♣
আলোচনা শুরু করব একটি প্রশ্ন দিয়ে, ধর্ষণ কতটুকু যৌনতৃপ্তির নিয়ামক?
১.
যাঁরা বিবাহিত আছেন, তাঁরা স্বীকার করবেন নিশ্চিত, জবরদস্তি করে সঙ্গমে কোন তৃপ্তি নেই। এতে কেবল বিরক্তি তৈরি হয় এবং দাম্পত্য কলহই সৃষ্টি হয়। এই জবরদস্তিতে উভয় পক্ষেরই অত্যাচার হয়, আগ্রহী অনাগ্রহী উভয় পক্ষেরই। তাহলে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, জোর করে সঙ্গমে কোন যৌন তৃপ্তি ঘটে না।
২.
বিয়ে হবার পর একটানা তিনদিন চেষ্টা করার পর এক দম্পতি সফলভাবে সঙ্গম করতে পেরেছিলেন, এমনটা আমার জানা আছে। দুই পক্ষই আগ্রহী, পরিবেশও অনুকূল, অথচ তারপরও সঙ্গম সম্ভব হচ্ছে না! তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয় এরচেয়ে আর স্পষ্ট করে বলতে চাইছি না। অভিশাপ আপনার মানসিকতাকে যদি এই ভেবে মুচকি হাসেন যে, তিনদিন লাগে যার, সে নিশ্চিত আধা হিজড়া!
অভিশাপ এমন চিন্তা করা মানুষদের!
তাঁদের পরস্পরকে বুঝতে সময় লাগছিল, পরস্পরের প্রস্তুত হয়ে উঠতে সময় লাগছিল এটাই মূল কারণ। সঙ্গমে এই পরস্পরকে বোঝার ব্যাপারটা জরুরি, নইলে সেটা সুখকর হয় না।
৩.
পতিতাপল্লীতে অনেকে গিয়েও এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে যে, সব আয়োজন পাবার পরও শিশ্ন উত্তেজিত হচ্ছে না! এই মানুষগুলোকে অক্ষম পুরুষ বলবেন আপনি?
মোটেই না! এই পুরুষটা জানোয়ার নয়, সে শরীর আর মনস্তত্বের সম্বন্ধটা বোঝে। তাকে দিয়ে প্রেম হবে, সঙ্গম হবে, ধর্ষণ হবে না। আমি এমন পুরুষকেই প্রকৃত পুরুষ বলব। যে পুরুষ পতিতা পল্লীতে গিয়ে নগ্ন শরীর পাওয়া মাত্রই নিমিষে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে উত্তেজিত শিশ্ন নিয়ে, তাকে এই সমাজের ভয় পাবার কারণ আছে। এই মানুষটার মাঝেই ধর্ষক হবার মানসিকতা আছে!
যার যখন তখন শিশ্ন উত্তেজিত হয়ে যায়, সে সত্যিই সমাজের জন্য আতঙ্ক!
যখন কলেজে পড়তাম, তখন এক সহপাঠী একবার ইন্ধন দিয়েছিল পতিতা পল্লীতে যাবার! আমি অবাক হয়ে বললাম, আলমগীর, আমি যাকে চিনি না, জানি না, যার প্রতি আমার কোন ভালো লাগা নেই আমি গিয়ে মাত্রই গরুর মত তার গায়ের উপর উঠে যাব কিভাবে? আগে আমার আবেগ তো জাগতে হবে!
ও বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তুই ভাবতেই থাক, আমি বরং ওখান থেকে ঘুরে আসি। তোর এখনও এই আবেগ জাগার ক্ষমতা হয় নাই!
আমি অবশ্য মনে মনে আরও দুইটি জিনিস ভাবছিলাম, একমাস পরিশ্রম করে টিউশনি থেকে পাচ্ছিলাম পাঁচশো টাকা, সেই টাকার অর্ধেক দিয়ে দেব কেবল আধা ঘণ্টার সুখের জন্যে!! এত বিলাসিতার সাহস আমার হয়নি; আর ভাবছিলাম, ওখানে গেলে যদি রোগ বেঁধে যায় কোনো! কনডমই তো কেবল সুরক্ষা নয়, যৌনব্যাধি তো লালার মাধ্যমেও ছড়াতে পারে! "বেঁচে গেছি"- নিজেকে এই সান্ত্বনা দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলাম।
৪.
