিন্ন বৈদেশীক শাসকের ভাষা ও সংস্কৃতির বশ্যতা স্বীকার করতেই অভ্যস্থ হয়ে যায়, তখন সেই জাতির পক্ষে আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান আর সম্ভব হয় না। বরং স্বকল্পিত মিথ্যাপরিচয়ই তার অস্তিত্বে সত্য হয়ে ওঠে। বাঙালির জাতীয় জীবনে এইটিই অন্যতম প্রধান অভিশাপ। আর এই অভিশাপের পথ দিয়েই বাঙালি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব ধরে নানান রকমের বৈদেশিক সংস্কৃতির বশ্যতা স্বীকারের মধ্যে দিয়ে একাধিক গোষ্ঠীতেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সেই কারণেই বাঙালির কোন অভিন্ন জাতিসত্তা গড়ে ওঠেনি। বাংলা ও বাঙালির এটাই মূল ইতিহাস।

না বাঙালির ইতিহাস নিয়ে নতুন করে বলার বিশেষ কিছুই নাই, এই প্রবন্ধের বিষয়ও সেটি না। কিন্তু বাঙালির ইতিহাসের এই মূলসূত্রটুকু স্মরণে না রাখলে পরবর্তী আলোচনার ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। এই প্রবন্ধের বিষয় বাঙালি মুসলিমের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট। অনেকেই তীব্র প্রতিবাদ করে উঠবেন। বলবেন বাঙালি মুসলিমের আত্মপরিচয় তার ধর্ম ইসলামেই। তাই আত্মপরিচয়ের সঙ্কটের কোন প্রশ্নই ওঠে না। যতদিন ইসলাম রয়েছে ও থাকবে, বাঙালি মুসলিম ততদিন তার ইসলামী আত্মপরিচয়েই গৌরবান্বিত হয়ে রইবে। এমনটাই বলবেন অধিকাংশ মানুষ। বলবেনই তো। আর সেইটিই নিয়ে আমাদের আলোচনা। কেন বাঙালি মুসলিম ইসলামের মধ্যেই তাঁর আত্মপরিচয় অনুভব করে? আমরা অনেকেই ভুলে যাই ইসলাম একটি বিদেশী ধর্ম। অনেকেই আবার তর্ক করবেন, ধর্মের আবার দেশি বিদেশী কি? তাঁরা আদৌ খেয়ালই করেন না, ধর্ম মূলত একটি আঞ্চলিক সংস্কৃতি। যা প্রধানত কোন একটি বিশেষ অঞ্চলেই প্রথমে সংহত হয়ে ওঠে। তারপর রাজনৈতিক শক্তির উপর ভর দিয়ে মূলত সাম্রাজ্যবাদের পথ দিয়েই ধর্ম আবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ে। এইটাই ধর্মের ধর্ম। আর ঠিক এইভাবেই খৃষ্টধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল প্রাচীন ইউরোপে ও আধুনিক আমেরিকার দুই মহাদেশে। এই ভাবেই আরবের ইসলামী সংস্কৃতি ইসলাম ধর্মের আবরণে ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া সহ বিশ্বের নানা প্রান্তেই। ফলে ভারতীয় উপমাহাদেশেও ইসলামী সংস্কৃতি ধর্মের আবরণেই প্রবেশ করেছিল। কিন্তু করেছিল সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিকে হাতিয়ার করেই। একথা ইতিহাস স্বীকৃত। আমরা সকলেই জানি। তাই বাংলাদেশেও তুর্কী বিজয়ের হাত ধরেই সম্পূর্ণ বৈদেশিক এই ইসলামী সংস্কৃতি ধর্মের আবরণেই প্রবেশ করে। ঐতিহাসিকগত কারণেই জাতপাতে শতধা বিভক্ত বাংলার জনগোষ্ঠীর নিপিড়ীত নির্যাতিত অর্থনৈতিক ভাবে বংশানুক্রমিক ধারায় শোষিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষই বৈদেশিক ইসলামের আশ্রয়ে ছুটেছিল মূলত সামাজিক বৈষম্য ও অর্থনৈতিক শোষনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার স্বপ্নে। গোটা বাংলায় ইসলামের প্রসার ঘঠেছিল এইভাবেই। আর শতশত বছর ধরে এইভাবে প্রসারিত ও বিস্তৃত হতে হতেই বৈদেশিক