ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণীর দু'বছর গ্রামের হাইস্কুলে ছিলাম। আমার সাথে একটা মেয়ে পড়ত। সাথী। দেখতে শ্যামলা, চিকন গড়ন আর ঘাড় সমান ছোট সিল্কি চুল। মাঝে মাঝে দুই ঝুঁটি করত আবার অনেকসময় চুল ছেড়েই স্কুলে চলে আসত। খুব চঞ্চল ছিল। সারাক্ষণ লাফালাফি, চিৎকার চেঁচামেচি করে ক্লাস মাতিয়ে রাখত। হিন্দি, বাংলা সব গান ওর ঠোঁটস্থ ছিল। 'গানের কলি'তে ওকে হারাতে পারে এমন আর কেউ ক্লাসে ছিলনা। আমাদের পাশের গ্রামেই বাড়ি। প্রায়ই স্কুল ছুটির পর আমার পথের সাথী হত। এটা সেটা গল্প করতে করতে আধাআধি পথ একসাথে এসে পথ আলাদা হয়ে যেত। এভাবেই মোটামুটি ভাল বন্ধুত্ব হয়েছিল। মাঝে মাঝে ওদের বাড়ি বেড়াতেও যেতাম। আন্টি খুব আদর করতেন। হরেক রকম খাবার তৈরি করে খাওয়াতেন। আর বাড়িতে গেলে ওর চাঞ্চল্য আরো বেড়ে যেত। গল্প উপন্যাসে গ্রামের মেয়েদের যেসব দস্যিপনার বর্ণনা থাকে সবই ওর মধ্যে ছিল। অষ্টম শ্রেনীতে ওঠার পর ওর সাথে আর দেখা হয়নি।
এইচএসসির পর যখন দেশে ফিরি, শুনি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। একটা ছেলেও আছে। শুনে কেমন যেন লাগছিল 'এরইমধ্যে বিয়ে হয়ে গেল আবার বাচ্চাও হয়ে গেল!' এরপর কয়েকবার গ্রামে গেলে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। খুব ইচ্ছে ছিল ওকে দেখার কেমন হয়েছে এত বছর পর। দেখা হয়নি। বাবার বাড়ি বেশি আসেনা। স্বামী,সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমার নিজেরও পড়াশুনা, চাকরি নিয়ে ব্যস্ততা। তাই আর যোগাযোগও হয়ে ওঠেনি।
সেদিন এক চাচাতো বোন ফোন করে বলল, 'শুনেছিস? তোদের সাথে যে পড়ত একটা মেয়ে, সাথী নামের? ও মারা গেছে!' ব্রেইন স্ট্রোক করেছিল নাকি। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। সাথী আর পৃথিবীতে নেই! ঘন্টাখানেক ঝিম মেরে বসে ছিলাম। আমার চোখের সামনে শুধু দুই ঝুঁটি ঝোলানো, স্কুলের নেভী ব্লু ফ্রক আর সাদা ওড়না পরা চঞ্চলমতি মেয়েটার মুখটা ভাসছিল। সেই সাথী আজ নেই? কতইবা বয়স? সুন্দর সাজানো সংসার, স্বামী, দুই ছেলে ফেলে আজ সে পরপারে। এক লহমায় সব শেষ হয়ে গেল! আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসি করুন।
আহ, দুনিয়া কয়দিনের! অথচ প্রতিনিয়ত আমরা কত পার্থিব সুখস্বপ্ন বুনে যাই, কত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করি! কে নিশ্চয়তা দেবে আমি আগামী ১ বছর,২ বছর বা ৫ বছর বেঁচে থাকব? কে জানে আজই আমার পৃথিবীর শেষ দিন কিনা! আল্লাহ আমাদের পরপারের প্রস্তুতি নেবার তৌফিক দান করুন। আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন। আমীন।।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩১