somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ শ্যাওলা মানব

১৮ ই জুলাই, ২০০৯ রাত ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ভার্সিটিতে ঢুকেই দেখি কালচারাল ক্লাবের সভাপতি শফিক ভাই হাসিমুখে এক ছেলের সাথে কথা বলতেছেন। ছেলেটার উচ্চতা মোটামুটি, সাধারণ জামাকাপড়, দুঃখী দুঃখী চেহারা। শফিক ভাই তার সাথে এমন হাসিমুখ করে কথা বলতেছেন, দেখেই মনে হল, ইদানীং শফিক ভাইও ডেসটিনি ধরছে নাকি !
“আরে পাগলা যে, আস আস। মনে মনে, তোমাকে খুঁজতেছিলাম”,আমাকে দেখে শফিক ভাই কাছে ডাকলেন। এতক্ষণ হাবার মত হা করে দাঁড়িয়ে দৃশ্য পর্যবেক্ষণের কুফল। আমি একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গেলাম। “আরে বুঝছ, কী যে এক ভার্সিটিতে পড়তেছি, আমাকে ছাড়া কোন কাজই হয় না। এখন, এই ভাইকে একটু সময় দেয়ার দরকার। কিন্তু, সময় পাচ্ছিনা একদম। এখনই একটা মিটিংয়ে যেতে হবে। রেজিস্টার স্যার ত আমাকে ছাড়া কাউকেই চেনেন না”, শফিক ভাই অনবরত হাত নেড়ে মুখ নেড়ে নিজের গুণগাণ করে যাচ্ছেন।

শফিক ভাই লোকটা আসলে খারাপ না। সমস্যা হল, আশাপাশে যাই-ই হয়, সব ক্রেডিট তার একা নেওয়া চাই। সে অনেক কিছু করে, তাই এখনও অনেকের কাছে সম্মান পায়। তবে, বিপক্ষেও লোক নিতান্ত কম না। শফিক ভাইয়ের কথা শেষে আমি আবার সেই দুঃখী চেহারার ছেলেটার দিকে তাকালাম। শফিক ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন যে উনার নাম সৈকত।
ভার্সিটির দেয়ালে দেখা একটা পোস্টারের কথা মনে পড়ল। লেখা ছিল, “ আমি সৈকত। এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমার পরিবারে আছেন আমার মা, বাবা, দাদী, বোন আর আমরা দুই ভাই। আমার বাবা একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি।আজ এক জটিল রোগে উনি অন্ধ হবার পথে। আপনাদের সবার আন্তরিক সাহায্য আর দুয়া চাই। ”
বুঝলাম, ইনিই সম্ভবত সেই সৈকত। শফিক ভাই ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করলেন। বললেন,”দুই দিন ধরে ত এই পোস্টার এখানে ছিল। অনেকেই সাহায্য করেছে। আজকে সৈকত ভাই পোস্টার উঠিয়ে চলে যাবেন। যাওয়ার আগে আরেকবার সবাইকে বলতে চান। তুমি উনার সাথে যাও। সাথে তোমার ইমিডিয়েট সামনের ব্যাচের দুই জনকে দিলাম।” আমি মাথার মাঝে হিসাব কষা শুরু করলাম। এই ক্যাম্পাস-১ এ মোট ১৭ তলা। প্রথম ২ তলা বাদ, অফিস। শেষের ২ তলাও বাদ কমন রুম। প্রতি তলায় একটা অফিস। তাহলে ক্লাস হবে ৫ টা রুমে। তাহলে ৬৫ টা রুমে যেতে হবে উনাকে নিয়ে। আর সকল প্রাইভেটের যেই সমস্যা, একটা রুমে এক ব্যাচের ক্লাস শেষ হবার ১০ মিনিট পরেই ওই রুমেই আরেক গ্রুপের ক্লাস শুরু। ক্লাসের মধ্যে যে বসে দুইটা ছেলে আড্ডা মারবে, সেই সুযোগও নাই। যাই হোক , এত জায়গায় যেতে হবে। সাহায্যের কথা বলতে হবে। সাহায্য উঠাতে হবে, আইডি আর পরিমাণ লিখতে হবে। থতমত খেয়ে নিজের অজান্তেই বলে দিলাম,” ভাই, আমার ত ক্লাস আছে।”
শফিক ভাই বললেন, “আরে হইল ক্লাস। এই একটা দৌড় দিয়ে ঘুরে আস।স্যারকে আমার কথা বললেই হবে।” আর কথা বাড়ালাম না। স্যার যে শফিক ভাইকে কতটুকু চিনবে তা আমার ভালই জানা আছে। সৈকত ভাইয়ের অসহায় মুখটা দেখে রাজী হয়ে গেলাম। আমি আর সিনিয়র দুই ভাই আর সৈকত ভাই, তার বাবা আর উনার হাত ধরে উনার ছোট ভাই। উনার বাবা এখনই চোখে কিছু দেখছেন না। আমরা সাবধানে উঠা শুরু করলাম। লিফট দিয়ে একেবারে উপরে উঠে প্রতি তলায় বলে বলে নামা শুরু করব আর পোস্টার উঠিয়ে ফেলব। লিফটে উঠার লাইনে দাঁড়ালাম। সিনিয়র দুই ভাই হঠাৎ বলল তাদের কী নাকি কাজ আছে, যাওয়া লাগবে, তবে এটা যেন শফিক ভাইকে না বলি। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিফটে উঠে গেলাম।

