নারীদের পর্দাপ্রথা এবং বিজ্ঞানসম্মত কিছু কথা
আমাদের পৃথিবীতে প্রধান ধর্ম চারটি। প্রত্যেক ধর্মেই জীবনের সকল বিষয় নিয়ে কম বেশি আইন কানুন রয়েছে। জীবনটাকে যদি বাস্তবসম্মতভাবে পরিচালনা করতে যাই তাহলে ধর্মীয় বিশ্বাস মনে থাকার পরও আমরা ধর্মের সব আইন মেনে চলতে পারিনা বা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক মুসলিম। ইসলামে মেয়েদেরেকে পর্দা রক্ষা করে এবং পুরুষদেরকে দৃষ্টি সংযত করে চলতে বলা হয়েছে। অন্যান্য ধর্মে নারী পুরুষদের সংযত থাকার কথা বলা আছে। তাছাড়া আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নানাভাবে নারীপুরুষদের সকল কাজে সংযত থাকার কথা আছে বিধায় মোটামুটি সামাজিকভাবে যারা ভদ্র, শিক্ষিত তারা শালীনতা রক্ষা করে চলাচল করে।
বিবাহযোগ্য নারী এবং পুরুষ- বিবাহ করা যেতে পারে এমন ব্যক্তিদের দেখলে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। নরীরা পুরুষের প্রতি এবং পুরুষরা নারীদের প্রতি, কিন্তু কিছু কিছু দেশে নারীরা লজ্জার কারণে তা প্রকাশ করেনা আর অনেক দেশের নারীরা তা নানাভাবে প্রকাশ করে। ভারতবর্ষের শিক্ষিত হিন্দু, মুসিলম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সকল ধর্মের নারী পুরুষরাই মোটামুটি শালীন পোশাক পরে। যারা উচ্ছৃঙ্খল তারা সকল দেশেই উচ্ছৃঙ্খল, সব কাজেই উচ্ছৃঙ্খল। তাদেরকে সুশৃঙ্খল করার জন্য সামাজিক চেষ্টা থাকা উচিত কিন্তু তাই বলে অতিরিক্ত পর্দা প্রথা দেখিয়ে নয়, অতিরিক্ত সব কিছুই খারাপ।
ব্যক্তিগতভাবে আমি কলেজ ভার্সিটি শেষ করে চাকরি করছি অনেকদিন। বংশগতভাবে আমি মুসলিম। রাঙ্গামাটিতে বাস করি সব ধর্মের লোকের সাথে মিলেমিশে। সবসময় সালোয়ার কামিজ ওড়না পরি, হিজাব বা বোরকা আমি পরিনা। কারণ ওসব পোশাক আমার কাছে অতিরিক্ত এবং অযৌক্তিক মনে হয়। আমার বন্ধুরা বলে আমি দেখতে ভাল। আমি এতটা বড় হলাম কিন্তু কখনও কোনদিন কোন পুরুষকে আমার দিকে অশ্লীল দৃষ্টিতে তাকাতে দেখিনি। যারা আমার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছে তারা কেউ কেউ আমার কাছে তা ব্যক্ত করেছে এবং আমি তাদেরেক ‘না’’ বললে তারা কেউ আমাকে কখনও বেশি বিরক্ত করেনি। এই ধরণেরই অভিজ্ঞতা আমার হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রীস্টান সব মেয়ে বন্ধুদের রয়েছে।