আমি নীতি নৈতিকতা সততার ঢোল পেটাচ্ছি না, আমি এটাই বুঝি যে, যৌনতা এভাবে হয় না। একটা মেয়েকে কাছে পেলেই বা ধরে এনেই অমনি শিশ্ন ঢুকিয়ে দেওয়া কিভাবে সম্ভব সেটাই আমি ভেবে পাই না। সুখময়, উপভোগ্য যৌনসঙ্গমের জন্য মানসিক একাত্মতা লাগে, নিরবিচ্ছিন্ন পরিবেশ লাগে। তাড়াহুড়ো করে এটার স্বাদ কখনও পাওয়া যায় না, অতৃপ্তি নিয়ে ফিরতে হয় তখন। তাহলে একজন ধর্ষক এটা কিভাবে পারে সেটাই মারাত্মক আশ্চর্যের বিষয় ঠেকে আমার কাছে! আমার যা মনে হয়, ওখানে সঙ্গম হবার চেয়ে ধস্তাধস্তি আর খামচি কিল থাপ্পড় ইত্যাদি শারীরিক অত্যাচারই বেশি হয়! তাহলে এই জিনিসে কাজ কী? কোথায় যৌনসুখ?? কেন এটা করবে মানুষ? ঝোঁকের বশে, জেদের বশে কী একটা মারাত্মক ভুল মানুষ করে ফেলছে!!
♣
এবারে আসি ধর্ষণের ধরন প্রসঙ্গে। ধর্ষণের যে খবরগুলো আমরা দেখতে পাই, তাতে দুইটা বিষয় বা ধরন দেখা যায়- আকস্মিক ধর্ষণ এবং পরিকল্পিত ধর্ষণ। এই বিষয় পার্থক্যটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখার আছে।
১.
আকস্মিক ধর্ষণ বলতে আত্মীয় বা প্রতিবেশী কর্তৃক ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণ, পথচারী কর্তৃক সুবিধামত পরিবেশে একা পেয়ে ধর্ষণ ইত্যাদিকে বোঝাচ্ছি। এখানে যে বিষয়টা লক্ষণীয়, তা হল পরিবেশ! একটি খালি ঘরে একটি মেয়ে আপনার সামনে, চারিদিক সুনসান! এমন অবস্থায় আপনি ঈশ্বরকে স্মরণ করে দুই রাকাত নফল নামাজ বা উপাসনায় বসে যাবেন কিনা আমার জানা নেই, তবে আপনার মত নিছক ভদ্র মানুষটি যে হঠাত ওই মেয়েটিকে কাছে টানতে আগ্রহী হয়ে উঠতেই পারেন এটা আমি জানি।
প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিষেধন বেহতর। তাই মেয়েদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের এই পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকা সবার আগে জরুরি! আমি আমার মেয়েকে ঘরে একা রেখে যাবার সাহস করি না, এতে কেউ আমাকে সংকীর্ণ রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক ভাবতে এলে সোজা জুতোপেটা করব। যে স্বাধীনতা আমাকে অরক্ষিত করবে, অনিশ্চিত বিপদে ফেলবে সে স্বাধীনতায় আমি থুথু নিক্ষেপ করি।
আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, আমি মুক্ত চেতনায় বিশ্বাসী, আমি সভ্য রুচিতে বিশ্বাসী কিংবা ধরা যাক আমি একদম সুফি বান্দা, তাই বলে আমার পাশের জন যে রুচিবান, মুক্তমনা, সভ্য, সুফি মহামানব হবে এই ভেবে তো নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায় না, তাই না? আমার সতর্কতা আমাকে আগে নিশ্চিত করতে হবে।
যাইহোক, এরপরও দুর্ঘটনা ঘটে, বিশ্বাসের অপব্যবহার হয়, পরিস্থিতি প্রতিকূলে যায়, সেটা পরের কথা। আমরা প্রথমে নিজেরা সতর্ক হই।
আগের ফ্যান্টাসিটাই আবার তুলে ধরি, একা ঘরে একটি মেয়েকে পেলে আপনি কী করবেন আসলে?