ক্লাসে ক্লাসে যেয়ে শুরু হল সাহায্য আর প্রার্থনার আবেদন। মানসিক একটা চাপ। প্রথম কয়েকটা ক্লাসে যেয়েই মনে হল ক্লান্ত অয়ে গেলাম। তবে, প্রতি ক্লাসে ক্লাসে যাই, কথা বার্তা বলি, মেয়েগুলি তাকায়, আমিও ওদের দিকে তাকাই। একটা ভাব, বিশাল ভাব। মানে, মনে হল কী না কি হয়ে গেছি। সৈকত ভাইয়ের সাথে একটু খাতির হয়ে গেছে। টুকটাক কথাও হল। আস্তে আস্তে সবাইকে বললাম। কম্পু ল্যাবে এক জুনিয়র মেয়েকে ৫০০ টাকা দিল। মেয়েটা সুন্দর, বুঝলাম মনটাও বড়।
সব ক্লাসে যখন বলা শেষ, মনে হল মাথা ঘুরে পড়ে যাব। সৈকত ভাই এখন এলএসসি আর এআইইউবি তে যাবে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, “ নিজের ভার্সিটি ঘুরেই আমার এই দশা, আপনি আরও দুটো ঘুরবেন !!” উনি একটা দুঃখী হাসি দিলেন।

উনার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল। বুঝলা, আমার দুই বন্ধু আছে একটা নর্থসাউথে আরেকটা আহসানউল্লাহতে। ত দুইটাই কম্পুতে পড়ে। আমি ওদের বললাম, “ তোদের ভার্সিটি বাকিদের চেয়ে ভাল কেন? এ বিষয়ে কিছু পয়েন্ট দে। ” প্রথমে আহসানউল্লাহর দোস্ত কানে কানে একটা পয়েন্ট দিল।এরপরে, নর্থসাউথের বন্ধু কানে কানে এত্তগুলা পয়েন্ট দিল। ওদের ভার্সিটি সমস্ত কো-কারিকুলার এক্টিভিটিতে আছে। সবখানে ওরা অংশগ্রহণ করে। ছাত্রছাত্রীদের অনেক সুযোগ দেয়। ওরা ইংরেজিতে ভাল। ওদের পোলাপাইনের ভাব আর স্টাইলই আলাদা। ওদের এখান থেকে অনেক নামী দামী গায়ক গায়িকা অভিনেত্রী বের হইছে। ওদের মেয়েগুলা হেব্বি স্মার্ট। এরকম আরও অনেক কিছু বলল। আর, আহসানউল্লাহর ছেলেটা এক কথায় বলছিল, “ ওদের এখান থেকে পোলাপান অনেক পড়াশুনা করে বের হয়। ” ফিক করে হেসে ফেললাম। সৈকত ভাইয়ের সাথে পুরোদমে খাতির হয়ে গেল।

আমাকে লাঞ্চের অফার করলেন। ভদ্রভাবেই না বললাম। আসলে টাকা উঠাতে সাহায্য করে এখন যদি লাঞ্চ করি, নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাব। উনি বললেন, “ দেখ পাগলা, ঢাবি তে সিমিন নামে একটা মেয়ে অসুস্থ হয়েছে। ওর জন্য কনসার্ট করে একবারে ৬ লক্ষ টাকা পাওয়া গেছে। ওর এখন চিকিৎসা হচ্ছে। আমি জানি না ও কেমন ছাত্রী বা কোন ডিপার্টমেন্টের। আজ আমি প্রাইভেটে বলে সেরকম কোন আয়োজন করতে পারছি না। এত বড় নেটওয়ার্ক নেই আমার। পাশের সেকসনের ছেলেটাকেও চিনিনা। ক্লাস শেষে বসার জায়গা থাকলে নিশ্চয়ই পাশাপাশি বসতাম। তখন হয়ত চিনতাম। ”

আমি বললাম, “ আমি যতদূর জানি সিমিন অনেক ভাল ছাত্রী ছিল। তাছাড়া, নিশ্চয়ই অনেক পড়াশোনা করে ঢাবিতে চান্স পেয়েছে। ”


সৈকত ভাই বললেন, “ দেখ, ছাত্র হিসেবে সিমিনের চেয়ে আমার মূল্য কম হতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবেও কী কম !! আমি প্রাইভেটে পড়ি বলে আমার বৃদ্ধ বাবার চিকিৎসা করার জন্য কাউকে কাছে পাব না? ”

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার শ্যাওলা ধরা মানসিকতা আমার মুখ চেপে ধরল। একটু পরে উনার বাবা আস্তে আস্তে উপরের তলা থেকে নেমে এলেন আমাদের পেছনে। সৈকত ভাই উনার বাবার দিকে তাকালেন, এরপর আবার আমার দিকে। খোদা হাফেজ বলে পা বাড়ালেন বাইরে। সাদা ফ্লুরোসেন্টের আলোয় উনার চোখের নিচের ভেঁজা অংশ চিক করে উঠল।


কি জানি, একটু পরে হয়ত আমার চোখের নিচেও একই আলো খেলা করে উঠল।


হাতের লেখা দিয়ে অনুভূতি ফুটিয়ে তোলাটা এত কঠিন কেন ?

© আকাশ_পাগলা
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:১৯
২৩টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×