somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অধ্যাপক জাফর ইকবাল হলেন এক আলোকবর্তিকা

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৩:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার বিকালে হামলার পর ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে।

সামান্য আগেই যার হাত প্রাণ নিতে উদ্ধত হল, যার চাকুর আঘাতে তিনি রক্তাক্ত হয়ে ঢলে পড়লেন সামান্য সময়ের ব্যবধানে, হামলার পর যখন তার সন্তান সম ছাত্ররা সেই হামলাকারীকে ধরে গণধোলাই দিচ্ছিল, তখন তিনি নিজের যন্ত্রণা ভুলে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলেন- “আমার কিছু হয় নি, তোমরা ওকে মেরো না। তোমরা ওকে মেরো না!” কিন্তু কেন এই পার্থক্য দুজনের মধ্যে? সে-কি কেবলই শিক্ষক আর ছাত্র বলে? একজন উচ্চ শিক্ষিত আরেক জন কেবল শিখছে বলে?

আসলে এই পার্থক্য শিক্ষার নয়, আলোর ব্যবধানের। একজন আলোকিত মানুষ, আরেকজন অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে না পারা হিংস্র দানব। সব শিক্ষাই আলোকিত করতে পারে না। সকল হৃদয় মহত্ব নিয়ে জন্মায় না, উদারনৈতিক হয়ে বেড়ে ওঠে না। খুব কম সংখ্যক মানুষই সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়। একজন মহৎ হৃদয় মানুষ তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও হতে পারেন আলোকিত। আবার একজন নীচু প্রকৃতির মানুষ উচ্চ শিক্ষিত হয়েও থেকে যেতে পারেন অন্ধকারে। তবু এটুকু আশা করা যেতেই পারে, একজন শিক্ষিত মানুষ শিক্ষার আলোয় মহৎপ্রাণ না হয়ে উঠতে পারলেও অন্তত অন্ধকার জগতের বাইরে এসে দাঁড়াতে সক্ষম হবেন। প্রশ্ন হল- বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিবার-সমাজ এবং রাষ্ট্র কি সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছে? আমরা কি সত্যিই কি একটি আলোকিত প্রজন্ম পেতে যাচ্ছি, অথবা বলা যায় চাইছি কি? একটি আলোকিত প্রজন্ম পাওয়ার জন্য আমরা কতটাইবা উদগ্রীব?

এ প্রশ্নটা এসে যায়, যখন দেখি আমাদের তরুণ প্রজন্ম খুব সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে আর তাদের সেই বিভ্রান্তি দূর করার জন্য তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে নেয়া হচ্ছে না। কি সততায়, কি বিশ্বাসে, কি ভালোবাসায়- কোথাও একফোঁটা আলোর নিশানা নেই। আমরা আমাদের সন্তানদের মানুষ নয়, ভবিষ্যতের প্রতিযোগি করে গড়ে তোলার চেষ্টায় রত। আর সে কারণেই মা-বাবা সন্তানের হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র তুলে দেন নির্দ্বিধায়।

প্রকৃত ধর্মশিক্ষা মানুষকে শান্ত করে, উদার করে। ধর্মের অপব্যাখ্যা মানুষকে অশান্ত করে, উন্মাদনায় ডুবিয়ে রাখে। এটা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের ক্ষেত্রে নয় বরং প্রচলিত সকল ধর্মের ক্ষেত্রে একই রূপ দেখতে পাওয়া যায়। যা স্থান-কালের পার্থক্যে এক এক জায়গায় একেক রূপ। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য জুড়ে একই অবস্থা। যেখানে যারা সংখ্যাগুরু সেখানে তারাই উন্মাদের মত আচরণ করছে।

