somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খন্ডিত রুপকথা (শেষপর্ব)

২৩ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৮:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পরদিন বিকেলে রাজু ১১৫ নং নিউ সার্কুলার রোডের বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ায়।কিছুক্ষণ এদিক ওদিক পায়চারী করে।ছাদের দিকে তাকায়।সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সুমনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।একটু দূরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে জনাব উজির। উনারা রাজুকে খেয়াল করেন।
-সেলিনা ওই ছেলেটি গতকালও এসেছিলনা? সেলিনার মা সেলিনাকে প্রশ্ন করেন।
-হ্যাঁ মা।আজ কালকার ছেলেরা যে কি বুঝিনা।খালি মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লাফালাফি।এটাও মনে হয় তেমন।চেতনাজীবী মনে হয়।
-আর তুই কি? শহীদ বুদ্ধিজীবী?
-কি যে বলো মা?সব কিছুতেই তোমার ইয়ার্কী।
-রাখতো ওসব কথা ছেলেটাকে ডাক। সেলিনাকে তার মা বলে।
সেলিনা পারভীন নীচে নেমে আসে।দরজা খুলে রাজুকে ডাক দেয়। রাজু সেলিনা পারভীনের সাথে ছাদে উঠে আসে।
-রাজু,তুমি কেন এসেছো আমরা জানি।গল্প শুনতে চাও? কি লাভ?আজও তো আল-বদর নেতা চৌধুরী মঈন উদ্দিন বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে ধর্মের লেবাস গায়ে চড়িয়ে।
-আপা,আপনাকে কি বলবো আর,চৌধুরী মঈন উদ্দিন লন্ডনের এক মসজিদে ইমামতি করে।শুয়োরটাকে কোন ভাবেই কায়দায় আনা যাচ্ছেনা। রাজু বলে।
সেলিনার মা পিঠা নিয়ে আসেন।
-খাও বাবা পিঠা ঘরের ভাপা পিঠা।
-খালাম্মা, সেলিনা আপাকে বদর বাহিনীর কিলিং স্কোয়াড ধরে নিয়ে গিয়েছিল?
-হ্যাঁ বাবা।চৌধুরী মঈন উদ্দিন আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গো।এখনতো সব লণ্ডনে।যুদ্ধাপরাধীর যত আত্মীয়-স্বজন সব এখন লণ্ডনে।ষড়যন্ত্রের বিষ আবার তারা রান্না করছে।
-মা তুমি চুপ কর।এসব বলে কি লাভ?সেলিনা পারভীন তার মাকে বলে।
-আপা, বলতে দেন।উনার কথা আমার ভালোই লাগছে। রাজু বলে।
-শোন রাজু এই রাজাকার,আল-বদর হলো বিষবৃক্ষ।যুগের পর যুগ এরা ধর্মের মোড়কে বিষ ফল উৎপাদন করে যাচ্ছে।তা না হলো জাফর ইকবালকে হামলার শিকার হতে হয়।জাফর ইকবালের কথাগুলি চমৎকার।
-কোন কথা আপা?
-এই যে সে বুক ফুলিয়ে বলে,মুক্তিযুদ্ধ হলো একটি ফিল্টার মেশিন।এই মেশিনের ভেতর দিয়ে একটি মানুষকে ঢুকালে তাকে অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তবে সে বাঙালি।মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি।মুক্তিযুদ্ধ হলো একটি মানদন্ড।
-আপা সেদিনের কথা বলুন।
-লাভ কি?তার চেয়ে অন্য কথা শোন ।
-বলুন আপা।

