ম......
সন্ধ্যার আগেই প্রতিদিন ঘরে ফেরে ‘টুনু’ কিন্তু একদিন আর ফিরলনা। লোকজন সব ফিরে এসে জানাল- কোথাও পাওয়া গেলনা। এবার উকিল সাহেব নিজেই বেরুলেন। বাজারের মধ্যে এসে ডাক দিতে একটি বন্ধ মদের দোকান থেকে সাড়া মিলল। এবার পৌ্র চেয়ারম্যানের কন্ঠে হুকুম দিলেন- হয় দোকানদারকে হাজির কর আর না পেলে দোকানের তালা ভেঁঙ্গে ফেল। দোকানদার এসে তালা খুলে বলল- হুজুর আমি না দেখে দোকান বন্ধ করে চলে গেছি। যাক! ‘টুনু’ ঘরে ফিরে এল। কিন্তু ওর যাওয়ার দিন এসে গেল ক্ষন এসে গেল। কিন্তু ওকে টেনেও নেওয়া যায়না, শুধু দোতালার বারান্দার দিকে চায়। উকিল সাহেব বারান্দার রেলিং ধরে ধরা গলায় বললেন ‘যাও, আবার এস’- তারপর অশ্রু সজল নেত্রে ঘরে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আর ‘টুনু’ও এগিয়ে গেল, চোখ থেকে তখন তার পানি গড়িয়ে পড়ছে। কোরবানী হয়ে গেল।
বছর খানেক পরে উকিল সাহেবের ঘরে বহু প্রতিক্ষার পর এল সন্তান- একমাত্র পুত্র। তার ডাকনাম রাখা হল ‘টুনু’- ছাগলের নামে নাম। আজ সে সন্তান বুঝতে পারছে কত সার্থক তার নাম! ইমাদুদ্দীন সাহেব(উকিল সাহেব) বড় দুরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন বলে মনে হয়! পুত্রের বয়স যখন মাত্র চার, ইমাদুদ্দীন সাহেব মহাসমারোহে ধরাধাম ত্যাগ করলেন মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে। চলে গেলেন তাঁর পিতৃ-সকাশে, সদরুদ্দীন সাহেবের কাছে। শিশুটি সংসার সমুদ্রে একটি ডিঙ্গি নৌকায় ভাসতে লাগল- চারদিকে কত হাঙ্গর, কুমীর এর বৈরী হুংকার। এল প্লাবন, হল বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ। শিশুটি তখন যৌবনের দ্বারপ্রান্তে, কিন্তু ঠিকানা হারিয়ে গেল তার, হারিয়ে গেল তার অমূল্য অতীত। তার অতীতে কেউ ‘চাকর’ ছিলনা। সদরুদ্দীন সাহেব ছিলেন রেশম ব্যবসায়ী, কারখানার মালিক। তাঁর জেষ্ঠ পুত্র ছিলেন আইন ব্যবসায়ী, ভ্রাতস্পুত্রও তাই। কিন্তু সেই “ছাগল” হল চাকর।
মহাজনদের পাঁচশ শমিকের একজন- নাম ঝাঁটু। ১৯৫৪ সাল। বগুড়ায় প্রদর্শনী মেলা চলছে। রাজশাহী সেরিকালচারের ষ্টলের চার্জে এক পৌড়ের সাথে দেখা। খুব ওম করে সিগারেট ফুঁকছে। ‘কে ঝাঁটুনা’?- কিশোরের প্রশ্নে এক ঝটকায় সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁঁড়িয়ে সালাম করে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল- মহাজনজী আপনি! কুশলবার্তা বিনিময়ের পর জানলাম সে নামের শেষে ‘শেখ’ লাগিয়ে জাতে উঠেছে এবং সুপারভাইজারের পদে চাকরী করছে। কালের আবর্তনে মালিক শ্রমিক আজ দু’জনেই গোলাম। কেউ চিড়িতনের আর কেউবা ইস্কাবনের- কিন্তু গোলামতো বটে!
পালটে গেল অতীত, শুরু হল নতুন ইতিহাসের বিচিত্র অধ্যায়। কিন্তু হারিয়ে গেল ঐতিহ্যের পরিচয়। ইমাদুদ্দীন, সদরুদ্দীন হারিয়ে গেল বিস্মৃতির গর্ভে।
বনভোজন(পোষাড়ু) এর সময় অর্থাৎ পৌষ মাসে গ্রামীন ছেলেদের মুখে শীতের রাতে আর শোনা যাবেনা কত যুগ আগে কোন অজ্ঞাত লোক দ্বারা রচিত ভিক্ষা সংগীত- “বল ভাল্ ভোল্ ভোল্ ভাল্ ভোল ভোলারে ভাই, চলরে রাখাল রাজা ফুল তুলিতে যাই”। মহাজনেরা পাকা(পাকা বাড়ী) দিলে ঝিকিমিকি করে
আর মাতু মোড়ল(পাশের গ্রামের এক প্রতিযোগী) পাকা দিলে ধ্বসে ধ্বসে পড়ে।
মাতু মোড়ল চিমনী(রেশম কারখানার) দিলে কেউনা ফিরে চান(অর্থাৎ খুব ছোট)
মহাজনেরা চার ভাই বড়ই বুদ্ধিমান
তাইতো তারা চিমনী দিলে আসমান সমান।
বল..................
কিংবা এইতো দেশভাগের কেবল আগে ইমাদুদ্দীনের চাচাতো ভাই সাজ্জাদ আলী ৭নং ওয়ার্ড থেকে কমিশনার নির্বাচিত হলেন, দু’জনের মধ্যে অন্যতম অমনি কবিয়াল গুমানী দাওয়ান ও লম্বোদর চক্রবর্তীর কবি গানের ধুয়া হ’ল—
“সাত নম্বরে পাশ করিল সাজ্জাদ আলী ভোলা(ভোলানাথ সাহা)
তোরা সব দেখরে ভাই ভোট গোলডিং এর খেলা”
এ সব গল্প হয়ে গেল। পথের মাঝে দাঁঁড়িয়ে এক যুবক। আপন বলতে পাশে কেউ নেই। শুরু হল যুদ্ধ। বাঁচার যুদ্ধ। নতুন করে আপনজন সংগ্রহ করার প্রয়াস পেল সে। কিন্তু বাস্ত যে একবার হারায় তার মত হতভাগা আর কেউ হয়না। তার ভাগ্যে জোটে বঞ্চনা আর অবহেলা। তাদের প্রতিযোগিতেয় না পেরে বাধ্য হয়ে গ্রহন করে বটে, কিন্তু আপন করে কেউ নেয়না। অথচ একটা দেশকে গড়তে তাদের অবদানই থাকে উল্লেখযোগ্য। চেয়ে দেখ আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়ার দিকে। এদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু স্বীকার করতে চায়না এরা। পরের পত্রে লিষ্টটা জানাব।
তোমাদের জন্য একটা base করে দিতে চেয়েছিলাম এদেশে কিন্তু হ’লনা- মানুষ এত স্বার্থান্ধ হলে কি আর হয়! প্রয়োজন পড়লে আমাকে স্মরন করা হয় আর সেটা পুরন হলেই পাই বা পেয়েছি অবহেলা, বঞ্চনা আর অপমান। করা হয় আমাকে সামাজিক ভাবে বিদ্ধস্ত। তাতে আমি নিজেকে অত্যন্ত একাকী ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারিনা। এক ঘরে থেকেও যে মানুষ অনেক দূরে অবস্থান করে সেটা আমি এখন বুঝি।
প্যাচাল এখন থাক। তোমরা সবাই স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রেখ। মৌ সহ তোমরা সবাই আমার আন্তরিক স্নেহ ভালবাসা নিও।
ইতি
তোমার আব্বা
২৬/১২/৯৩ইং
*** ১৯৯৩ সালে এই চিঠিটি আব্বা আমায় লিখেছিলেন। উনার তিন সন্তানের মাঝে দ্বিতীয় হলেও উনার জেষ্ঠ কন্যা ছিলাম বলেই হয়তো আমার কাছেই উনি কিছুটা মন খুলতেন। এই দীর্ঘ চিঠিতে উনার মনের ক্ষোভই শুধু ছিলো না, ছিলো ইতিহাস। যা কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। ছিলো বাস্তহারার বেদনা, যা মানুষকে আ-মৃতু তাড়া করে। মূল চিঠির বানান, ভাষা কিছু পরিবর্তন করিনি। ইচ্ছে হচ্ছিলো আমার আব্বার মুক্তোর মত হস্তাক্ষরের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে। আমার অক্ষমতায় তা পারলাম না। আব্বার জন্য কিছুই করতে পারিনি। নিজেকে আব্বার অযোগ্য সন্তান বলেই মনে হয়।
আম্মার মত আব্বাকেও কখনো বলা হয়নি উনাকে কতটুকু ভালবাসি। আম্মা হারিয়ে গেছেন চোখের আড়ালে, আব্বা তো আছেন। তাই আমার এই লিখাটি আব্বার জন্য। “আব্বা, আপনার এই জেষ্ঠা কন্যা আপনাকে অনেক অনেক ভালবাসে”।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:০৩