ধর্ম মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে বাদ দিয়ে জীবন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় না। রাষ্ট্রও তা স্বীকার করে নিয়েছে। আর সে কারণেই শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মের অন্তর্ভুক্তি। সমস্যা হল রাষ্ট্র একে স্বীকার করে নিয়েছে সত্য, কিন্তু ভাসা ভাসা একটি ধারণা দিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে। যা একজন শিক্ষা অনুরাগীকে আরও বেশি ক্ষুধাতুর করেছে। সে তখন আরও জানতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সঠিক শিক্ষাটা দিতে তেমন কেউই এগিয়ে আসছে না। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটি। জীবনের সব থেকে প্রয়োজনীয় যে ধর্মীয় বিধান, আমরা তার কতটুকু আমাদের সন্তানদের শেখাতে পারছি? আমরা ধর্ম শিক্ষা বলতে ধর্মগ্রন্থ পড়তে শেখা কিংবা মুখস্থ করাকে বুঝি, কিন্তু তার অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। আমরা মনে করি ধর্ম গ্রন্থের অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কেবলমাত্র কিছু মানুষের জেনে নিলেই হবে। যাদের কাছ থেকে আমরা প্রয়োজন অনুযায়ি জেনে নিতে পারব। এটা তো কোন সেবামূলক শিক্ষা নয় যে আমি প্রয়োজন অনুযায়ি সেবা নেব। ধর্ম প্রত্যেকের জন্য একান্ত পালনীয় কিছু নির্দেশনা দেয় যার সঠিক জ্ঞান থাকা সবার জন্য জরুরি। না হলে যেকেউ তাকে খুব সহজেই মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারবে। যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। রাষ্ট্র বিভ্রান্ত তরুণদের ধরে জেলে পুরবে, তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করবে না। তাদেরকে অন্যান্য সাধারণ কয়েদিদের সাথে রেখে উল্টো তাদেরকেও বিভ্রান্ত করার সুযোগ করে দিবে, আর কিছুদিন পর তারা জেল থেকে বেরিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে একই কাজ করবে। তাতে লাভটা কি?


অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলার পর আটক এই তরুণ এক মাদ্রাসাছাত্র বলে তার প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন।

আমরা এখনো জানি না এই ন্যক্কারজনক কাজটি কারা করিয়েছে? প্রকাশিত খবর অনুযায়ি বেদম মার খেয়েও হামলাকারী কিছু বলেনি। তবে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যার যে ধরনের নির্বিবাদী মানুষ এবং তার উপর ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আক্রোশ, সেই সাথে দেশে বেশ কিছুদিন ধরে ঘটে চলা উগ্রবাদীদের তাণ্ডব, এমনকি স্যারকে মারার ধরন, সব মিলিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি- সম্ভবত এটা সেই অন্ধকারের মানুষ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীরই কাজ। অথচ অদ্ভূত বিষয় হলো, ইসলাম আলোকিত মানুষ গড়ার সর্বোত্তম পাঠ দান করে। আর সেই ইসলামের দোহাই দিয়েই এরা একটা প্রজন্মকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে চলেছে! এই গোষ্ঠীটি বিশ্বে যত জায়গায় যতবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ততবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যার কারণ একটাই, মিথ্যের ভিত থাকে ভীষণ নাজুক। তা সহসাই ভেঙ্গে পরে আর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

একজন ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল একটি আলোকবর্তিকা। তিনি যে শুধু ডক্টরেট ডিগ্রিধারী বলেই একজন আলোকিত মানুষ তা নন, তার উচ্চশিক্ষা তার আলোর বিচ্ছুরণের পথ উন্মুক্ত করেছে মাত্র। প্রকৃতপক্ষেই তিনি একজন আলোকিত মানুষ। একজন আলোকিত মানুষ যখন উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন তখন তার ভেতরের আলোর জেল্লা বেড়ে যায় বহুগুণ। কিন্তু আলোহীন হৃদয়ের মানুষ যতই উচ্চশিক্ষিত হন না কেন তা তার অন্তরকে খুব একটা আলোকিত করতে পারে না। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যা শিখছে তা তাকে আলোকিত করছে না; ধর্মান্ধ করছে, প্রতিহিংসা পরায়ণ করে তুলছে, তাদেরকে অস্বাভাবিক করে তুলছে। রাষ্ট্র কি সেটা অনুধাবন করতে পারছে? সম্ভবত পারছে না। আর পারছে না বলেই সমস্যার মূলে যাচ্ছে না। সমাধানের চেষ্টা করছে না। রাষ্ট্র এখন যেটা করছে তাকে কেবল একটি বিষবৃক্ষকে কেটে ছেঁটে বামন করে রাখা বলা যেতে পারে, সমূলে উচ্ছেদ নয়। যার ফল কখনোই শুভ হতে পারে না।

যারা এতদিন ধরে সামান্য প্রশ্ন ফাঁসের গ্যাঁড়াকল থেকেই বেড়িয়ে আশার সামর্থ্য দেখাতে পারেনি, তাদের কাছে এই দুরূহ সমস্যার সমাধান আশা করাটা নেহায়েত বোকামি বৈকি! তথাপিও আমরা নিরুপায়। সবশেষে রাষ্ট্রের এসব পরিচালকদের দিকেই আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে। কবে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, আমাদেরকে সেদিনের অপেক্ষায় থাকতে হবে। আর এরই মধ্যে যে আমরা আরও কত আলোকবর্তিকাকে আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেখব, নিভে যেতে দেখব- তা একমাত্র মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৩:১৯
১৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×