আপনি যেকোনো লেখার সমালোচনা করুন। কিন্তু লেখককে বা ব্লগারকে আক্রমণ করবেন না।
সাইয়িদ রফিকুল হক
আপনার যেকোনো লেখার গঠনমূলক-সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে। আধুনিকরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছেই মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে এবং মানুষের সর্বপ্রকার অধিকারকে সমুন্নত রাখতে। আপনি আধুনিকরাষ্ট্রের একজন নাগরিক। আপনার রয়েছে বিশাল চিন্তার জগৎ। আর আপনি এই চিন্তার জগতে কারও-কারও সঙ্গে হয়তো খাপ খাওয়াতে পারছেন কিংবা কারও-কারও বাক্য বুঝতে আপনার সমস্যা হচ্ছে। তখন আপনি কারও গঠনমূলক-সমালোচনা করতে পারেন। আর তিনি যদি একজন লেখক হন—তাহলে, আপনি তার লেখা পড়ে তার একটা সমালোচনা করতেই পারেন। আর আপনার জন্য সবসময় গঠনমূলক-সমালোচনার দরজা একেবারে উন্মুক্ত।
ব্লগে এখন অনেকেই লেখে। আগের মতো গুটিকতক মানুষ আর এখানে নেই। দিন দিন এর পরিধি ক্রমশঃ বিস্তৃত হচ্ছে। এখানে, নবীন-প্রবীণ অনেক লেখক রয়েছেন। আর প্রতিদিন ‘সামহোয়ার ব্লগে’ শত-শত লেখা পোস্ট করছেন বিভিন্ন চিন্তাভাবনার অধিকারী লেখকগণ। এদের যেকোনো লেখারই আপনি সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু তার আগে আপনাকে সমালোচনার ভাষা শিখতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার মনে চাইলেই কাউকে একটা-কিছু বলে দিলেই হলো না। আপনার কাছে যা ‘মিথ্যা বা সত্য’ মনে হচ্ছে তা অন্যের কাছে ‘সত্য বা মিথ্যা’ মনে হতে পারে। তাহলে কি দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য? না-না, তা হবে কেন? পূর্বেই বলেছি: আমরা আধুনিকরাষ্ট্রের আধুনিক-মানুষজন। আমাদের মনমানসিকতার বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আমরা যদি বদরাগী-লোকের মতো হঠাৎ-হঠাৎ এতো রেগে যাই, তাহলে তো সর্বনাশ! আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটাতে হবে। আর সবার আগে আমাদের একজন সুনাগরিক হতে হবে। এবার আসুন দেখি, সুনাগরিক কাকে বলে?
সুনাগরিক একজন সাধারণ নাগরিকের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত মনমানসিকতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্রের প্রতি অবিচল আস্থাবান। আর সবসময় তিনি ধীরস্থির। আধুনিক-রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম পথিকৃৎ: লর্ড ব্রাইস সুনাগরিকের তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো:
১. বুদ্ধি
২. বিবেক ও
৩. আত্মসংযম।
এগুলো ছাড়া একজন মানুষ কখনওই সমাজে-রাষ্ট্রে নিজেকে সুনাগরিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। নিজে-নিজে বা মুখে-মুখে নিজেকে রাতদিন সুনাগরিক বলে তারস্বরে চিৎকার ও চেঁচামেচি করলেই আপনি বুঝি সুনাগরিক? না, তা নয়। আপনাকে আগে সুনাগরিক হতে হবে। তারপর আপনাকে আর-কিছু বলতে হবে না। এরপর লোকেই আপনাকে নিয়মিত সুনাগরিক হিসাবে ডাকবে।
