মানুষের চিন্তার ইতিহাস আর ক্রিটিক অর্থে সমালোচনার ইতিহাস সমার্থক।এখানে ক্রিটিক অর্থ ঠিক সম-আলোচনা নয়, চুলচেরা বিশ্লেষণ।এপিকিউরাস,ডেমোক্রিটাস কিংবা তারও অনেক আগের বৃহস্পতি মুনি অথবা আরো প্রাচীন গুহাচিত্রে সাবজেক্ট এবং সাজেশনে দেখা যায় মানুষ অবিরাম চেষ্টা করছে বস্তুজগতকে বোঝার।এই চেষ্টার ইতিহাসই জ্ঞানের ইতিহাস।
অভিজ্ঞতা-বিশ্লেষণ অর্থে দর্শনশাস্ত্রে এই ইতিহাসের শুরু। দেহ আর পারিপার্শ্বকে জেনে নেওয়ার চেষ্টায় চেতনার আবিস্কার। সম্পত্তির উৎপত্তি এবং সামাজিক অসমতার শুরু, বিভাজিত অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণের চেতনাকে বিভাজিত করে। এই বিভাজনের মূল দুটি ধারার একটি বস্তুজগতকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে, আরেকটি সত্বাকে বস্তুজগত বহি:র্ভূত ধরে নিয়ে চৈতন্যকে কেন্দ্র করে।
বস্তুজগত বহি:র্ভূত সত্বা - প্রকৃতির অতিরিক্ত - অতিপ্রাকৃতকে বোঝার চেষ্টা চলেছে বস্তুজগতকে ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ ক্রিয়ার বোধ সরাসরি বস্তুজগত থেকে প্রাপ্ত। সামাজিক অসমতা থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, কর্তৃত্বের ধারণা নিয়ে আসে। সসীম কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের অতিপ্রাকৃত বিমূর্তায়ন থেকে আসে এমন কারো কারো ধারণা যারা রাষ্ট্রের চাইতেও শক্তিশালী। যিনি বা যারা দৃশ্যের অতীত। নেপথ্য থেকে নাড়াচাড়া করছেন চেনা-অচেনা পারিপার্শ্ব। রাষ্ট্রের দাপট বাড়তে থাকলে এদের কেউ কেউ লুঠ হন রাষ্ট্রের হাতে। রাষ্ট্রীয় সনদপ্রাপ্ত সাধুরা নতুন মাত্রায় অতিপ্রাকৃতের সাধনা শুরু করেন রাষ্ট্র নির্ধারিত সীমায়। বস্তুজগতের সাধনাকারীদের বিতাড়িত করা হয়, সেই সাথে রাষ্ট্রের তালিকা বহি:র্ভূত অপৌরুষেয় সত্বার অনুসন্ধানীদেরও। তাদের অনেকেই নিহত হন। বাকিরা ছড়িয়ে পড়েন গভীর অরণ্যে-পাহাড়ে। মাঝে মাঝে তারা ফিরে আসেন ভ্রাম্যমাণ সাধকের চেহারায়। আউল-বাউল-সহজিয়ারূপে। তারা ঘুরে ফিরে গান করেন। প্রশ্ন করেন। সেইসব প্রশ্ন, যেগুলো রুখে দিতে রাষ্ট্র তাদের বিতাড়িত করেছিল। তাদের গানে সাধনায় বেঁচে থাকে আদিম বস্তুবাদের চিহ্নগুলো।
রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বস্তুজগত বহি:র্ভূত সত্বার নিয়ন্ত্রক ভুমিকার অনুসন্ধানীদের নিরাপদ বলে বেছে নিয়েছে বস্তু জগতের বিত্তি-বেসাদ নিরাপদ করতে। একেকটা কর্তৃত্ব বহু রক্তপাতের অভিজ্ঞতায় জন্ম নিয়েছে। সব রক্তপাতই সসীম এবং মূর্ত বিষয় নিয়ে। সুতরাং অদৃশ্য স্থিতিস্থাপকের আশ্রয় নেওয়া রাষ্ট্রের জন্য একরকম অপরিহার্য ছিল। আঙ্গুল তুলে প্রশ্ন করার প্রবণতাকে দমন করতে শুধু আইন কানুনে কাজ হয়নি। অদৃশ্যের রেফারেন্স দিতে হয়েছে নির্দেশ হালাল করতে। তাতে নিরাপদ হয়েছে শতেকতলা মালকুঠুরি।
বনে কিংবা পাহাড়ে কিংবা পথে পথে ছড়ানো সাধকেরা নিতান্তই বুঝতে চেয়েছিলেন। তাদের এই চাওয়া কেউ স্পন্সর করেনি। তাই অদৃশ্যে তারা কেউই কোন ফরমায়েসী জাঁদরেল কর্তৃত্ব খুঁজে পাননি। কর্তৃত্ব অনুসন্ধানের কোন দায়ও তাদের ছিল না। তারা গায়েবে যাকে পান কিংবা পান না তিনি প্রভু নন। তিনি থাকেন সর্বভূতে। সকলের মধ্যে। সাধকদের মুখে মুখে প্রচার করেন "মালিকানার" মোহমুক্ত হবার বাণী। মালিকানার সেপাইদের তাড়া খেয়ে আত্মগোপনও করতে হয় প্রায়শ আরো গভীর অরণ্যে। যেখানে সরাসরি মালিকানার দাবীদার আপাতত নেই।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৩:৪১