কতই বা বয়স তখন আমার। চৌদ্দ বছর।বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় আমার।বছর দশেক টিকে ছিল সেই বিয়ে।আসলে ছোট থেকেই কবিতা লিখতে চেষ্টা করতাম।আর জানোইতো কবি মাত্রই বোহেমিয়ান এবং নিঃসঙ্গ।তোমার মতই।রাজু ম্লান মুখে হাসে।সেলিনা বলতে থাকে।ঢাকা আসার পর আমি রোকেয়া হল পরিচালনার দায়িত্ব নিই।সেখানেও টিকতে পারিনা।কর্তৃপক্ষের সাথে মত বিরোধ দেখা দেয়।পরে আমি বেগম পত্রিকা,ললনা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি।বিয়ে অবশ্য করেছিলাম।এক রাজনীতিবিদকে।বিভন্ন পত্রিকায় লিখে যে সন্মানি পেতাম তা দিয়ে সংসার চলতো।শেষের দিকে সবার কাছ হতে ধার দেনা করে আমি শিলালিপি প্রকাশ করি।দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা এতে লিখতেন।১৯৭১ সালে হাশেম খানের প্রচ্ছদে ওই সংখ্যাটি তৈরি করি।কিন্তু পাকিস্থানী কর্তৃপক্ষ তা স্থগিত করে দেয়।আমি রাও ফরমানের কাছে গেলে,সে প্রচ্ছদ বদলাতে বলে।আমি বদলিয়ে শিলালিপি প্রকাশ করি।আর সেটাই ছিল শিলালিপির শেষ সংখ্যা।১৩ ডিসেম্বর চৌধুরী মঈন উদ্দিন তার বদর বাহিনী নিয়ে এসে আমাকে নিয়ে যায়।টানা দুইদিন আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখে।ঘুমহীন,কোন রকম প্রাকৃতিক কর্ম ছাড়াই।আমার সাথে অনেকেই ছিল বন্দী।কি নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে বদর বাহিনী।যে চক্ষু চিকিৎসক তার চোখ উপড়ে ফেলেছে।যে লেখক তার আঙ্গুল কেটে ফেলেছে। আমাকে যখন রায়ের বাজারে নিয়ে যায় তখন আমি তাদের বলি আমার একটা শিশু সন্তান আছে আমাকে ছেড়ে দাও।ওরা আমার মুখে বেয়োনেট চার্জ করে।আমি বলার চেষ্টা করি।ওরা আমার বুকে বেয়েনেট চার্জ করে।আমি বলি-বাবা সুমন ভালো থাকিস বাবা।স্বাধীন বাংলাদেশে সুখে থাকিস বাবা।ঠিক তখন একটি তপ্ত বুলেট আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

“জানো
আমি মরতে ভয় পাইনি
ভয় পাওয়ার কোন প্রশ্নও আসেনা
আমি শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম,- আমার সন্তানের কারণে।
কতই বা বয়স ছিল তার?
- সবে পা দিয়েছিল আটে।

আমি মরতে ভয় পাইনি
ভয় পাওয়ার কোন প্রশ্নও আসেনা
আমি শুধু তোমাদের স্মরণ করাতে চাই
আমি একজন মা।আর একজন মায়ের গর্ভে
তোমাদের জন্ম।

যখন তোমরা বেয়োনেট দিয়ে ফেঁড়ে ফেললে আমার গাল
আর বুকে বিদ্ধ করলে শীতল বেয়োনেট
আমার রক্তের উষ্ণতায় উষ্ণ হলো বেয়োনেট। বেয়োনেট কি কেঁদেছিল সেদিন?
অবশ্য আমি তখন মৃত।তাই প্রশ্নই আসেনা জানতে পারার।
তোমরা যারা ছিলে বদর বাহিনীতে
স্তব্ধ করতে চেয়েছিলে বাঙালির কন্ঠকে
পেরেছো কি?

আমি মরতে ভয় পাইনি,- এতটুকু
শুধু বলতে চেয়েছিলাম
স্বাধীন দেশে আমার সন্তানের নিরাপত্তা দেবে কে?
কারণ একজন চৌধুরী মঈন উদ্দিন এখনও লন্ডনে”।


রাজু কবিতা লেখা শেষ করে।তারপর ডায়েরী ফেলে দেয় যমুনার জলে।উঠে দাঁড়ায়। দৌড় শুরু করে।প্রেম যমুনার ঘাটে যে পাকুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে সে খেয়াল করে রাজু আর দীপ্ত দৌড়ের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।ঠিক যেমন বাংলাদেশে এখন সবাই আওয়ামীলীগার।কোন জামাত নেই।কোন শিবির নেই।কোন বি এন পি নেই।

রাজু দৌড়ায়।দীপ্ত দৌড়ায়।যশোর পার হয়ে যায়।ইণ্ডিয়াতে প্রবেশ করে।লক্ষ লক্ষ শরণার্থী তাদের দিকে চায় লাল চোখ নিয়ে।চোখে তাদের জয়বাংলা রোগ।দৌড় ।দৌড়। ভারতীয় শিশুরা ছড়া কাটছে।
“জয়বাংলার লোক
ঢ্যালা ঢ্যালা চোখ
আতপ চালের ভাত খেয়ে ক্যাম্পে গিয়ে ঢোক”।

দৌড়। দৌড়।ছড়াও দৌড় দেয় শরণার্থীর পিছে।আচমকা শরণার্থী হিরণ্ময়ী চিৎকার করে ওঠে-
“ইণ্ডিয়ার লোক
ফুলা ফুলা চোখ
আলা চাউলের ভাত খাইয়া খুপরীতে গিয়া ঢোক”।

মার্চ,২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১০:০০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×