সন্তানকে ক্লাসে প্রথম হতে হবে। অন্যরা পারলে সে কেন পারবে না? এটা একজন মায়ের দাবি নয় সকল মা-বাবার দাবী। ভাল স্কুলে পড়াচ্ছি, হোম টিউটর দিচ্ছি। যা চায় তাই পাচ্ছে। সে কেন প্রথম হতে পারবে না।
আমি বুঝতে পারি না ক্লাসে প্রথম হয়ে কি হবে? সে কি শিখছে কিভাবে নিজেকে তৈরি করছে সেই চিন্তাটা কিন্তু কোন অভিভাবকই করছেন না। তাঁরা মুখস্থ করাচ্ছেন তাঁরা শেখানোর চেষ্টাও করছেন না। এই মুখস্থ বিদ্যা আর তা প্রয়োজন অনুযায়ী উগরে দেয়া এ দিয়ে লাভটা কি হবে?
সন্তান সত্যিই বিকশিত হতে পারছে কিনা তাঁর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে তাকে সহায়তা করছেন কিনা সে চিন্তাটা একবারও কেউ করছেন না।
সে যা পড়ছে তা বুঝতে পারছে কিনা কিংবা তাঁর প্রয়োগ সে বাস্তব জীবনে করছে কি না সেটা দেখছেন না। যদি সে, সবার সুখে হাসব মোরা কাঁদব সবার দুখে............ আবৃত্তি করতে করতে গৃহ কর্মিকে পেটায় তাতে লাভটা কি হবে শুনি?
সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী অজস্র ছেলে মেয়ে দেখেছি যারা একটি লাইন নিজে থেকে লিখতে পারে না। একটি বিষয়ে প্রশ্ন করলে পাঠ্য বইয়ের তত্ত্বকথাটিও নিজের ভাষায় বলতে পারে না। কি হয় এই শিক্ষা দিয়ে?
বেশ কিছুদিন আগে সুইডেন প্রবাসী একজন প্রভাষক Aminul Islam তাঁর ফেসবুকে একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন এভাবে-
গত দুই দিন ধরে ছাত্রদের ইন্টার্ভিউ নিচ্ছি। আমার এখানে যারা ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলো, তাদের ইন্টার্ভিউ। বাংলাদেশ থেকে মোট ১১ জন আবেদন করেছিলো। আমার এক সহকর্মী এদের ইন্টার্ভিউ নিয়েছে। ............ আমি আমার সহকর্মী'কে জিজ্ঞেস করলাম
-কেমন করলো আমার বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা?
-কেউ কেউ ভালো, কেউ আবার একদম খারাপ।
আমরা মূলত ছাত্র-ছাত্রীদের মোটিভেশন দেখছিলাম, তারা কেন এখানে পড়তে চায়; সেই সাথে ইংরেজি'র লেভেল'টাও যাচাই করছিলাম। যা হোক, আমি আমার সহকর্মী'কে জিজ্ঞেস করলাম
-খারাপ বলতে কি বুঝাচ্ছ! মোটিভেশন ক্লিয়ার না, নাকি ইংরেজিতে সমস্যা?
-কয়েকজন তো আমার কোন প্রশ্ন'ই বুঝতে পারেনি। ইংরেজি'র লেভেল খুব'ই খারাপ।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত ১১ জন বাংলাদেশির মাঝে ৬ জনকে এডমিশন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। বাকী ৫ জন চান্স পায়নি, কারন এদের ইংরেজি এতো'ই খারাপ, কোন ভাবেই এদের এডমিশন দেয়া সম্ভব না।
সব চাইতে অবাক করা ব্যাপার হলো এই পাঁচ জনের সবাই এসএসসি এবং এইচএসসি'তে জিপিএ ৫ পেয়েছে এবং এখন বাংলাদেশের নামকরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পড়ছে বা পড়েছে। আর যেই ৬ জন'কে আমরা শেষ পর্যন্ত এডমিশন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এর মাঝে একজন ছাড়া কারো এসএসসি বা এইচএসসি'তে জিপিএ ৫ নেই। পাঁচ জন'ই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে বা পড়ছে আর একজন শুধু নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
আমি ঠিক জানি না, আমাদের পড়াশুনার মান আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। অতি সাধারণ ইংরেজি, যেমনঃ তুমি এখানে কেন পড়তে আসতে চাইছ? তুমি এই দেশ সম্পর্কে কি কি জানো? এই পর্যন্ত তুমি কি পড়াশুনা করেছে? এই ইংরেজি প্রশ্ন গুলো তারা বুঝে না; উত্তরও দিতে পারে না। প্রশ্ন করা হয়েছে এক বিষয়ে; না বুঝে উত্তর দিচ্ছে আরেক বিষয়ে। তাও আবার সব'ও ভুল ইংরেজিতে! এর মাঝে একজন আবার বাংলাদেশে ইংরেজি পড়ায় স্কুলে! ভাবুন দেখি অবস্থা! ..................।"
এ তো গেল তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। আমরা যারা দেশে আছি আমাদের অভিজ্ঞতা তো এর থেকেও খারাপ। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী বেশ কজন অফিস সহকারীকে দেখি বাংলা শুদ্ধ উচ্চারণটা পর্যন্ত লিখতে পারে না। কখনো কখনো বাংলা নামের ইংরেজি লিখতে গিয়ে এমন সব অদ্ভুত শব্দ বানিয়ে ফেলে যা লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুনেছি আজকাল সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে শ্রেণি শিক্ষক গন গাইড বইকে বাইবেল বানিয়েছেন?
আমাদের সন্তানেরা তাহলে কি শিখবে বলুন তো?
আমাদের সন্তানদের আদৌ কি আমরা কিছু শেখাচ্ছি, নাকি কেবলই মুখস্থ করাচ্ছি। একবার ভেবে দেখুন তো আর এ থেকে আমরা কীইবা অর্জন করতে চাইছি?
পবিত্র কুরআন মুখস্থ করছি বেহেশতের ফ্রি টিকেট পাওয়ার আশায়! আর পাঠ্য বই মুখস্থ করছি ফ্রি চাকরী লাভের আশায়!
বেহেশতের মালিক কিংবা চাকরী দাতা উভয়ের কাছ থেকেই নির্ঘাত নিরাশ হয়ে ফিরতে হবে। তখন তাঁর দায় নেবে কে?
আমরা সর্বদাই অন্যের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে অভ্যস্ত কিন্তু একবারও লক্ষ করিনা যার বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলছি তাঁর দিকে তো একটি আঙ্গুল নির্দেশ করছি বাকি চারটি আঙ্গুল তখন আমার দিকে তাকিয়েই ভ্রুকুটি করে।
আজকের অভিভাবকদের অভিযোগ, তরুণ সম্প্রদায় ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে তাঁরা ঘরকুনো হয়ে পড়ছে। নিজেদের নিয়ে একটি আলাদা জগত তৈরি করে নিয়ে গুটি সুটি মেরে ঘরের কোণে পরে থাকছে। তাঁরা অসামাজিক জীব হয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে ডুবে থাকছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সে দায় আসলে কার?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪০