somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জহির রায়হানসহ একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা ও ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে আসলে কারা?

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর যাওয়ার পর জহির রায়হান নিখোঁজ হন। জহির রায়হানের অন্তর্ধানকে হত্যাকান্ড হিসেবে বর্ণনা করে সেই হত্যাকান্ডের দায়-দায়িত্ব (তাদের ভাষায়) ‘রাজাকার’দের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০০ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ, মে. জে. (অব.) মঈন, মে. জে. (অব.) ইব্রাহিম প্রমুখ অফিসার বলতে চেয়েছেন যে, মিরপুরে ৩০ জানুয়ারি বিহারীদের গুলীতে তিনি নিহত হয়েছেন। কিন্তু জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্য ঘাঁটতে গিয়ে এমন কিছু ব্যক্তির এমন কতগুলো চাঞ্চল্যকর তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেল যেগুলো পড়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। এসব তথ্য পাওয়া গেছে জহির রায়হানের শালী অভিনেত্রী ববিতা, জহির রায়হানের ভাবী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য পান্না কায়সার এবং ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবির প্রমুখের কাছ থেকে। এছাড়াও এদের জবানীতে সত্যজিৎ রায় এবং শেখ মুজিবের যেসব উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে সেসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জহির রায়হান ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেননি। তার পরেও বেশ কয়েকদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। এদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বাংলাদেশে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেষ্টনীর মধ্যেই ছিলেন।

॥ এক ॥
ঘটনা পরম্পরা পর্যালোচনা করলে তার মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব তৎকালীন প্রশাসনকেই গ্রহণ করতে হয় এবং (তাদের ভাষায়) রাজাকার বা দালালদের ওপর কোনভাবেই চাপানো যায় না। এই কলামে নিজস্ব মন্তব্যের পরিবর্তে ওপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের উদ্ধৃতি এবং মন্তব্য ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যখন অপপ্রচার এবং উস্কানিমূলক প্রচারণার বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন তখন এসব ব্যক্তিবর্গের সেদিনের উক্তি এবং আজকের ভূমিকা মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত মানুষকে সত্যের আলোকবর্তিকা দেখাতে সাহায্যে করবে।

॥ দুই ॥
সেই সময়কার সরকার নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রায়’ বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সংখ্যাটি ছিল ১৯৯২ সালের ১ মে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আজকের আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ঘাদানিক সংগঠক শাহরিয়ার কবির। তাদের সংলাপের অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে সত্যজিৎ রায় শাহরিয়ার কবিরকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন…
-“জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?”
শাহরিয়ার কবির, “তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায়, ৩০ জানুয়ারি দুর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। সেটাই ষড়যন্ত্রের মূলসূত্র বলে ধরছি। মিরপুরে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কোনো করণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীর জন্যই বিপজ্জনক ছিল, যে জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল।”

১৯৯২ সালেও শাহরিয়ার কবির মনে করতেন যে, জহির রায়হানকে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পরেও দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। তাহলে ঘাদানিক নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা বলুন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে জহির রায়হানকে আটকে রাখার ক্ষামতা ছিল কাদের? বলা হচ্ছে যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে জহির রায়হানের হাতে এমন কিছু তথ্য এসেছিল যেটা রথী-মহারথীদের জন্য ছিল বিপজ্জনক। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী সরকারের আমলে কারা ছিলেন রথী-মহারথী? যে বিপজ্জনক তথ্যের জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল সেসব তথ্য কাদের জন্য বিপজ্জনক ছিল? তাদের ভাষায় ‘রাজাকার’ এবং ‘পাকিস্তানী দালালদের’ রাজনীতি তো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারা তাহলে জহির রায়হানকে সরিয়েছে? যুদ্ধাপরাধী বা দালালদের বিচার করতে গেলে এসব প্রশ্ন এসে পড়বে।

