আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক দল গুলো ক্ষমতায় থাকা কালীন সময়ে তাদের নেতা কর্মীদের স্থায়ী অর্থনৈতিক সংস্থান করে দেয়াটাকে তাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করেন। ক্ষমতায় আরোহণের পরে এটা তাই থাকে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিক কর্মসূচিগুলির মধ্যের একটি।
সমস্যা হল এত বৃহৎ সংখ্যক স্থানীয় নেতা কর্মীর স্থায়ী অর্থনৈতিক সংস্থান করে দেয়াটা তো আর সহজ কাজ নয়। সে জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। আর এই অর্থের সংস্থান করতে গিয়েই সরকারকে বিভিন্ন উদ্ভট প্রকল্প হাতে নিতে হয় এবং নানা ধরনের ইভেন্টের আয়োজন করতে হয়।
এই সব প্রকল্পে জনসাধারণের সামান্যতম উপকার না হলেও তাদের টার্গেট পিপল অর্থাৎ সেই নির্দিষ্ট মানুষগুলোর অর্থের সংস্থান হয়ে যায়।তারা প্রকল্প বাস্তবায়ন-সরবরাহ সহ নৈতিক অনৈতিক নানা ভাবে এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অর্থনৈতিক ভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠেন।
যেহেতু এগুলো কোন কাজের প্রকল্প নয় সে জন্যেই সরকার বাহাদুর সত্যিকারের উন্নয়ন মূলক কাজের ফাকে ফাকে ঐ সব প্রকল্প জুড়ে দেয়। উন্নয়নের ঢোলের শব্দে সাধারণের মাথায় আসে না কোন প্রকল্পটা কাঁদের স্বার্থে।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে দেশের সকল সেক্টরে নিজেদের লোক থাকা চাই। আর সেটা নিশ্চিত করতেই তারা ইউনিয়ন নামক নিজস্ব এজেন্ট তৈরি করেন। সরকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সবগুলো বড় রাজনৈতিক দলের এই এজেন্ট রয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকেন তখন সে সব দলের এজেন্টরা দোর্দণ্ড প্রতাপে থাকেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি-পদোন্নতি-নিয়োগ-ক্রয় সব ক্ষেত্রেই তারা প্রভাব বিস্তার করেন। উদ্দেশ্য একটাই আর তা হল আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া।
সমস্যা হল সরকারী প্রতিষ্ঠানের বাইরে তো আর এই ব্রাঞ্চ তৈরির উপায় নেই, সে ক্ষেত্রে কি হবে? সেখানে কি করে এজেন্ট নিয়োগ করা হবে?
উপায় তো একটা বের করতেই হবে। সে কারণেই এ সব ক্ষেত্রে ইভেন্ট এর ব্যবস্থা করতে হয়। এখানে লক্ষ রাখা হয়; ইভেন্টগুলির ডিজাইন এমন ভাবে করতে হবে যাতে প্রয়োজন না থাকলেও সাধারণ মানুষ তাতে অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
উদাহরণ সরূপ আমরা বলতে পারি। শিশু এবং অভিভাবকদের উপর চাপিয়ে দেয়া প্রাথমিক সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার কথা। যা শিশুদের মেধা বিকাশে কোনও কাজে না আসলেও। দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদগণের বিপক্ষে অবস্থান স্বত্বেও সরকার এই ব্যবস্থা চালু করেছে এবং সব মহলের উষ্মা প্রকাশ স্বত্বেও একে চালু রেখেছে। সম্ভবত তারা শেষ পর্যন্তই এটা রাখার চেষ্টা করে যাবেন। কেননা এখানে উপকৃত এজেন্টের সংখ্যা অনেক বেশি।
প্রথম থেকেই শিক্ষাবিদ গন এর বিপক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন এ পরীক্ষা পদ্ধতি শিশুদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমন কি তাদের মতে সর্বনাশা এ পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিলের কোনও বিকল্প নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ এ পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে মানব বন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছেন। অথচ সরকার এই পদ্ধতি বাতিল করে নি এবং কোনদিন করবে বলেও আভাস দেয়নি।
শিক্ষাবিদ গন একে যতই সর্বনাশা বলুন না কেন তারা তো এই ইভেন্ট দুটির অর্থ নৈতিক উপযোগিতাকে বিবেচনায় নেন নি। আমাদের নেতা কর্মী সমর্থকদের ভাল রাখতে হবে। তাদের স্বার্থ দেখতে হবে। কাজেই পরীক্ষা নামের এই ইভেন্টের অর্থনৈতিক উপযোগিতা বিবেচনায় নিয়েই জোর দাবী জানাচ্ছি পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষার মত লাভজনক এই ইভেন্টটি যেন কোনভাবেই বাতিল করা না হয়। এই দাবীর স্বপক্ষে আমরা এর অর্থনৈতিক উপযোগিতার কয়েকটি দিক নির্দেশ করছি।
এক, পিইসি পরীক্ষা এবং জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। অতএব খুব স্বাভাবিক ভাবেই বোঝা যায় এর সাথে কি পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের বিষয় জড়িয়ে আছে।
দুই, ২০১৫ সালে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়েছে। আর ৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ এখানেও বিশাল অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়।
তিন, এই পরীক্ষায় পাশের জন্য প্রাইভেট পড়ার নির্ভরশীলতা বাড়ছে যাতে শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা হয়েছে।
চার, প্রাথমিক সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার শিক্ষার্থীদের জন্য গাইড বই আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। অতএব এই ইভেন্টের ফলে প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ ঘটছে।
সবশেষে বলব যাদের জন্য পরীক্ষা এবং যারা যারা এ পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত সবাই এ পরীক্ষা বাতিলের দাবি করছেন তাদের স্বার্থে কিন্তু যে মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছে তাকে মাথায় রেখেই একে চালু রাখতে হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে নেতা কর্মী ভাল থাকলে দল ভাল থাকবে দল ভাল থাকলে দেশ ভাল থাকবে। ব্যক্তির জন্য দল, দলের জন্যই দেশ!
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩২