গতকালের খবর বিবিসি বাংলায় দেখলাম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে দুই মুসলিম ব্যাক্তিকে গরুর চালান বহন করার অপরাধে ঐ দুই ব্যাক্তিকে দুধ ও দইয়ের সাথে গরুর মুত্র মিশিয়ে খাওয়ান সেখানকার কিছু উগ্র হিন্দু । প্রথমত জোর করে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে মহৎ কিছু তো ঐ হিন্দুরা করেই নি বরং হিন্দুদের জন্য এটা লজ্জাজনক ব্যাপার । ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে আরেকটা অধর্ম করা মোটেও সমীচীন নয় । দ্বিতীয়ত ঐ দুই মুসলিম ব্যাক্তি, গরুর চালান বহন করে তারাও আইন অমান্য করে তারাও একটা অপরাধ করেছে কেননা আইনগতভাবে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে গো হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল । গো হত্যা নিয়ে এসব খবর নতুন কিছু নয় । আখলাকের খবর হয়ত আপনারা সবাই শুনেছেন । এই নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে যে তুমুল ঝড় হয়েছিল সেই ঝড়ের কিছুটা হাওয়া বাংলার বাতাসয়েও বয়েছিল । বাংলাদেশের প্রথম সারির পত্রিকা গুলো যতটা গুরুত্বের সাথে এই খবর তুলে ধরেছিল তার তুলনায় বাংলাদেশের মালোয়ন ঘড়ের গনিমতের মাল তুলসি রানী দাসের পেটে লাথি মেরে গর্ভপাত করার ঘটনা পত্রিকার পাতায় তেমন একটা গুরুত্ব পায় নি । আবার আমাদের ষড়রাষ্ট্র মন্ত্রি বলেছেন এটা নাকি বিচ্ছিন্ন ঘটনা । অছাম্পদায়িক দেশ বলে কথা(!) গরু নিয়ে যেমন ভারতে মুসলিমরা নির্যাতন হয় তেমনি বাংলাদেশেও গরু নিয়ে মানসিক টর্চার এর শিকার হয় এদেশের হিন্দুরা ।
আমি যখন প্রথম শহরে আসি লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে তখন আমি কোন এক মুসলিম ম্যাসে ছিলাম । ওখানে যিনি রান্না করেন মানে কাজের বুয়া উনিও আমরা তিন জন অমুসলিম ছিলাম বলে গরু না খাওয়ায় খোটকা দিতেন ।মাঝে মাঝে তো অামাদের জন্য কিছু অালাদাভাবে রান্না করতে হয় বলে সেই রাগান্বিত হয়ে কথা বলতেন । অনেক মুসলিম ফ্রেন্ড তো গরুর মাংস না খাওয়ায় পুরুষত্ব শক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতো । গরুর মাংস খেলে নাকি শরীরের হিট বাড়ে, যৌনসম্পর্ক নাকি দীর্ঘস্থায়ী হয় এরকম হাজারো উপকারিতা দেখাত ।আবার বলত আমার গ্রামে ওমুক হিন্দু লোকটা গরুর মাংস খায়,সেদিনও এক হিন্দু ছেলের সাথে হোটেল এ গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম ব্লা ব্লা ব্লা...। আমার গরুর মাংস নিয়ে তেমন চুলকানি নেই, কিন্তু খাদ্যাভ্যাস বলে তো একটা কথা আছে তাই না ? যেই কোরিয়ানদের কাছে কুকুরের মাংস অধিক প্রিয় সেই কুকুরের মাংস বাঙ্গালিরা খাবে কখনও সেটা কল্পনা করা যায় (!)
অনেক মুসলিমই বলে থাকে বাংলাদেশে নাকি হিন্দুরা শূকরের মাংস খায় এ নিয়ে তো মুসলিমরা কাউকে মারতে যায় নি , তারা তো শূকর খাওয়ায় বাধা দেয় না এভাবে হাজারো কথা বলে নিজেকে প্রমান করে হ্যা; আমরা বাংলাদেশি মুসলিমরা অনেক উদার(!) তাদের এই অসাম্প্রদায়িক মনভাবাপুর্ণ কথাগুলো কেউ কোন দিন গভীরভাবে ভেবে দেখেছেন ? সত্যি তাই তো বাংলাদেসে এ পর্যন্ত কোন হিন্দুকে শূকর খাওয়ার জন্য তো কোন মুসলিম কোন হিন্দুকে মেরে ফেলে নি । তাহলে কি মুসলিমরা সত্যি অসাম্প্রদায়িক ??
আমি আমার নিজের কথাই বলছি এ পর্যন্ত শুধু একবারই শূকরের মাংস খেয়েছি । বাড়িতে মা রান্না করলেও মা খায় নি । বাড়ির মধ্যে শুধু বাবা আর আমি খেয়েছিলাম । খেয়ে এমন অবস্থা হয়েছিল যে বমি বমি ভাব ভিতর থেকে উকি দিচ্ছিল । সেইদিনই কান ধরছি আর কখনও শূকরের মাংস খাব না । শূকরের মাংস খাওয়ার ঘটনাটা গত সাত বছর আগের হবে । বেশ ছোট ছিলাম, অত কিছু বুঝতাম না । বাবা মা দুজনেই বলেছিল শূকরের মাংস খাওয়ার কথা যেন বাহিরে কাউকে না বলি । এখন বুঝতেছি কেন আমার বাবা মা আমাকে এসব কথা বাহিরে বলতে মানা করেছিল । বললেও হয়ত কোন মুসলিম আমাক আক্রমন করত না , কিন্তু নীতিগতভাবেই কেন জানি কোন মুসলিম বন্ধুর কাছে শূকরের মাংস খাওয়ার কথা বলতে খুব খারাব লাগে । নিজের ভিতর থেকেই খারাব লাগা অনুভূতিটা কাজ করে যখন ভাবি যে এই শূকরের মাংস তো আমার মুসলিম বন্ধুটি খায় না । আবার শুনেছি এই শূকরের কথা বললেই ওদের নাকি ৪০ দিন মুখ নাপাক হয়ে যায় । আমি খুব ভালভাবেই খেয়াল করেছি পাশের বাড়ির মুসলিম চাচী টা যখন আমার মা কিংবা কোন হিন্দু মহিলার সাথে গল্প প্রসঙ্গে কি দিয়ে খাওয়া দাওয়া হইল প্রশ্ন টা চলে আসে তখন মুসলিম চাচী টার গলার আওয়াজ একটু উচু স্বরেই বলতে শুনা যায়, গরুর মাংস রান্না করেছে আজ ।
আপনারা যারা শূকরের মাংস খাওয়ায় বাংলাদেশে হিন্দু হত্যা হচ্ছে না বলে বড় বড় ফাকা বুলি ছেড়ে নিজেকে খুবই মানবিক প্রমান করতে চাইছেন । থামেন, অত মানবিক সাইজেন না । প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে শূকরের মাংস খুব কম সংখ্যক হিন্দুরাই খায় । আমি এ পর্যন্ত অনেক হিন্দুকেই বলেছি শূকরের মাংস খেয়েছে কিনা । কেউ কেউ তো উত্তর দিয়েছে শূকরের মাংস মানুষ খায় নাকি ? আমি কি শূকরের মাংস খাওয়ার অভ্যাস করতে পারতাম না ? যেমন ব্রয়লারের মাংস প্রথম দিন যখন খেয়েছিলাম বমি করে ফেলছি , আর সেই ব্রয়লারের মাংস দিয়েই প্রতিদিন প্রায় মেসে খাই ।এখন আপনারা যারা ভাবতেছেন শূকরের মাংস বাংলাদেশে হিন্দুরা খেলেও তাদের উপর হামলা করবে না মুসলিমরা । আমি বলব আপনাদের ভাবনা একদম ভুল । যেই মূর্তিপূজা ইসলামে হারাম বলে শরতের মৌসুম আসতে না আসতেই মূর্তি ভাঙ্গার মৌসুম শুরু হয় সেই মুসলিমরা যাদের শূকর কথাটা মুখে আনলেই নাকি ৪০ দিন মুখ নাপাক থাকবে আর শূকরের মাংস হিন্দুরা খাবে আর তারা হারাম জিনিসটাকে পথে চলতে গিয়ে দেখতে পেলে তারা চুপ করে বসে থাকবে এই ভাবনাটা কি বোকামি নয় ?
হিন্দুদের যেমন গরুর মাংস নিয়ে চুলকানি আছে ঠিক তেমনি মুসলিমদের শূকরের মাংস নিয়েও চুলকানি আছে । ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসনামলের ইতিহাস পড়লেই কিন্তু আমরা সেটা বুঝতে পাই । গরু, শূকরের মাংসের মধ্যে যে হিন্দু,মুসলিমদের চুলকানি রয়েছে সেই চুলকানিকে কাজে লাগায় ইংরেজরা কার্তুজ আইন করে কিন্তু আরও ১০০ বছর তাদের শাসন কায়েম করতে পেরেছিল । এই দুই প্রকার চুলকানির মধ্যে গরু ভিত্তিক চুলকানি হিন্দুদের মাঝে শোনা গেলেও শূকর ভিত্তিক চুলকানি মুসলিমদের মাঝে শোনা যায় না কারন হিন্দুরা মানবিকতার খাতিরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের আদর্শের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল বলে ।গরু ভিত্তিক এই চুলকানির শিকড় সর্বপ্রথম কোথায়,কিভাবে ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল সেটা যদি আমরা জানতে চাই তবে আমরা আরও একটু পিছনের ইতিহাস তাকালে দেখতে পাই, যখন বখতিয়ার খলজি এই ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের সুত্রপাত ঘটান তখন তিনি এদেশের হিন্দুদের গরুর প্রতি কোন এক কারণবসত হিন্দুদের যে শ্রদ্ধাবোধ সেটাতে আঘাত হানেন । তিনি অনেক মন্দিরেই গরুর রক্ত ছিটিয়ে মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করেছেন । জিহাদের নামে তিতুমির ইতিহাস সম্পকির্ত পাঠ্য বইগুলোতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই বললেও তিনি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং তিতুমির ও গরুর রক্ত মন্দিরে ছিটিয়েছেন । তুই ব্যাটা বিরোধিতা করবি ভাল কথা, গরুর রক্ত মন্দিরে ছিটিয়ে এটা কেমন বিরোধিতা । তাহলে বোঝাই যাচ্ছে রাজনীতিতে গরু ভিত্তিক ইস্যু টাকে মুসলিমরাই কিন্তু প্রথম সৃষ্টি করে ।
যদি মুসলিমরা আরবের মরুভুমি থেকে আসার পূর্বেই গরু খেতো সেটাও একটা কথা ছিল যে খাদ্যাভাস জনিত কারনে তাদের গরুর মাংস অতি প্রিয়, হিন্দুরা এতে বিরোধিতা করার কে ? কিন্তু সেটা তো না । হযরত মুহম্মদ(সাঃ) জীবনে আরবের মরুভূমিতে হাম্বা ডাক শুনেছিল কিনা সন্দেহ । না শুনারই কথা ,কেননা গরু তো মরুভুমির প্রানি নয় । মুলত গরুর মাংস প্রথমদিকে যতটা না সুস্বাদুর জন্য মুসলিমদের প্রিয় ছিল তার চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল হিন্দুদের খোটকা মেরে গরুর মাংস খেতে ।আজকের দিনে যেমন গরুর মাংস খাই না বলে প্রায়ই মুসলিম বন্ধুদের খোটকা খেতে হয় । ভারতে খ্রিস্টান রাও তো গরুর মাংস খায় কিন্তু কেন তাদের পিটানো হয় না সেটাও ভাববার বিষয় ।যাইহোক ঐদিকে আর বেশি এগুচ্ছি না । আমি সবারই ব্যাক্তি স্বাধীনতার পক্ষে । কে কি খাবে সেটা একান্তই ব্যাক্তির ব্যাপার । কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটু সীমাবদ্ধতা থেকেই যায় । আমরা যে যত বেশি ছাড় দিতে পারব ততো সবারই জন্য মঙ্গল । এক্ষেত্রে বাংলাদেশের হিন্দুদের মত সংখ্যা গরিষ্ঠের কথা ভেবে ভারতের মুসলিমরা গরুর মাংসের ব্যাপারে একটু মানবিক,সহানুভুতিশীল হলেই পারে এতে তাদের জন্যই ভাল হবে । অন্তত কোরানের অনেক আয়াতেই অনেক বিধি নিয়ম থাকলেও মুসলিম হতে গেলে গরুর মাংস খেতেই হবে এমন কোন আয়াত আমার জানা মতে নেই ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৬ রাত ১২:৫২