ইসলাম ও তার আরবীয় ও মধ্য প্রাচ্যের সংস্কৃতিকেই বাঙালি মুসলিম তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি বলেই ধরে নিতে অভ্যস্থ হয়ে গেল। কালক্রমে এই সর্বগ্রাসী অভ্যাসের ফলেই বাঙালি মুসলিম মাত্রেই আরবী নামে পরিচিত হতেই গৌরব বোধ করতে শুরু করলো। ঠিক যে কারণেই, বাঙালি মুসলিমদের নামকরণ হয় আরবী নামে। আজকের অধিকাংশ বাঙালি মুসলিম তাই ভাবতেই পারে না যে, একদিন তাঁর পূর্বপুরুষরা কিন্তু আদৌ মুসলিম ছিল না। তাঁদের নামকরণও বৈদেশিক আরবী ভাষায় হতো না আজকের মতো। বাঙালি মুসলিম তাঁর নামের মধ্যে যেদিন থেকে এইভাবে বৈদেশীক আরবী সংস্কৃতিকেই ধারণে অভ্যস্থ হয়ে পড়লো, সেদিন থেকেই মূলত তাঁর আত্মপরিচয়ের সঙ্কটের শুরু। সে ভুলেই গেল যে বৈদেশিক ইসলাম এই বাংলার মাটিতে উদ্ভুত নয়। সে ভুলে গেল ইসলামী সংস্কৃতি আরব ও মধ্য-প্রাচ্যের সংস্কৃতি। সে ভুলে গেল যে আরব ও মধ্যে প্রাচ্যের সংস্কৃতির সাথে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির কোনরকম আত্মিক যোগ ছিল না আদৌ। বাংলা ও বাঙালি ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাছে বশ্যতা স্বীকারে মধ্যে দিয়েই এই বিদেশী সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ঠিক যেভাবে ব্রিটিশের কাছে বশ্যতা স্বীকারের মধ্যে দিয়েই বাঙালির কাছে ভাষা হিসাবে ইংরাজী হয়ে উঠেছে একান্ত আপন। এতটাই আপন যে শিক্ষিত বাঙালি মাত্রেই তাঁর সন্তানকে মুখে বুলি ফোটার আগেই এ ফর অ্যাপেল বি ফর ব্যাট শিখিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। এই যে আমার থেকে অধিকতর ক্ষমতাধরের ভাষা এবং ধর্ম ও সংস্কৃতির কাছে বশ্যতা স্বীকার করে আত্মসমর্পন, এটাই জাতি হিসাবে বাঙালির মূলগত প্রকৃতি।

আজকের বাঙালি মুসলিম তাই বৈদেশিক ইসলামী সংস্কৃতির কাছে বংশগতভাবেই বশ্যতা স্বীকারের ঐতহ্যকে আপন উত্তরাধিকার মনে করে নিজের মুসলিম পরিচয়ে গৌরবান্বিত। সেখানেই তাঁর আত্মপরিচয়ের নোঙর! একটি জাতির বৃহত্তর অংশ যখন এইভাবে কোন বিদেশী ধর্ম ও ধর্মের হাত ধরে গড়ে ওঠা সামাজিক সংস্কৃতির মধ্যেই আত্মপরিচয়ের নোঙর ফেলে দেয়, সেই জাতির সামগ্রিক ভাবেই তখন বড়ো দুর্দিন। বাংলায় তুর্কী বিজয়ের হাত ধরে সেই যে দূর্দিনের শুরু আজও তা প্রবলভাবেই সত্য। অধিকাংশ বাঙালি পাঠকই এই মতের তীব্র বিরোধিতায় সরব হবেন। আর সেটাই স্বাভাবিক। শত শত বছর ধরে বৈদেশিক ধর্ম ও সংস্কৃতির বশ্যতা স্বীকারের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারে আজ বাঙালি মুসলিমের পক্ষে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব। আর একটি জাতির বৃহত্তর অংশের এই দূর্বলতার পথ দিয়েই মৌলবাদের উত্থান অনেক সহজ হয়ে ওঠে। যে উত্থান জাতির সমগ্র সত্তাকেই কালক্রমে একদিন গ্রাস করে ফেলতে পারে। অধিকাংশ বাঙালিই এতকিছু ভাবনা চিন্তা করায় আগ্রহী নয় অবশ্য।

একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালেই আমরা দেখতে পাবো, আরবে ইসলাম ধর্মের উত্থানের সামগ্রিক চিত্রটা। খুব গভীর ভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস চর্চা না করলেও মূল ইতিহাসটুকু জানলেই জানা যায়, সেই যুগে আরবের ধর্ম ও সংস্কৃতির অবক্ষয়ের প্রেক্ষিতে সেই সময়ে ঐ অঞ্চলের আঞ্চলিক সমাজব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যেই ইসলামের আবির্ভাব। ঐতিহাসিক যুগপুরুষ হজরত মহম্মদ যে বৈপ্লবিক সংস্কার সাধনে অগ্রসর হয়েছিলেন, সেই সংস্কার সাধনই ইসলাম নামে পরবর্তীতে নতুন একটি ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এখন যে কোন কালেই যে কোন সমাজেই আমুল সংস্কার সাধনের চরিত্রটি রাজনৈতিক হতে বাধ্য। তাই ইসলামের জন্ম রাজনীতির হাত ধরেই। আর রাজনীতির সাথে ক্ষমতা চর্চা ও বিস্তারের সম্পর্ক পরস্পর পরিপূরক। ধর্ম হিসাবে ইসলামের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক তাই অবিচ্ছেদ্য। এই সত্যটি বিস্মৃত হলে চলবে না আদৌ। অনেকেই ইসলামকে সাম্রাজ্যবাদী ধর্ম বলেই মনে করেন। ঠিক যেমন খৃষ্ট ধর্ম। এই দুটি ধর্মই সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির উপর ভর দিয়েই আবিশ্ব প্রসারিত হয়েছে। সেটা ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য। ফলে শুধু বাঙালিই নয়, আবিশ্ব অনেক জাতির মানুষই এই দুই ধর্মকে আপন করে নিয়েছে। ফলে কোন বিদেশী ধর্মকে আপন করে নেওয়ার বিষয়টি নতুন কিছুও নয়। আবিশ্ব এমনই ঘটেছে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন দেশেই। ঘটেছে আমাদের বাংলাতেও। বাংলায় ইসলামের প্রবশের আগেও বাংলার হাজার বছরের বেশি সময়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। ফলে সেই সময়ের সমাজবাস্তবতায় ইসলামী সংস্কৃতি বাঙালির ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ ভাবেই ছিল বিদেশী ধর্ম ও সংস্কৃতি। ঠিক যেমন বৃটিশের আসার সময়ে ইংরাজী ভাষা ছিল সম্পূর্ণই বিদেশী ভাষা। কিন্তু ইসলামের প্রভাবে যেভাবে বাংলার অধিকাংশ মানুষ আপন সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে বৈদেশিক ইসলামী সংস্কৃতিকেই আপন সংস্কৃতি করে নিয়েছিল; দোর্দণ্ডপ্রতাপ বৃটিশ আসাতেও অধিকাংশ মানুষ আপন মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে ইংরাজীকে নিজ মাতৃভাষা করে নিতে পারে নি। তফাৎ শুধু এইটুকুই। এখন জাতির একটি বড়ো অংশই যখন আবহমান কালের আপন ধর্ম ও সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে কোন বিদেশী ধর্ম ও সংস্কৃতিকে আপন ধর্ম ও সংস্কৃতি করে নিতে প্রবৃত্ত হয়, খুব স্বাভাবিক ভাবেই তখন, তাকে আপন শিকড়ের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতেই হয়। এই যে আপন শিকড় ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা এর মধ্যে দিয়েই শুরু হয় আত্মবিস্মৃতির পর্ব। বাঙালি মুসলিমকে বহু যুগ ব্যাপি সময়সীমা ধরেই আত্মবিস্মৃতির এই পর্ব পেরিয়ে আসতে হয়েছে। এইভাবে আত্মবিস্মৃতির পর্বের মধ্যে দিয়েই একদিন মানুষ পৌঁছিয়ে যায় আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে। আজ বাঙালি মুসলিম এই আত্মপরিচয়ের সঙ্কটের চৌকাঠেই দাঁড়িয়ে।

