somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বীর সালাউদ্দিন গাঁথা

০৪ ঠা মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৯৭১ সালে অনেক মৃত্যু ছিল ভয়াবহ ও হৃদয় বিদারক। পাকিস্তানী আর্মি ও তাদের দোসররা এদেশের মানুষেকে নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংস করার জন্য অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করে। মানুষ হত্যার নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করে, বিভিন্ন আদিম উপায় থেকে শুরু করে আধুনিক রাইফেলের গুলি। এই অধ্যায়টি ছিল মানুষের প্রতি মানুষের চরম অমানবিকতার কালঅধ্যায়। যেই সকল মানুষগুলো এই গনহত্যায় লিপ্ত ছিল তারা হল মানুষের বেশধারী হিংস্র বর্বর পশু।চরমভাবে মানব জীবনের পবিত্রতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই সব বর্বর ঘটনার শিকার অনেক মানুষ এমন চরম মুহূর্তে দুর্দান্ত সাহস, অসীম মানসিক শক্তি ধারণ করে হাসিমুখে মৃত্যুবরন করেছে। প্রত্যেকটি ঘটনা একেকটি কষ্ট ও দুঃখের উপাখ্যান। এমন একটি চরম নিষ্ঠুরতার উপাখ্যান ঘটেছিল উত্তরের শহর ঠাকুরগাঁওে।

এই বিয়োগান্তক উপাখ্যান যুবক মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মাদ সালাউদ্দিনের। ১৯৭১ সালে যখন বর্বরতার শুরু, তখন ১৮ বছর বয়সী সালাউদ্দিন দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সালাউদ্দিন তার সহচরদের নিয়ে বর্ডার অতিক্রম করে মলয় যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। সেখান থেকে বাংলাদেশের কিশোর যুবকদের দার্জিলিং সন্নিকটে পানিঘাটা মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে একমাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। কঠোর প্রশিক্ষণের সময় সালাউদ্দিন নিজেকে শক্ত মানসিকতার উদ্যমী যুব মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রমান করেন। ট্রেনিং শেষ হবার পরে তিনি ছয় নং সেক্টরে যোগদান করেন এবং গোদাগঞ্জ ও পীরগঞ্জের অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি অপারেশনে তিনি নিজেকে সঠিকসিধান্ত গ্রহণকারী ও জনপ্রিয় একজন যোদ্ধা হিসাবে প্রমান করেন।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ১০ নভেম্বর ১৯৭১ সালের এক সকালে, সালাউদ্দিন তার পরিচিত একজনের মাধ্যমে খবর পান যে ঠাকুরগাঁয়ে তার পিতাকে পাকি আর্মি অপহরন করেছে।খবর শুনে সালাউদ্দিন যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়েন। বাসার বড়ছেলে হিসাবে পরিবারের দুর্দশার কথা ভেবে সালাউদ্দিন নিজের কর্তব্য বুঝে নেন। সেই দুপুরেই তিনি চুপিচুপি ক্যাম্প ত্যাগ করেন কোন অস্ত্র ছাড়াই। শুধু একজন বিশ্বস্ত সহচর মুক্তিযোদ্ধাকে জানিয়ে যান। তিনি সেই সহচর মুক্তিযোদ্ধাকে বলে যান যে তিনি বাসা গিয়ে দ্রুত ফেরত আসবেন। তিনি প্রায় বিশ কিমি পায়ে হেঁটে ঠাকুরগাঁও পৌঁছান। যখন বাসায় পৌঁছালেন তখন চারিদিকে অন্ধকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একজন রাজাকার তাকে বাসায় প্রবেশকালে চিনে ফেলে। সালাউদ্দিন এই বিষয়ে কোন খেয়ালই করেন নি। বহুদিন পর সালাউদ্দিন কে দেখে তার বাবা মা অবাক হওয়ার সাথে সাথে অতিআনন্দে তাকে জড়িয়ে ধরে।পাক বাহিনীর হাতে ধরাপড়া পিতাকে সে বাসায় দেখে অবাক হয়। সালাউদ্দিন বুঝতে পারে সে ভুল খবর পেয়েছিল এবং তার জন্য একটা ফাঁদ অপেক্ষা করছে। দ্রুততার সাথে সে তার পিতামাতার কাছে বাসা ত্যাগের অনুমতি চায়। কিন্তু তার মা তাকে আদর করে কিছু ডাল ভাত খাওয়াতে গেলে সেখানে কিছু সময় নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক সেই সময়ে অসময়ের ফোঁড়ের মত পাকিস্তানী সৈন্যদল ও রাজাকার বাহিনী আর্মি ট্র্যাক থেকে নেমে তার বাসা ঘেরাও করে। পাকিস্তানী আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন জামান মেগাফোনে চীৎকার করে সালাউদ্দিন উদ্দেশ্য করে বলে বেরিয়ে আসতে নাহলে তার পরিবারের সবাইকে জবাই করা হবে।সালাউদ্দিন বুঝতে পারে এটা কোন সতর্কতা নয় বরং এটা একটা চূড়ান্ত নির্দেশ এবং যেটা অমান্য করলে ক্যাপ্টেন কোন দয়ামায়া দেখাবে না। তাই সে বাসা থেকে বের হয়ে সোজা ক্যাপ্টেনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সৈনিকেরা দ্রুত তাকে বেধে জিপের পিছনে ফেলে দিল। তার পিতামাতার সকল অনুনয় বিনয় বৃথা গেল।