॥ তিন ॥
পান্না কায়সার সাবেক আওয়ামী এমপি। জহির রায়হানের বড় ভাই পরলোকগত শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী। বাংলা ১৩৯৯, ১০ জৈষ্ঠ্য, ইং ১৯৯২ দৈনিক ‘বাংলার বাণী’তে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘কবিতা মিলনকে মিথ্যা সান্ত¦না’। এই নিবন্ধে তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর স্টাফ আফিসার লেফটেন্যান্ট সেলিম সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। আলোচ্য নিবন্ধের এক স্থানে পান্না কায়সার বলেছেন, “৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান একটি ফোন পেয়ে মিরপুরে ছুটে গিয়েছিলেন। একথা বহুবার লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়নি সেলিমের কথা। সেলিমও নাকি সেরকমই একটি ফোন পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদকে না বলেই জহির রায়হানের সঙ্গে মিরপুরে ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর দু’জনের ভাগ্যে একই নিষ্ঠুর পরিণতি। দু’জনই নিখোঁজ। সেলিমের মা এ সংবাদ পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। সেলিম বঙ্গভবনের যে ঘরটিতে থাকতেন ইত্যবসরে সে ঘর থেকে সমস্ত কাগজপত্র, কাপড়-চোপড় উধাও। শহীদ সেলিমের মা অনেক কষ্ট করেও কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। রহস্য রহস্যই থেকে গেল। জহির রায়হান নিখোঁজ হবার পর বুদ্ধিজীবী হত্যার কোন কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাগজগুলোর কোন হদিসই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেলে হয়তো পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির অন্য কেউ কাজে লাগাতে পারতেন। শহীদ সেলিমের মায়ের মতে, বঙ্গভবনের ওর ঘর থেকে যে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো উধাও হয়েছিল সেগুলো সম্ভবত তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রই হবে। খোদ বঙ্গভবন থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যাবে তা ভাবতেও বিশ্বাস হয় না। শহীদ সেলিম বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন একথা আমি আগে জানতাম না। আমি কেন, আর কেউ জানে কিনা তাও জানি না। জহির রায়হান ও সেলিমের নিখোঁজ রহস্য এখন আমার কাছে আরও রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা যেমন ৭১ সালে গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত হয়নি, তেমনি জহির রায়হান নিখোঁজ রহস্যও গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। অথচ এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ হয়েছিল সেদিন।”

পান্না কায়সার নিজেই বলেছেন যে, খোদ বঙ্গভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উধাও হয়ে যাবে সেটা ভাবনারও অতীত। জহির রায়হানের সাথে লেফটেন্যান্ট সেলিমও বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ সম্পর্কিত কাগজপত্র জহির রায়হান এবং সেলিম উভয়ের কাছ থেকেই উধাও হয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্টের ভবন থেকে কাগজপত্র উধাও করতে পারে কারা? ‘রাজাকার’ বা ‘পাকিস্তানপন্থীরা’ অবশ্যই নয়। এটা করা সম্ভব একমাত্র তাদের পক্ষে, যারা ক্ষমতার আশপাশে ছিলেন।
॥ চার ॥
তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার এমন একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিভাবান মানুষের নিখোঁজ হওয়ার বিষয় তদন্ত না করায় এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে গেছে। অথচ বিভিন্ন মহল জহিরের হত্যাকা-ের জন্য ভারতের স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তিকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছে। এই অভিযোগকে সর্বশেষ সমর্থন করলেন জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, বিশিষ্ট নায়িকা ববিতা।
ববিতা বলেছেন, “যুদ্ধের নয় মাসে অনেকের কা-কীর্তি ফাঁস করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলেই জহিরকে ফাঁদে ফেলে মিরপুর নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরিকল্পনামাফিক তাকে সরিয়ে দেয়া হয় পৃথিবী থেকে। বেক্সিমকো গ্রুপের রম্য পাক্ষিক পত্রিকা ‘আনন্দ ভুবন’ এর ১৬ মার্চ, ‘১৯৯৭ সংখ্যায় ‘কুলায় কালস্রোত’ বিভাগে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ শিরোনামে তিনি অতীত স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি মরহুম জহির রায়হানের স্ত্রী আরেক নায়িকা সুচন্দার ছোট বোন ববিতা।