আপনি ব্লগে এসেছেন মানে আপনি একজন আধুনিকমানুষ। আর আপনার মধ্যে হয়তো পরমতসহিষ্ণুতা আছে। আর এই পরমতসহিষ্ণুতা ব্যতিরেকে আপনি কখনও সমাজে-রাষ্ট্রে একজন আধুনিকমানুষ হতে পারবেন না। আধুনিকমানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো: এই পরমতসহিষ্ণুতা। আর তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আপনি ব্লগে ঢুকেছেন। আর ব্লগে বসে যেকোনো লেখা পড়ছেন, ভালো। ব্লগে এখন ভালো লেখকের পাশাপাশি ভালোমানের পাঠকও প্রয়োজন। আপনি যেকোনো লেখা পড়লেই কি সমালোচনা করতে হবে? না, তা নয়। যদি সমালোচনার প্রয়োজন হয় তবে তার সমালোচনা করুন। আর যদি প্রশংসার প্রয়োজন হয় তাহলে সেখানে প্রশংসা করুন। আর আপনি মানুষকে প্রশংসা করতে শিখুন।
আপনি সমালোচনা করবেন যেকোনো লেখার। আর আপনি একটি লেখার চমৎকার ও মার্জিত ভাষায় সমালোচনা করুন। আপনার ভাষা মার্জিত হবে কিন্তু যুক্তি হবে শাণিত। আপনি একটি লেখার ক্ষুরধার সমালোচনা করুন। কিন্তু তাতে অবশ্যই যুক্তি থাকতে হবে। আবার আপনি একটি লেখাকে সমালোচনা করে একেবারে তুলোধুনা করতে চাচ্ছেন! তা করুন না। কেউ তো আপনার হাত-পা বেঁধে রাখেনি। আপনি একটি লেখাকে বহুভাবে বহুযুক্তি প্রয়োগ করে সমালোচনা করতে পারেন। প্রয়োজনে আপনি একটি লেখার একেবারে ‘অ্যানাটমি’ করে ফেলুন। এও তো ভালো। কিন্তু আপনি কখনও কোনো লেখককে আক্রমণ করবেন না। তাহলে, আপনি কীসের ব্লগার? আপনি তো তাহলে আধুনিকমানুষের চিন্তাভাবনা ছেড়ে একেবারে প্রাগৈতিহাসিক হয়ে যাবেন!
কোনো ব্লগারের লেখা আপনার ভালো লাগছে না। ভালো কথা। এতে কোনো সমস্যা নাই। আপনি তাঁর লেখা পেলেই শুধু সমালোচনা করতে চান! আর এর ভুলগুলো খুঁজে বের করতে চান! তাও ভালো। কিন্তু আপনি দয়া করে এর লেখককে আক্রমণ করবেন না।
সমালোচনা ভালো। তবে তা গঠনমূলক হলো আরও ভালো। নিজের সমালোচনাকে নিজে-নিজেই পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আর এর ভুলত্রুটি খুঁজে বের করতে হবে। কারও সমালোচনা করে যদি নিজেই সমালোচনার পাত্র হয়ে যাই—তাহলে, এই সমালোচনার মূল্য কোথায়?
ব্লগে যারতার বা যেকোনো লেখা পড়ুন। আর লেখার যথেচ্ছা সমালোচনা করুন। কিন্তু লেখককে আঘাত করবেন না। একজন লেখক আপনার ভাই-বন্ধু। তিনি তাঁর দৃষ্টিতে সমাজ-রাষ্ট্রের বা সামাজিক টাইপ-মানুষের চরিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন। এটিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নাই। আবার একজন লেখক যা-খুশি তা-ই লিখবে বা তার সমস্ত লেখাই যে সহীশুদ্ধ বা ভালোমানের মনে হবে তাও নয়। সেক্ষেত্রে, আপনি তাঁর লেখার গঠনমূলক ও শাণিত সমালোচনা করুন। এতে আপনি বাহবা পাবেন। আর লেখক তার ভুল বুঝতে পারবেন।
আক্রমণাত্মকভাষায় কখনও সমালোচনা হয় না। এটি হয়ে যায় যুদ্ধংদেহীমনোভাব। আর এটি হয় ব্যক্তিগত বিষোদগার। ব্লগে সমালোচনাও একটি সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে। এজন্য আপনাকে শুধু সংযত হয়ে ভাষার মাধুর্য রেখে, আর সত্যবিবেককে জাগ্রত করে সমালোচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে অগ্রসর হতে হবে। সমালোচনা একটি গুরুদায়িত্ব। আর একজন সমালোচকের কাঁধে রয়েছে এই গুরুদায়িত্বটি। এটিকে কোনোভাবেই অবহেলা করার কোনো সুযোগ নাই। অনেকে মনে করতে পারেন: একটা-কিছু লিখে দিলেই তো সমালোচনা হয়ে যাচ্ছে। কিংবা আমি যেকোনো ধরনের একটি মন্তব্য করলেই তো আমার দ্বারা সমালোচনা হচ্ছে! কিন্তু আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আপনি