প্রতিদিনকার মত আজকেও ঠিক রাত তিনটায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তবে প্রতিদিনকার মত আজ তেমন কোন ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখিনি। খুউব স্বাভাবিক ভাবেই ঘুম ভেঙ্গেছে, কেবল খুব তেষ্টা পাচ্ছিল। কপালের ঘাম মুছে বেডসাইড টেবিলে রাখা পানির বোতল খুলে ঢকঢক করে পানি খেলাম। মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঠিক তিনটে বাজে। কি করে যেন আমার বডিক্লক রাত তিনটায় সেট হয়ে গিয়েছে। প্রতিরাতেই রাত তিনটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে যাবে, এরপর সারাটি রাত ধরে এক সেকেন্ডের জন্যেও চোখ বন্ধ করতে পারবো না। সকালে অফিস আছে ভেবেই প্রমাদ গুনলাম। প্রতিরাতেই তীব্র কষ্ট হয়। এই ইনসমনিয়া থেকে কবে মুক্তি পাবো কে জানে?
যে রাতে দীঘি চলে গেল তারপর থেকেই ঠিক তিনটায় আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। আজ পাঁচটি বছর ধরে রাত তিনটার ভুত আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে।
সেদিন ছিল শরতের রাত। ফকফকা জোছনা ছিল, দীঘি জোছনা খুব পছন্দ করতো। প্রতি জোছনারাতেই সে পাটি নিয়ে ছাদে চলে যেত জোছনা বিলাস করতে। দিনরাত হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ে পড়ে ওর মাথায় কিঞ্চিত গন্ডগোল হয়েছিল। ওর সেই জোছনাবিলাসের সাথী হতে হতো আমাকে। পরদিনের অফিসের কথা ভেবে প্রচন্ড বিরক্ত হলেও ওর কিছু কিছু ছেলেমানুষীর প্রশ্রয় আমিই দিতাম। জোছনা আমার পছন্দের না হলেও ওর সাথে রাত জেগে জোছনা দেখতাম। ভাবতাম কি আছে এই জোছনায় যা এমন করে দেখতে হবে? শুধু একজন প্রচন্ড রূপবতী তরুণী অবাক হয়ে চাঁদের দিকে অশ্রুসজল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে এই দৃশ্য দেখতে আমার ভালো লাগতো। কিছুতেই বুঝে পেতাম না, জোছনা দেখে যদি কাঁদতেই হয় তবে কেন জোছনা দেখা? দীঘির অনেক কিছুই আমি বুঝতাম না। আমি কেবল ওকে প্রশ্রয় দিতাম, যা চায় করুক, যেভাবে মন চায় সেভাবে ভালো থাকুক।
শরতের সেই জোছনা রাতে দীর্ঘক্ষণ ছাদে থেকে ঘরে যখন ঘুমাতে এলাম দীঘির চোখে তখন নিদারুণ কাঠিন্য ছিল। জোছনা দেখার পরে ওর মাঝে কেমন যেন কাঠিন্য চলে আসতো। ওকে বড্ড অপরিচিত লাগতো। আমি সেই কাঠিন্য আগ্রাহ্য করেই ঘুমুতে গেলাম। হঠাৎ রাত তিনটার দিকে গোঁ গোঁ শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। লাফিয়ে উঠে দেখি দীঘির মুখ দিয়ে প্রচন্ড ফেনা ভাংছে, বুকটা হাঁপরের মত উঠছে নামছে আর গলা দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। প্রথম চমকটা কাটিয়ে উঠেই লাফ মেরে বিছানা থেকে উঠে দীঘিকে কোলে নিয়ে নীচে নেমে যাই। গভীর রাত, কোথাও কোন যানবাহন নেই। দীঘির নিথর দেহটাকে নিয়ে আমি পাগলের মত দৌড়াতে থাকি। ভাগ্যক্রমে একটা রিক্সা পেয়ে যাই। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই দীঘি চলে যায়...
দীঘি চলে যায়, আর আমাকে দিয়ে যায় অনিদ্রা রোগ। প্রতিরাতে ঘুম থেকে উঠে আমি ভোরের প্রতীক্ষা করি। সেই প্রতীক্ষা ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক, মৃত্যু যন্ত্রণাও বোধহয় এরচে’ কম। দীঘি কত সহজেই না মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিল! কতইবা বয়স হয়েছিল তার? মাঝে মাঝে ভাবি কেন তাকে এত দ্রুত চলে যেতে হল? আর কয়েকটা রাত আমার সাথে জোছনা দেখলে কি এমন ক্ষতি হত? যখন কোন বুড়োবুড়িকে একসাথে দেখি আমার মেয়েদের মত হিংসে হতে থাকে। দীঘি প্রায়ই আমাকে বলত- আমরা যখন বুড়ো হবো তখনও ঠিক এমনভাবে জোছনা দেখবো। একদিক দিয়ে দীঘি ভাগ্যবতী, ওকে কখনো বুড়ো হতে হবে না। ওর গালে কখনো বয়সের ছাপ পড়বে না। চিরতরুণী হয়ে থাকবে চিরকাল। কিন্তু আমার খুব শখ ছিল বুড়ো দীঘিকে দেখার। কেমন করে দীঘি ওর নাতি-নাতনীর সাথে গল্প করে সেটা দেখার। সামনের পাঁটির দুটো দাঁত পড়ে গেল কেমন দেখাতো ওকে সেটা দেখার... দীঘিকে কেন এভাবে চলে যেতে হল? কীসের এত তাড়া ছিল ওর? মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয়... চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। একজন নিঃসঙ্গ ইনসমনিয়াকের রাতগুলো এমনই। দু’চোখ কড়কড় করে উঠে।
আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। নতুন আরেকটি দিন, দীঘিকে ছাড়া! হাতে উষ্ণ এককাপ কফি নিয়ে ভোর হওয়া দেখছি। পত্রিকাওয়ালা ছেলেটা সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ঘন্টা বাজিয়ে এগিয়ে আসছে। বারান্দার ঘুপচিতে বাসা বাঁধা চড়ুই পাখিটা কিচির মিচির শুরু করেছে। জেগে উঠছে নগরী!