সালাউদ্দিন কে ঠাকুরগাঁও আর্মি ক্যাম্পে নেওয়া হল যেটা পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল ক্যাম্প ছিল। সেখানে তাকে ক্যাম্প কমান্ডার মেজর হোসেন বেগের সামনে উপস্থাপন করা হল। মেজর হোসেন বেগ ছিল একজন কুখ্যাত এবং নৃশংস অফিসার যে ঠাকুরগাঁও জনপদে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল। মেজর বেগ একজন মুক্তিযোদ্ধা কে গ্রেফতার দেখে তৃপ্ত হয় এবং দ্রুত ক্যাপ্টেন জামানকে ইন্টারোগেশন পদ্ধতি অবলম্বনের নির্দেশ দেয়। সৈন্যদল তাকে বেদম মারধর করে তার কাছে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প, তাদের অস্ত্র, মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ঠিকানা, তাদের ভবিষ্যতের অপারেশন পরিকল্পনা ইত্যাদি জানতে চায়। কিন্তু সালাউদ্দিন তাদের কোন তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সারা দিন রাতের অমানুষিক নির্যাতন পুরোই বিফলে যায়। মেজর বেগ ক্রোধে ফেটে পড়ে শাস্তি দেওয়ার এক ঘৃণ্য পরিকল্পনা করে।

পরদিন সকালে, রাজাকারদের দেখা যায় ঠাকুরগাঁও শহরের রাস্তায় ভ্যান গাড়ি চালিয়ে মাইকিং করেতে। তারা ঘোষণা করে যে সেদিন দুপুরবেলা আর্মি ক্যাম্পে একটি ভিন্নধরনের বিনোদনের বেবস্থা করা হয়েছে। সকল আগ্রহী জনতাকে সেই বিনোদনের সাক্ষী হবার আহব্বান জানায় তারা। ঠাকুরগাঁয়ের মানুষের সেই বিষয়ে কোন ধারনাই ছিল না তবে তারা মেজর বেগের কুকর্মের বিষয়ে সজাগ ছিল। তাই সাধারন মানুষ ঘরেই অবস্থান করে।

সেদিন দুপুরে রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য ও অবাঙ্গালীদের ছোট্ট ভিড় জমে উঠে আর্মি ক্যাম্পে একটি বড় খাঁচাকে ঘিরে।তারা সেই খাঁচায় দুটি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ তাদের দুটি ছানাসহ দেখতে পায়। মেজর বেগ জোরপূর্বক এই বাঘ গুলোকে সার্কাস পার্টির কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিল। উপস্থিত দর্শকরা প্রথমে ভেবেছিল যে মেজর বেগ তার পুরস্কারের প্রদর্শনী হিসাবে সে গুলো রেখেছিল।

কিন্তু পরে তাদের ভুল ভেঙ্গে যায়। কিছুক্ষণ পরেই সালাউদ্দিন কে খাঁচার সামনে টেনে হিঁচড়ে আনা হয়। তার কাপড় চোপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছিল এবং সে হাটতে পারছিল না। মনে হয় তার হাত পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা জানত সালাউদ্দিন মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছে।তারা বুঝতেও পেরেছিল যে তাকে খুব নির্দয় ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তবুও তারা একজন আহত মুক্তিযোদ্ধার যন্ত্রণাময় অবস্থা দেখে ভীষণ খুশী ছিল। এমন সময় মেজর বেগ সালাউদ্দিনের সামনে এলেন বললেন, “তোমার জীবন বাঁচানোর শেষ সুযোগ, তোমার জীবন বাঁচানোর জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় সকল তথ্য দাও”। সালাউদ্দিন মেজর বেগের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল এবং তার মাথা দৃঢ়তার সাথে উঁচু করে থাকল। মেজর বেগ তার বর্বর তৃষ্ণা একজন আহত পঙ্গু নিরস্ত অসহায় মানুষের রক্ত দিয়ে মিটানোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল।

এর পরে যা ঘটেছিল তা মানুষ কেবল মধ্যযুগের রোম বইয়ের প্রচ্ছদে দেখেছে। মেজর বেগের নির্দেশে পাকিস্তানী সৈন্যরা সালাউদ্দিনকে হাত পা বেঁধে খাঁচার ভিতরে ছুড়ে ফেলে দেয়।হৃদয়হীন দর্শক হায়েনার দলের ব্যাঙ্গবিদ্রুপ হাসি ভেসে উঠে। অতিদ্রুত ক্ষুধার্ত দুই বাঘ সালাউদ্দিনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ধারালো দাঁত দিয়ে তার মাংস ছিরে খাওয়া শুরু করে। তারা তার দেহ টুকরো টুকরো করে তৃপ্তি করে খেতে থাকে। দ্রুতই ছোট দুই ব্যাঘ্রশাবক তাদের আহারে অংশগ্রহন করে।

অবশিষ্ট হিসাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিনের রক্তের দলা, কিছু হাড়গোড়, দলা পাকানো কাপড়ের টুকরো পড়ে থাকে। তখনও বাঘেরা ও ছানারা সালাউদ্দিনের হাড় কুড়মুড়িয়ে খেতে থাকে। এই অকল্পনীয় অকথ্য নিষ্ঠুরতা, ব্যাঙ্গবিদ্রুপ সালাউদ্দিনের কাছে আর পৌঁছাচ্ছিল না। নিষ্ঠুরতা কে পরাজিত করে, তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুবক সালাউদ্দিন বন্দী ছিল কিন্তু কোন তথ্য শত্রুর হাতে তুলে দেয় নি। এভাবেই বিজয়ী সালাউদ্দিন তার সৃষ্টিকর্তা কাছে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশের মাটির তৈরি ছেলের রক্ত মাটিতে মিশে যায় ধীরে ধীরে।

মূল লেখকঃ লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক)
অনুবাদঃ ভ্রমরের ডানা
বিঃ দ্রঃ লেখাটি ঈষৎ পরিবর্তনীয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২০ বিকাল ৩:২৬
৮টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×