কারও লেখা পড়ে ব্যক্তিগত আক্রোশ নিয়ে তার লেখার সমালোচনা না করে তাকেই আক্রমণ করে বসলেন! এটি হলো আপনার তরফ থেকে ওই লেখককে গালিগালাজ! আধুনিক-সভ্যরাষ্ট্রে একজন আধুনিকমানুষের কাছ থেকে এটি কখনও আশা করা যায় না। তাই, যথাযথভাবে ভাষা শিখে যেকোনো লেখার গঠনমূলক-সমালোচনা করে আপনার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। আর একজন সমালোচককে হতে হবে লেখকের সমপর্যায়ের কিংবা তারচেয়েও উন্নত মানসিকতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব।
সমালোচনা তো থাকতেই হবে। আর সমালোচনা না থাকলে এই সমাজ-রাষ্ট্র সুস্থ থাকবে না। তাই, সুস্থ ও সুন্দর জাতিগঠনের স্বার্থেই সমালোচনা প্রয়োজন। আর তাই, আপনার-আমার সমালোচনা আরও বাড়াতে হবে। তবে সবসময় আমাদের মনে রাখতে হবে: আমরা যেন কারও কোনো লেখা পড়ে তাঁর বিরুদ্ধে আক্রোশবশতঃ সমালোচনায় লিপ্ত না হই। আমরা যেন সবসময় বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে সমালোচনার ক্ষেত্রে অগ্রসর হই। আর কখনও যেন আমাদের টার্গেট কোনো লেখার লেখক না হন। লেখককে চিন্তার, কথা বলার ও লেখার অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে। আর অবাধ স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, একজন লেখক সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, দর্শন কোনোকিছুই মানবেন না—তা কিন্তু নয়। সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে। আর একজন লেখকও অবশ্যই সমাজ-রাষ্ট্রের আইন মেনে লেখক হবেন। মোটকথা, এই দুনিয়ায় কেউই আইনকানুনের উর্ধ্বে নয়।
সমালোচনার গতি-প্রকৃতি বাড়াতে হবে। আমাদের আরও বেশি সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু সবাইকে আগে সমালোচনার ভাষা শিখে তারপর সমালোচনার জগতে প্রবেশ করতে হবে। সমালোচনার মধ্য দিয়েই আমাদের সত্যআবিষ্কার করতে হবে। সমালোচনার মধ্য দিয়েই ভুল শোধরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর সমালোচনা হবে কারও ভুলটি শুধরে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা কখনওই কাউকে আঘাত করে সমাজে-রাষ্ট্রে সংঘাতসৃষ্টির জন্য নয়।
সামহোয়ার ব্লগে যারা নিয়মিত ব্লগারদের লেখা পড়েন তারা তো ব্লগারদের আত্মীয়স্বজনের মতো। কারণ, এরা না থাকলে ব্লগে কেউই লিখতে উৎসাহিত হতেন না। আর ব্লগে লেখক-ব্লগারের চেয়ে সাধারণ পাঠক-ব্লগারের সংখ্যাই বেশি। এঁরা যত বেশি ব্লগে ব্লগারদের লেখার সমালোচনা করবেন ব্লগ তত বেশি জমে উঠবে। আর এতে লেখকরা বা ব্লগাররা তাঁদের লেখার সার্থকতা খুঁজে পাবেন। এবং সমালোচকদের খোঁচা খেয়ে তার লেখার মান আরও বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবেন। একজন লেখক এতে করে নিজের আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজে পাবেন। কিন্তু কোনোভাবেই লেখা ছেড়ে লেখকের দিকে অস্ত্র-তাক করা যাবে না। এটা একটি অশোভনীয় দিক। আর সত্যিকারের পাঠক যেকোনো লেখার সত্যিকারের ও গ্রহণযোগ্য একটি সমালোচনা করতে সক্ষম হন।
জয়তু লেখক-পাঠক।
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
০৫/০৫/২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৬ রাত ৮:৩২