স্বদেশে বসবাস করেও ভিনদেশী ধর্ম ও সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠার মধ্যে দিয়েই শুরু হয় আত্মপরিচয়ের এই ঐকান্তিক সঙ্কট। যে সঙ্কট আমাদের সচেতন প্রজ্ঞায় ধরা পরে না সাধারণত। কিন্তু চিহ্ন রেখে যায় আমাদের অবচেতনে। আর অবচেতনের সেই চিহ্নই আমাদেরকে পরিচালিত করে আমাদের চিন্তা ভাবনা ও কাজে। আমরা আগেই দেখিয়েছি, ইসলামী সংস্কৃতি আসলেই আরব দেশীয় সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের সমাজবাস্তবতার পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিতেই। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, সেই সমাজবাস্তবতার সাথে বাংলা ও বাঙালির আসমান জমিন ফারাক। প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব একটি ঘরানা থাকে। কালে কালে যার পরিবর্তন ঘটলেও মূল ধরণটা মূলত একই থেকে যায়। আর সেই ধরণেই বাঙালির সাথে আরববাসীদের বিস্তর প্রভেদ রয়েছে। আর থাকাটাই স্বাভাবিক। দুই দেশের জলবায়ু ভৌগলিক অবস্থান কোন কিছুরই মিল নাই। আর যে কোন জাতির সংস্কৃতিই গড়ে ওঠে এই ভৌগলিক অবস্থানজনিত জলবায়ুর উপর ভিত্তি করেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালি মুসলিমের চেতনায় এই সত্যটুকু ধরা পড়ে না কোনভাবেই। আর পড়ে না বলেই আজ ইসলামী সংস্কৃতিকেই আপন সংস্কৃতি করে নিতে পারা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু পরধর্ম পরদেশী সংস্কৃতিকে আপন করে নিলেও নিজের জাতিগত সত্ত্বাকে কখনোই পুরোপুরি অস্বীকার করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে নিজের দেশে বসবাস করেই যদি কেউ বৈদেশিক সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়ে চায় তখন এই জাতিগত সত্ত্বাকে মুছে ফেলা আরও অসম্ভব হয়ে পড়ে। এবং ঠিক সেই কারণেই শতশত বছর পার করেও বাঙালি মুসলিমের পক্ষে তাঁর বাঙালি সত্ত্বাকে আজও অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। যার ফলস্বরূপ বাঙালি মুসলিম না পেরেছে সম্পূ্র্ণ ভাবে ইসলামিক সংস্কৃতিকে ধারণ করে আরবী মুসলিমের দোসর হতে, না পেরেছে তাঁর বাঙালিত্বের শিকড়ে নোঙর ফেলে সম্পূর্ণ বাঙালি হয়ে উঠতে। এর ফলেই চেতনে অবচেতনে বাঙালি মুসলিমের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট হয়ে উঠেছে ঘনীভুত।

এইভাবে বাঙালিত্বের শিকড় থেকে একদিকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস, অন্যদিকে আরবের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যেই নিজের স্বকল্পিত উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রাণান্তকর প্রয়াস বাঙালি মুসলিম মানসে এক অন্তহীন দোলাচাল দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। বাংলার মুসলিম সমাজজীবনে এর সুদূর প্রসারী প্রভাবেই আজকের বাঙালি মুসলিম দিশাহারা ও দিগভ্রান্ত। সামগ্রিক ভাবে সমগ্র মুসলিম সমাজই এই কথার তীব্র বিরোধিতায় সামিল হবে প্রবলভাবেই। সেটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ বংশপরম্পরায় বিদেশী ধর্ম ও সংস্কৃতির বশ্যতায় আত্মসমর্পনের সহস্রাব্দব্যাপি ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু বাঙালি