জহির সম্পর্কে বলতে গিয়ে, ববিতা উল্লেখ করেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জহির ভাই কলকাতায় ছিলেন। ওপেনলি পার্টি করতেন না। তবে গোপনে করতেন। অনেক লোকজন আসতো তার কাছে। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এলেন। তখন তাকে খুব অসহায় দেখেছি। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে পাক সেনারা মেরে ফেলেছে। ওর জন্য জহির ভাই প্রায় পাগলের মতো হয়ে পড়েছিলেন। তখন ভাইকে খুঁজে পাওয়ার জন্য যে যা বলতেন, তাই করতেন। একবার একজন এসে বললো, আজমীর গিয়ে বাবার কাছে দোয়া চাইলে বড়দাকে পাওয়া যাবে। জহির ভাই বৌ, ভাবীকে নিয়ে আজমীর গিয়ে পড়ে থাকলেন কয়েকদিন।

কারা যেন এসে বললো, প্লানচেট করলে বড়দার খোঁজ পাওয়া যাবে। জহির ভাই তাই করলেন। যে যা বলছে, তাই বিশ্বাস করেছেন। সেয়াস (প্রেতচক্র) করলেন। আত্মা এসে বললো বড়দা মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে আছেন খুব অসহায় অবস্থায়, তার দুই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। জহির ভাই বাসায় কাউকে কিছু না বলে মিরপুর গেলেন। যাওয়ার সময় শুধু বললেন, তোমরা সবাই আজকে নামায কালাম পড়ো। আমি তোমাদের অবাক করে দেয়ার মতো একটা কাজ করবো। এই বলে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরলেন না। তার সাথে ছিলেন একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার। সেই ব্রিগেডিয়ারের রাতে আমাদের বাসায় ডিনার করার কথা ছিল। সন্ধ্যার সময়ে ব্রিগেডিয়ার সাহেব আমাদের গেন্ডারিয়ার বাসায় ফোন করে বললেন, ডিনার খাওয়া হবে না। কেননা জহির রায়হানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বললাম, কেন উনিতো আপনার সাথেই বেরিয়ে গেছেন। উনি বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু ওখানে গিয়ে একসময়ে উনি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, এই বলে ফোন রেখে দিলেন।

আমার মনে হয়, জহির ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। ভারত থেকে ফিরে আসার পর একবার এক মিটিংয়ে উনি বলেছিলেন “যুদ্ধের নয়মাস আমি কলকাতায় ছিলাম। আমি দেখেছি সেখানে কে কি করেছে। কে দেশের জন্য করেছে, আর কে নিজের আখের গুছিয়েছে। আমার কাছে সব রেকর্ড আছে। আমি সব ফাঁস করে দেব। এটাই জহির রায়হানের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই আজমীরে যাওয়া, ওই সেয়াস করা, এগুলোর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল তাকে মিরপুরে নিয়ে যাওয়া এবং হত্যা করা।”
॥ পাঁচ ॥
জহির রায়হানের আকস্মিক মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে সহায়ক হতে পারে আরেকটি তথ্য। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে’ শীর্ষক লেখায় তিনি বলেছেন, “চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে আমার কলকাতায় পরিচয় ঘটে। তার থাকবার কোন জায়গা ছিল না প্রথমে। আমি তাকে তিন মাসের জন্য থাকবার একটা খুব ভাল ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলাম কলকাতায়। দেশে ফিরবার পর তিনি মারা যান। তাকে মেরে ফেলা হয়। কেন, কি কারণে, কারা তাকে মেরে ফেলে আমি তা জানি না।”

ড. সামাদ আরো বলেছেন, ৭ ডিসেম্বর (৭১) কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি উৎসব হয়। রায়হান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমিও ছিলাম। তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে ছিলেন আমার দু’সারি আগে। হঠাৎ তাকে বলতে শুনি “দেশকে দু’বার স্বাধীন হতে দেখলাম। আবার একবার স্বাধীন হতে দেখবো কিনা জানি না।” কেন তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন, তা ভেবে আমার মনে পরে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। তার মৃত্যু আজো হয়ে আছে রহস্যঘেরা।

জহির রায়হানের উপরোক্ত মন্তব্যে দেখা যায়, তিনি ৪৭ সালে ইংরেজদের বিদায় এবং ভারতবর্ষ বিভক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট পরিবর্তন, তথা পাকিস্তানের জন্মকেও স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার চেয়েও বেশি তাৎপর্যম-িত ব্যাপার হলো, রাজনৈতিকভাবে মওলানা ভাসানীর অনুসারী জহির খুব সম্ভব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভবিষ্যতে আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ কবলিত হওয়া এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জনগণের বিজয় অর্জনের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আর এই ইঙ্গিত উপলব্ধি করে কট্টর ভারতপন্থী মহল এবং তাদের গুরুদের গা-জ্বালা ধরে যাওয়াই স্বাভাবিক। তখনকার পরিস্থিতিতে খোদ কলকাতায় বসে প্রকাশ্যে এমন উক্তি করা তাদের কাছে ‘স্পর্ধা’ বলে মনে হতে পারে। হয়তো এই দুঃসাহসের মূল্য হিসেবেই জহিরকে জীবন দিতে হয়েছে।
আমার বিশ্বাস জহির মিরপুরে মারা যায়নি। ঘাতকরা তাকে অন্য কোথাও হত্যা করেছে। এ বিশ্বাস এখনো আমার আছে, বলেছেন ড. সামাদ।

॥ ছয় ॥
জহির রায়হানের মৃত্যু সম্পর্কে কথা বলেছেন তার প্রথম স্ত্রী সুমিতা দেবী। তিনি বলেন, সেদিন বাড়ি থেকে জহির কিভাবে কেমন করে বেরিয়ে গিয়েছিল আমি দেখিনি। কারণ আমি তখন মোহাম্মদপুরে তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকি। পরে আমার ননদ জহিরের ছোট বোন ডাক্তার সুরাইয়ার কাছে বিস্তারিত শুনেছি। সেদিন সকাল আটটার দিকে জহিরের কাছে একটা ফোন আসে। ফোনটা ধরেছিল সুরাইয়া নিজে। সেদিন রফিক নামে কেউ একজন ফোন করেছিল। আমরা যে রফিককে চিনতাম তিনি ইউসিসে চাকরি করতেন। তার সঙ্গে আমারই প্রথম পরিচয় ছিল। পরে আমিই তাকে জহিরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। টেলিফোনে সে জহিরকে বলেছিল, আপনার বড়দা মিরপুর ১২ নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। অন্য কেউ যদি সেখানে যায় তাহলে আপনার বড়দার ডেডবডি আসবে বাড়িতে।

টেলিফোন পেয়েই জহির প্যান্ট পরে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর বাড়িতে ফিরে আসেনি জহির। কোথাও ফিরে আসেনি।
একদিন বড়দি অর্থাৎ জহিরের বড় বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বলেন, জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরে নাসিমা আর কিছু বলেনি। টেলিফোন করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো তখন তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনা জহিরের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরো সন্দেহযুক্ত করে তোলে আমার কাছে।

মিরপুরে শহীদ হলেও জহির রায়হানের হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়াটা দুঃখজনক বলেন মন্তব্য করেন তাঁর ছেলে অনল রায়হান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জহির রায়হানের হত্যার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তাঁর গাড়িটিও ঘটনার কয়েক দিন পর পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় রমনা এলাকায়। সেসব বিষয় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

তথ্য সূত্র: শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত “একাত্তরের অবিরাম রক্তক্ষরণ”,
আসলাম সানী রচিত “শত শহীদ বুদ্ধিজীবী
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৪৮
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×