নিজেদের সবথেকে বড় গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাবীদার দলটি আন্দোলনের ডাক দিয়ে সদলবলে আত্মগোপনে চলে যাওয়াটা ভাল কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না। গত দুই আড়াই বছর আগে থেকেই তাদের এই প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। যা প্রকট আঁকারে দেখা যায় ২০১৪ এর পাঁচ জানুয়ারি নির্বাচনে পূর্বে। আর তার ঠিক এক বছরের মাথায় এসে তো এ দলটি পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সের রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করেছে। যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত।
স্বাভাবিক রাজনীতির আবহ বলতে এখনো যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাহলো প্রকাশ্য আন্দোলনের ডাক দেয়া এবং স্বপক্ষীয় শক্তিগুলোর প্রকাশ্য পক্ষাবলম্বন। এর বাইরে; চোরা গুপ্তা হামলা, নেতাদের আড়ালে চলে গিয়ে সাধারণ কর্মী বাহিনী এমনকি ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে বিক্ষিপ্ত হামলা চালিয়ে জনমনে আতংকের সৃষ্টি করা এসবই প্রত্যাখ্যাত রাজনৈতিক শক্তির পরিচায়ক। অথচ সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থনপুষ্ট হওয়া স্বত্বেও বিএনপি এখন সেই কাজটিই করে যাচ্ছে। যার স্বপক্ষে তারা যে যুক্তিটি উত্থাপন করেন তা একেবারেই ছেলেমানুষি। তারা সর্বদাই সরকারের দমন পীড়নের কথা বলেন।
বিরোধী দলের সরকার বিরোধী আন্দোলনে খোদ সরকার সহযোগিতা করবেন এমন দাবী বোধ হয় সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ করবেন না। বিশেষত আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা তো আশা করাই বোকামি। বিরোধী দল আন্দোলনের ডাক দিবেন সাধারণ মানুষ তাদের ডাকে রাস্তায় বের হয়ে আসবে। প্রশাসন তো দূরের কথা সরকারের ভীত নড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে সরকার যদি দমন পীড়ন চালাতে উদ্যত হয় তারা যদি নির্বিচারে গুলি পর্যন্ত চালায় তো কি হল? দেশ, দেশের মানুষের স্বার্থ সবার উপরে। সরকার কটা গুলি চালাবে? ক’জন মানুষকে তারা মারার সাহস পাবে?
জনগণের দাবী মেনে নিতে সব সরকার সর্বদাই বাধ্য হয়। জনগণের শক্তির সম্মুখে কোন স্বৈর শক্তিই টিকে থাকতে পারে না। তবে শর্ত হল দাবী আদায়ে রাস্তায় নামতে হবে সাধারণ মানুষকে। প্রশ্ন হল আজ যে দাবীতে বিএনপি তথা বিশ দলীয় জোট আন্দোলন করছে সেটা কি জনগণের দাবী?
যদি বিএনপির এই দাবী সাধারণ মানুষের দাবীই হত তাহলে তা পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বেই পূরণ হয়ে যেত। সেদিন যেমন সাধারণ মানুষ বিএনপি নেত্রীর ডাককে প্রত্যাখ্যান করছে আজো একই ভাবে তিনি প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি বিএনপি নেত্রী ও তার নেতারা এখনো তা অনুধাবনে সক্ষম হননি।
তাদের এই চলমান আন্দোলনের লক্ষ বস্তু সরকার, প্রতিপক্ষ আওয়ামীলীগ। অথচ তাদের আন্দোলনের আঁচে আওয়ামী লীগের কোন নেতা কর্মী পাতি নেতা তো দুরের কথা পোষ্যও আক্রান্ত হয়নি।(যদিও আমরা তা চাইও না) আক্রান্ত হয়েছে একেবারেই সাধারণ মানুষ। যাদের দৈনন্দিন কাজে যোগদানের কোন বিকল্প নেই। যারা ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে নিত্য যুদ্ধ করে কষ্টে সৃষ্টে কোনমতে বেঁচে থাকেন। সমাজের এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন তার জীবীকার একমাত্র উৎস গাড়িটিতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা পড়ছে। একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী কোচিং শেষে বাড়ী ফেরার পথে বোমা হামলার স্বীকার হয়েছে। পাঁচদিনে আরও চারটি তাজা প্রাণ ঝড়ে গেছে। এই আন্দোলনে সেই সব পিকেটারই মারা পড়ছে যার নাম স্থানীয় নেতারা পর্যন্ত জানেন না। অথচ বিএনপি নেত্রী হোটেলের নাস্তা ভাবীর বাসার খাবার এ্যাপোলো-ইউনাইটেড হাসপাতালের ডাক্তারদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা নিয়ে তার অফিসে বহাল তবীয়তেই আছেন। তার গুণধর পুত্র লন্ডনে কোন কাজ কর্ম না করেও রাজার হালে থাকছেন। আর মাঝে মাঝে দেশে নেতা কর্মীদের বানী পাঠাচ্ছেন, জান বাজি রেখে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরতে। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহাশয় দুদিন সাংবাদিকদের আপ্যায়ন গ্রহণ শেষে নিশ্চিন্তে শ্রীঘরে পৌঁছেছেন। আর অন্যসব নেতাদের কথা তো আলি মুল গায়েব ছাড়া অন্য কারো পক্ষে জানাই সম্ভব না। এরপরেও এই নেতারাই আবার যখন সরকারের দ্বায়িত্বহীনতার কথা বলেন তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে তাদের নিজেদের দায়িত্ববোধ নীয়ে।
একটি লাশ নিয়ে যখন দুই দলের মধ্যে টানা হেঁচড়া হয় তখন আমরা সহজেই বুঝতে পারি লাশটি যার তিনি কোন দলেরই কর্মী ছিলেন না। হয় তিনি পরিস্থিতির স্বীকার নয়ত নিতান্তই ভাড়ায় খাটা পিকেটার। কথা হল এর শেষ কোথায়?
এর শেষ তো সেখানেই যেখানে গন মানুষের মূল্য থাকে। যেখানে গন মানুষের স্বার্থে রাজনীতি পরিচালিত হয়। সেই সুবর্ণ সময়টিকে যারা ফ্রেমে বন্দি করবেন তারা আজ রাজনীতির ফ্রেমেই নেই। এক সময় রাজনীতিবিদদের প্রতিপক্ষ ছিল রাজনীতিবিদরা। আর আজ রাজনীতিবিদদের প্রতিপক্ষের তালিকায় যোগ হয়েছে সুবিধাভোগী দালাল শ্রেণীর কিছু মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মা। যারা কখনো রাজনীতির ব্যানারে, কখনো সুশীল নাম ধারি ভাল মানুষের ব্যানারে, আর কখনোবা পেশাজীবীর ব্যানারে নির্লজ্জ মোসাহেবি করে প্রতিনিয়ত রাজনীতিবিদদের ভুল পথে পরিচালিত করছেন। ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে মূল নেতৃত্বকে একের প্রতি অন্যকে বিষিয়ে তুলছেন। এদের বুদ্ধির দৌরাত্ব এবং প্রতারণার আরেকটি বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে বিজেপি সভাপতির সাথে বেগম জিয়ার কুশল বিনিময় নামক একটি নাটক মঞ্চস্থের ব্যর্থ চেষ্টা ও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ম্যানদের স্বাক্ষর জাল করে বিএনপির পক্ষে বিবৃতি প্রদানের কথা বলে মিথ্যাচার। এই যুগে মানুষ কতটা নির্বোধ হলে এমন প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে তা সেটাই ভাবনার বিষয়।
গন মানুষের প্রতি যাদের নুন্যতম দায়িত্ববোধ নেই, নেই সামান্য জবাবদিহিতা তাদের প্ররোচনায়ই বিএনপির মূল নেতৃত্ব এখন আন্দোলনের কর্মসূচী ঠিক করছেন। তার সব থেকে বড় উদাহরণ হল; বিশ্ব ইজতেমার মাঝেও অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়া। বলা নেই কওয়া নেই একজন লোক হঠাত করেই ঢাকার রাস্তায় অসংখ্য পোস্টার, বিলবোর্ড আর ফেস্টুন টানিয়ে ঢাকা বাসিকে শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করলেন। কিছুদিন পড়ে তিনি ঢাকার মেয়র নির্বাচনের খায়েশ ব্যক্ত করে দোয়া কামনা করে নতুন পোষ্টার লাগালেন। ব্যাস তিনি লাইম লাইটে চলে এলেন! এমন ব্যারিস্টারের অভাব এদেশে কখনোই ছিল না। তবে নিজেকে বিক্রয়যোগ্য করে তোলার মত এমন মার্কেটিং জানা ব্যারিস্টারের অভাব নিশ্চয়ই ছিল। যাই হোক সেই ব্যারিস্টার মহাশয়ই প্রথম অসিয়ত করলেন। বিশ্ব ইজতেমাকে পিকনিক(!) উপাধি দিয়ে এর জন্য বিএনপির অবরোধ স্থগিত করা উচিত হবে না বলে মত দিলেন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে হয়ত এই বদ্ধ উন্মাদকে একদিন ঢাকার মেয়র হিসেবেও দেখতে পাব। যে কিনা ধর্মপ্রাণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ফেরাউন বলে চিহ্নিত করেছেন।
এ তো গেল মাত্র একজনের উদাহরণ। রাতের টিভি টক শো আর পত্রিকার পাতায় এমন কয়েক ডজন গুণধরের দেখা মেলে যারা কখনো সত্যি কথাটা বলেন না। সত্যি চেপে যেতেই তারা যারপরনাই সিদ্ধহস্ত। এরা এতটাই নির্লজ্জ যখন তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে পাক বন্ধু, রাজাকার বলা শুরু করল তখনও এটাকে মিথ্যা বলতে পারল না। বরং ইনিয়ে বিনিয়ে যা বললেন তার অর্থ দারায় জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলে কেন চিহ্নিত করা হল এটা তার প্রতিশোধ। তারা মহীরুহের সাথে শিশু বৃক্ষের হাস্যকর তুলনায় মেতে উঠল। বিএনপির রাজনীতির অনেকাংশই আজ এই স্বার্থপর, বেঈমান, মিথ্যেবাদী আর নির্লজ্জদের দখলে। যা বিএনপিকে প্রায় পুরপুরিই গ্রাস করে ফেলেছে। এর থেকে যতক্ষণ না তাদের মুক্তি মিলছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের পক্ষে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরা সম্ভব নয়।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যে কোন রাষ্ট্রে একাধিক রাজনৈতিক শক্তি অবস্থান করে যা মূলত রাজনৈতিক শক্তিগুলির ভারসাম্য রক্ষা করে কিন্তু শর্ত হল সেখানে দলগুলিকে গণতান্ত্রিক আচরণে অভ্যস্ত হতে হবে। যদি দল গুলির নেতাদের মধ্যে আদর্শচ্যুতি ঘটে তাহলেই কেবল সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। এ মুহূর্তে আদর্শ বলতে যা বোঝায় সেটির অভাবই দলগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোনটির মধ্যে কিছু কোনটির মধ্যে একেবারেই নেই। আর আদর্শের এই শূন্যতা দুই দলকেই চরম মানসিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ইতিহাস বলে পরস্পর বিরোধী এমন দুটি চরম বিদ্বেষী শক্তি বেশিদিন সহবস্থান করতে পারে না। একটিকে ধ্বংস হতেই হয়। তা একেবারেই হোক আর সাময়িক সময়ের জন্য হোক। এখন দেখার বিষয় কোন শক্তিটি শেষ পর্যন্ত টিকে যায়। তবে এটাও ঠিক এবারের এই টিকে থাকার সাথে আগামীর বাংলাদেশের স্বরূপটিও নির্ধারিত হয়ে যাবে। কেননা দ্বন্দ্বটি শুধুমাত্র ক্ষমতা কেন্দ্রিক মনে হলেও আসলে তা নয়। আজকের এই দ্বন্দ্ব একাত্তরের সাথে সম্পর্কিত। দ্বন্দ্বটি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের সাথে ও তার চরিত্রের সাথে সম্পর্কিত।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:৩০