মুসলিম সমাজ যদি কোনদিন ভুল করেও নিজের আত্মপরিচয়ের শিকড়ের সন্ধান শুরু করে, একমাত্র সেইদিনই তারা সঠিক দিশার হদিশ পাবেন। তার আগে নয়। এবং সেইদিনই তাঁরা মিথ্যা আত্মপরিচয়ের স্বকল্পিত গরিমার আত্মশ্লাঘা থেকে মুক্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে। তবে তার আগে জিততে হবে নতুন এক মুক্তিযুদ্ধে। বিদেশী ধর্ম ও সংস্কৃতির বশ্যতা স্বীকারের মানসিকতা থেকে মুক্তির। অনেকেই প্রবন্ধের এই অব্দি পড়ে লেখককে স্মরণ করিয়ে দিতে উদ্যত হতে পারেন, মিথ্যা আত্মপরিচয়ের গরিমার আত্মশ্লাঘা শুধু বাঙালি মুসলিমের একচেটিয়া নয়। নয়ই তো। এই প্রবন্ধের প্রারম্ভেই ডঃ আহমদ শরীফের বক্তব্য উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে, মিথ্যা আত্মপরিচয়ের গরীমা, বাঙালির সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। এবং সেটাও আধুনিক কালের নির্দির্ষ্ট কোন ঘটনাও নয়। এই রোগ বাংলার দুই হাজার বছরের ইতিহাস। বস্তুত এই রোগের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলেছে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি। ফলে কোন সম্প্রদায়ই এই রোগ থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে এই রোগ বাঙালি মুসলিমের মতো এমন সর্বাত্মক নয়। এমন পরিব্যাপ্ত নয়। এতটা গভীর নয়। তার কারণ বাঙালির প্রকৃতিগত ধরণের মধ্যে নাই। তার কারণ ইসলামের ধরণেই নিহিত। ইসলাম সকল কিছুকেই যেমন সর্বাত্মক করে আত্মস্যাৎ করে নিয়ে নিজের সর্বময় প্রাধান্য বিস্তার করে তার উপর, এমনটা আর কোন ধর্ম করে না বলেই, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বাঙালির জীবনচর্চার পরিসরে অনেকটা ফাঁকা জায়গা থাকে মুক্ত নিঃশ্বাস নেওয়ার। অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামের তুলনামূলক আলোচনার বিষয় নয় এই প্রবন্ধ। তাই আমদের মূল প্রতিবাদ্য বিষয় একমাত্র বাঙালি মুসলিমের আত্মপরিচয়ের সঙ্কটকে নিয়েই। এখানে আরও একটি কথা পরিষ্কার করে দেওয়া ভালো, এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য ধর্ম হিসাবে ইসলামের সমালোচনা করা নয়। ইসলামের স্তুতি বা নিন্দা করাও নয়। মূল উদ্দেশ্য হলো সম্পূর্ণ বিদেশী একটি ধর্ম ও সংস্কৃতির বশ্যতা স্বীকার একটি জাতির জীবনে কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে, তারই একটি প্রথমিক ধারণা দেওয়া। প্রভাবের এই বিষয় নিয়ে আরও গভীর গবেষণার পরিসর অবশ্যই আছে। অনেকেই হয়তো পরে এই বিষয়ে মূল্যবাণ আলোকপাত করবেন তাঁদের গবেষণা কর্মের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য বাঙালি মুসলিমকে তাঁর আত্মপরিচয়ের এই সঙ্কট থেকে যেভাবেই হোক মুক্তি অর্জন করতে হবে। সে তিলি কাঁটাতারের যেপারের বাসিন্দাই হোন না কেন। আর বাঙালির সকল সম্প্রদায়ই যেদিন তাঁদের সঠিক আত্মপরিচয়ের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাবেন, সেদিই বাংলার নবজাগরণের দিন।
শ্রীশুভ্র
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:১৩
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×