তবে কর্মজীবনে আমার পাশে এবং রাস্তাঘাটে কোন কোন মহিলাকে নাক পর্যন্ত ঢাকা বোরকা পরে গরমে ছটফট করতে দেখেছি। আবার কাউকে কাউকে দেখেছি বোরকা পরে, কিন্তু মুখটাকে এমনভাবে সাজিয়ে রাখে যাতে বোরকা পরার কোন অর্থ থাকেনা। আমি আরও দেখেছি যে, বোরকা পরা মেয়েদের পাশে পুরুষ সঙ্গীরা কত সুন্দর সাবলীলভাবে গায়ে হওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি অদ্ভুত দৃশ্য ! নারী পুরুষ পরস্পরের কাছে সবসময় আকর্ষণীয় হয়ে থাকতে চায়। এটা তাদের সহজাত প্রবণতা। আর তাই পরিবার পারিপার্শ্বিকতার কারণে যেসব মুসলিম মেয়েরা বোরকা পরতে বাধ্য হয় তারা ইদানিংকালে বোরকা তৈরী করে নানা ডিজাইন করে, নানা রঙের এমব্রয়ডারী করে- যাতে দেখতে ভালো লাগে। অথচ বোরকা আইনটি হল যাতে পুরুষরা মেয়েদেরকে দেখে আকর্ষণ বোধ না করে সেজন্য। আরেকটি বিষয় হল যে, যেসব মেয়েরা বোরকা পরে তারা কিন্তু পুরুষদেরকে মন ভরে দেখতে পারে। কারণ পুরুষরা বোরকা পরেনা। এ ক্ষেত্রে মেয়েদেরকে অনুভূতিহীন, নির্জীব মনে করা হচ্ছে। কেননা পুরুষদের কাছে মেয়েরা যেমন আকর্ষণীয় তেমনি একইরকমভাবে মেয়েদের কাছে পুরুষরা আকর্ষণীয়।এর অনেক প্রমান আমরা দেখতে পাই নারীপুরুষের সম্পর্কের জটিলতা যখন সৃষ্টি হয়। যেমন মেয়েরাও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সুদর্শন পুরুষকেই প্রেমিক হিসেবে চায়। প্রেমিক বা স্বামী দেখতে ভাল না হলে বা ভগ্ন স্বাস্থ্যের হলে মেয়েরা গোপনে অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয় বা লিপ্ত হতে চেষ্টা করে।তাহলে মেয়েদের গায়ে বোরকা চাপিয়ে তাদেরকে নির্জীব মনে করে কোন লাভ নেই। পুরুষদের মত একইরকম চাওয়া পাওয়া নিয়েই নারীরা বেঁচে আছে।
বাংলাদেশে গ্রাম কিংবা শহরের বেশীরভাগ মেয়েরা বোরকা পরেনা। কারণ তারা আধুনিক মানবসমাজে এই অযৌক্তিক পোশাকটির অপ্রয়োজনীয়তার কথা আপনাআপনি বুঝে গেছে। বোরকা এবং নানারঙের হিজাব মনুষের পরিচয় ঢেকে রাখা, চুপিচুপি অনেক দুষ্কর্ম ঘটানো এবং নানা ঢঙের ফ্যাশনে সহায়ক হওয়া ছাড়া আর কোন উপকারিতা বয়ে আনেনা। প্রকৃত অর্থে পুরুষের দৃষ্টি যদি সংযত থাকে তবে নারীদের কোন ভয়ই থাকেনা। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরুষের দৃষ্টিকে সংযত করার শিক্ষা এবং আইন চালু করা হোক। নারীদেরকে মুক্তি দেয়া হোক সবরকম অমানবিক বন্দীত্ব থেকে।
বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, “নারীদের দেখে পুরুষদের কুপ্রবৃত্তি যেন জাগ্রত না হয় তাই নারীদের উপর ধর্ম কিংবা সমাজ অনেক আইন কানুন জারী করেছে। তার মানে নারীরা প্রাকৃতিকভাবে সংযত, উচ্ছৃঙ্খল নয়। যদি তাই হয় তবে নারীরা সমাজের বাইরে থাকবে, বাইরের কাজ করবে আর পুরুষরা অন্দরমহলের কাজ করবে। শুধুশুধু নারীরা বন্দী থাকবে কেন? তাদেরকে এই পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত রাখার জন্য এত আইন কানুন কেন? পশু সমাজে যারা হিংস্র তাদেরকে আমরা খাঁচায় বন্দী করে রাখি, আর যারা নিরীহ তাদেরেক অবাধে বিচরণ করতে দিই। তবে মানব সমাজে ভিন্ন নিয়ম কেন?”
উপরের কথাগুলো মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার দুঃখ করে বলা অত্যন্ত যৌক্তিক কথা ছিল। আজ আমরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে অনেকদূর এসেছি। নারীপুরুষ নিজেরা সংযত হয়ে চলতে জানে, ভালবাসতে জানে, বন্ধুত্ব করতে জানে। তবে বোরকা বা হিজাব আমাদের কি জন্য দরকার? একজন নারীর একটি শালীন পোশাক শরীরে থাকার পরও তাদেরকে অতিরিক্ত আরও একটি পোশাক বোরকা বা হিজাব পরার জন্য এত বর্বর চাপাচাপি কেন? ধর্মের নামে পুরুষরা বা সমাজের মহিলারা সকলকে এমন অযৌক্তিক পোশাকটি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, মহিলারা হচ্ছে নিম্নশ্রেণীর যৌন যন্ত্র এবং পৃথিবীটা যতদিন থাকবে তারা নিম্নশ্রণীর জীবের মতই পুরুষদের দেয়া বিধানগুলো সব মেনে চলবে, পুরুষরা প্রয়োজন হলে নারীদেরকে প্লাষ্টিক কিংবা লোহার খাঁচায় আটকে রাখবে অথবা পন্য বানিয়ে বাজারে বিক্রি করবে আর নারীরা তাদের অত্যাচারকে মধু মনে করে পান করতে থাকবে।যদিও বর্তমান কালের নারীরা অনেকক্ষেত্রে নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনেক অন্যায় প্রতিরোধ করে যাচ্ছে।
আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী দুজনের কেউই বোরকা বা হিজাব পরেননা। ওনাদের উচিত নারীদের শালীন পোশাক সম্পর্কে দেশের নারীদেরকে ধারণা দেয়া এবং বোরকা পরা, হিজাব পরা আইন করে বন্ধ করা। তা না হলে ওনরাও যে একদিন জঙ্গীদের কবলে পড়ে ‘‘হিজাব কেন পড়েননি’’ সে কথার উত্তর জঙ্গীদের মনের মত করে দিতে সক্ষম হবেননা-তা কে বলতে পারে। যেমন দিতে সক্ষম হননি হলি আর্টিসানে জঙ্গীদের দ্বারা জবাইকৃত জেডএক্সওয়াই ইন্টারন্যাশনালের মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ইশরাত আখন্দ। বর্তমান অবস্থাকে প্রশ্রয় দিতে থাকলে মুসলিমসহ অন্য সব ধর্মের মেয়েরা এদেশে একদিন বোরকা-হিজাব না পরার অপরাধে অপমানিত হবে এবং জঙ্গীদের হাতে জবাই হবে।
এদেশে এখন যৌক্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত কথা বলা যায়না। যে বা যারা বলে তাদের পেছনে জঙ্গী লাগিয়ে দেয়া হয়, তাদেরকে নাস্তিক বলে জবাই করা হয়। এরপর বিচার পাওয়ার জন্য নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনকে এত লম্বা লাইন লাগাতে হয় যে, সে সময়ের মধ্যে আরও দশজন নাস্তিককে জবাই করার কাজ জঙ্গীরা শেষ করে ফেলে।
প্রাকৃতিকভাবে এবং আধুনিক ব্যাখ্যানুযায়ী মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা কেউ কখনও জোর করে আদায় করতে পারেনা। প্রত্যেকটা ধর্মে মনুষকে জোর করে ধার্মিক বানানো নিষেধ। এ ব্যাপারে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলে গেছেন যে, “তোমরা যার যার ধর্ম পালন কর। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেনা। নিজের ধর্ম অন্যের উপর চাপিয়ে দেবেনা।”
বিজ্ঞানসম্মত ব্যখ্যানুযায়ী পৃথিবী সৃষ্টি এবং মানব প্রজাতি সৃষ্টির যে কারণের কথা বলা হয়েছে তার সাথে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, ইসলাম এসব কোন ধর্মের কথার মিল নেই। এ ব্যাপারে ধর্মীয় কারণগুলো সম্পূর্ণ নাটকীয় এবং আকস্মিক। তাহলে আমাদের মধ্যে কারও যদি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার প্রতি বিশ্বাস জন্মে তাহলে সেটি দোষের ধরা হয় কেন? বিশ্বাস সম্পূর্ণ নিজস্ব বিষয় এবং প্রত্যেকের নিজস্ব অধিকার।
মার্কসবাদী বা যাদেরকে কম্যুনিস্ট বলা হয় তারা জগতের সবকিছুকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করে এবং সেইমত সমাজকে পরিচালনা করতে ব্রতী হয়।কিন্তু বাংলাদেশ বা যে কোন দেশের জঙ্গী বা ধর্মীয় সংগঠনগুলো যদি মার্কসবাদীদের নাস্তিক বলে ধরে ধরে হত্যা করতে শুরু করে তবে সেটি মানবিক এবং ধর্মীয় উভয় দৃষ্টিতেই অপরাধ। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এই ধরণের অপরাধগুলো বেড়েই চলেছে। যারা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যায় বিশ্বাস রাখে তারাই বাস্তব কথা বেশী বলে। সুতরাং বিজ্ঞানমনষ্ক লোকদের নিয়ে সমাজের অন্যান্য লোকদের বাড়বাড়ি বন্ধ করা উচিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:০৮