সাধুর ভনিতায় কাজ নেই, আমার নিজেরও হয়ত তাকে কাছে টানার ইচ্ছে জাগতে পারে, সেক্ষেত্রে আমি তাকে ইম্প্রেস করতে চেষ্টা করতে পারি, প্রেমের প্রস্তাব দিতে পারি, বা বিয়ের প্রতিশ্রুতিও দিতে পারি তারপরে এগুতে পারি হয়ত, কিন্তু জোর করে ধর্ষণ করার বা লুটে নেওয়ার ইচ্ছে আমার অন্তত হবে না, আপনার হবে কি?
মানুষ মাত্রই নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে, নিজের কল্পনাজগতে নিজেকেই সবক্ষেত্রে নায়করূপে দেখে! এটা ভালো, এটা উচিত। যে নিজেকে নায়ক হিসেবে দেখে, সে খলনায়কের কাজ কিভাবে করবে সুযোগ পেলেই? যে নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে, সে গর্হিত কাজের দিকে পা বাড়াবার আগে বিবেকের মুখোমুখি হোক এটাই প্রত্যাশা করি। নিজেকে লজ্জিত কেন করব আমরা? চুরি করার সুযোগ পেলেই কি চুরি করব, যদি আত্মসম্মানবোধ থাকে আমাদের? তেমনি পরিবেশ পেলেই নিশ্চয়ই ধর্ষণ করব না, তাই না?
হ্যাঁ, এরকম খালি কামরায় একটি মেয়েকে একা পেলে যদি রিরংসা জাগেই তবে নায়কের মত সুন্দর উপায়ে এগোন, কেবল নাহয় প্রেমহীন প্রতিশ্রুতিহীন যৌনতাই হোক, তবু সমঝোতায় হোক, জবরদস্তিতে নয়।
আর এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি আমার বলার আছে, তা হল- যৌন উত্তেজনাই যদি হয়, সেটা মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যাপার, হস্তমৈথুনেই উত্তেজনা লাঘব করা যায়। এই পাঁচ মিনিটের সাময়িক উত্তেজনার জন্য আপনি কিভাবে ধর্ষণের মত এত মারাত্মক একটা দুঃসাহস করেন? মাত্র পাঁচ মিনিটের উত্তেজনার জন্য নিছক ঝোঁকের বশে বা খেয়ালিপনায় কেইসকাণ্ড, থানা পুলিশ, জেল হাজত কেলেঙ্কারি এত এত ঝুঁকি আপনি নিতে যাবেন কোন নির্বুদ্ধিতায়??
২.
এরপরে পরিকল্পিত ধর্ষণের বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।
ধর্ষণে যৌনতা তো থাকেই না, থাকে কেবল লালসা! ছিঁড়ে নিচ্ছি, খুবলে নিচ্ছি টাইপের একটি পাশবিক মানসিকতা কাজ করে শুধু! এই মানুষগুলো যৌনতায় খুব সক্ষম বলে আমার মনে হয় না, এরা শারীরিক সুখও বোঝে না, কেবল চোখের লালসা আর বিকৃত মস্তিষ্কের কুৎসিত চিন্তাই বোঝে। এই মানুষগুলো ওৎ পেতে থাকে, দীর্ঘদিন ধরে টার্গেট করে তবেই হানা দেয়, সুতরাং এদের প্রতি আমাদের সতর্ক চোখ রাখা সম্ভব, কেবল চোখ কান খোলা রাখতে হবে, সন্তানের অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে, সন্তানের সঙ্গে ওইটুকু দূরত্ব রাখা যাবে না যে, তারা কোন একটা সমস্যা জানাতে সঙ্কোচ করবে।
কার চোখের দৃষ্টি কেমন সেটা বোঝা অত জটিল নয় আমার মনে হয়। এখন এই চোখের দৃষ্টি নিকট আত্মীয়ের হতে পারে, বন্ধুর হতে পারে, শিক্ষকের হতে পারে, এমন কি গলির মোড়ে দাঁড়ানো ছেলেটিরও হতে পারে! এদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
পরিকল্পিত ধর্ষণ বলতে আমি যেটা বুঝি সেটার প্রতিকার যে কোথায় চাইব আমার জানা নেই। গত মাসে সাতক্ষীরায় এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে তার বাবা মায়ের সামনে হাত পা বেঁধে ধর্ষণ করা হয়! কয়েকটি ছেলে একটা বাড়িতে হামলা করল আর এলাকাবাসী কি মরে গিয়েছিল তখন???? এর প্রতিবাদে বিক্ষোভের ভাষাই আমি খুঁজে পাই না। এক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি, আইনি প্রক্রিয়া, মেডিকেল টেস্ট ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি এবং সবশেষে জয় গণতন্ত্রের জয়! সরাসরি বিচারের কথা কেউ বলে না। এই লেখা পড়েও আপনারা হাত তালি দেবেন, এবং এই হাত তালি দিয়েই সব শেষ! এরপরে আর কিছুই না।
এই লীডার, পুচকে নেতা, সন্ত্রাসবাদ এগুলো গণতন্ত্রের কুফল। এলাকার নেতা সাপোর্ট দেয় বলে এখন স্কুলের বাচ্চা ছেলেটাও বাস থামিয়ে আগুন দেয়, গ্যাঙ রেইপের সাহস করে বসে! এর প্রতিকার কোথায় আমি এখনও জানি না। তবে একটা জিনিস বুঝি, নেতা একজন, আর জনগণ সংখ্যায় হাজার। ওই একের চেয়ে হাজারের ক্ষমতা বেশি। নেতার জোরে যদি কেউ আপনাকে অত্যাচার করতে আসে তবে আমাদের গোটা এলাকাবাসীর উচিত হবে এটাকে একযোগে প্রতিহত করা। আজ আপনি ভয়ে যদি না এগোন তাহলে আপনার বেলাতেও কাল কেউ এগুবে না। একটা ঘরে হামলা হচ্ছে আর গোটা এলাকা গা বাঁচাতে দুয়ার দিয়ে লুকিয়েছে!
কী অদ্ভুত ভিনগ্রহে বসবাস আমাদের!
এরকম ধর্ষণকে উৎসাহিত করেছে প্রথমত আমাদের পত্রিকার সংবাদ লেখার কৌশল, দ্বিতীয়ত লঘু শাস্তি বা বিনা শাস্তিতে ধর্ষকের মুক্তির দৃষ্টান্তগুলো! পত্রিকায় একেকটি ধর্ষণের ঘটনাকে এমনভাবে লেখা হত যে, পাঠকেরও লালা ঝরা শুরু হত, বিক্ষোভের বদলে উল্টো পাঠকের মধ্যে ফ্যান্টাসি তৈরি হত যেন চটি পড়া হচ্ছে! শুকরিয়া যে, এই ধারাটা এখন বন্ধ হয়েছে।
আর ধর্ষণের উল্লেখযোগ্য কোন শাস্তি হয় না বলেই একজনের পর আরও একশো জন পরদিন ধর্ষণে নামার সাহস পাচ্ছে! এর সমাধান আমার জানা নেই, সরকার বা আইনের বিধায়কদের কাছে থাকতে পারে।
পরিশেষে বলব, আমরা চেতনার শ্লোগান সবাই দেই, কিন্তু চেতনার পরিচর্যা কেউ করি না। নারী মানেই আমরা প্রথমে নিতম্ব বুঝি, বুক কতখানি উঁচু সেটার কল্পনা বুঝি আমাদের মূল পচনটা এখানেই। আমরা নারীকে কেবল শরীর ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। একজন নারী যে আমার মতই সুস্থ সবল একজন মানুষ এই বোধটা আমাদের খুব কম মানুষেরই আছে।
যারা যৌনতায় অস্থির, তারা হস্তমৈথুন করলেই পারেন, পতিতার কাছে গেলেই পারেন। কেন সামান্য পাঁচ মিনিটের খেয়ালিপনায় এত বড় ঝুঁকি নেবেন? কোন আহাম্মকীতে পেয়েছে যে এই তুচ্ছ জিনিস নিয়ে জীবনে এত বড় একটা প্রলয় ডেকে আনব আমরা??
আসুন, আমরা জীবনটাকে কুৎসিত আর জটিল না করে সুন্দর করি।
এই জাতির রুচির বিকাশ ঘটুক, সুবোধ তুই ফিরে আয়!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ২:১২