বিচিত্র এই দেশ। বিচিত্র আমরা।
জটিল একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি।
চট্টগ্রামের হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজ। এইচএসসি শিক্ষার্থীদের পছন্দের ১ম সারির কয়েকটি কলেজের একটি।
২০০৪ সালের কথা (খেয়াল কইরা, তখন কিন্তু বিম্পি আমল)। এক ভদ্রলোক তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে আগের বছরের চেষ্টায় ভালো (এবং সস্তা) কলেজে ভর্তি করাতে পারেননি। রেজাল্টেও মেধাতালিকায় স্থান মিলছিল না। এই বছরে তিনি ডেসপারেশনে এসে এক অদ্ভুত এবং লজ্জাজনক সিদ্ধান্ত নিলেন। আর, এই সিদ্ধান্ত নিতে তাকে উদ্বুদ্ধ করল তারই সুযোগ্য পুত্র!
মহসিন কলেজে এইচএসসি শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও দেশের অন্যান্য লক্ষ লক্ষ ভর্তি/নিয়োগের মতই "মুক্তিযোদ্ধা কোটা" অনুসরণ করা হয়। এই loop-hole এর সদব্যবহার করার জন্য পরিচিত এক মুক্তিযোদ্ধার সাহায্য নিলেন ওই ভদ্রলোক, যার নাম তার নিজের নামের সাথে প্রায়ই মিলে যায়। নিজের ছেলের ভর্তির আবেদন ফরমে "পিতার নাম"-এর জায়গায় সেই মুক্তিযোদ্ধার নাম বসিয়ে দিলেন। সাথে একটি এফিডেভিট, আর ওই মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের সত্যায়িত কপি জমা দিলেন।
এভাবে অবলীলায়, সেই পিতা তার পত্নীকে, এবং সেই ছেলে তার মাতাকে বীরাংগনা বানিয়ে দিলেন।
এভাবেই দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা, সুযোগের অপব্যবহার, ইত্যাদি চলে আসছে এই দেশে বছরের পর বছর। কোন ব্যক্তি, দল, বা গোষ্ঠী এসবের জন্য দায়ী নয়। দৈবভাবেই পুরো বাংলাদেশ আজ "মগের মুল্লুক"! একদম অরাজনৈতিক কোন পাবলিকও যদি কোন অনিয়মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে, তবে তাকে সরকারবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী, অমুক দলবিরোধী উপাধি দিয়ে গলার টুঁটি চিপে ধরা হয়। "জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস"-কথাটি কি তাহলে পাগলের প্রলাপ?!
যার যে সুবিধা পাওয়ার কথা, সে যদি সে সুবিধা না পায় বা না চায়, তখন ওই সুবিধা নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়, ধান্দাবাজি শুরু হয়।
কোটার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ও গুপ্তঘাতক হচ্ছে "জেলা কোটা"! এই সরকার দাবীদাওয়া বিচার-বিশ্লেষণে ১ মাস সময় চেয়েছে। অন্যদিকে দাবী উত্থাপনকারীরা সময় বেঁধে দিয়েছে ১ সপ্তাহ। কিন্তু, যতদিন না "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা" কিংবা "নারীবাদের সেন্টিমেন্ট" নিয়ে ধান্দাবাজির চিন্তা দেশের মানুষের মগজ থেকে বিদায় না নিবে, ততদিন কোন সরকার/দলই এই অযৌক্তিক সিস্টেম সংস্কার করতে পারবে না। ১ যুগেও সম্ভব না, ১ শতাব্দীতেও না।
মাঝে একটু ভিসির বাড়িতে "দুর্বৃত্ত"-দের হামলা প্রসংগে বলি। "দুর্বৃত্ত" শব্দটি ইনভার্টেড কমার ভিতরে কেন রেখেছি, একটু পরে বলব।
ভিসির পদমর্যাদা যতদূর জানি মন্ত্রী/সিনিয়র সচিবদের কাছাকাছি। অথচ, ত্রিশ মিনিটের বেশি সময় ধরে সেই ভিআইপি বাসার আশেপাশে একটাও "খেয়ে ফেলব" বাহিনীর সদস্য দেখা গেল না। এতেই প্রমাণিত হয়, এই বিশেষ প্যাকেজ নাটকের কুশীলব কারা। অতীতেও দেখা গিয়েছে, ছাত্রলীগ/যুবলীগ যেখানে মারমুখো সিনেমার শোডাউন/শুটিং করছে, জনগণের করের টাকায় পালিত পুলিশেরা সেখানে হাতের চুড়ি গুণছেন।
গেল রাতেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট হ্যাক করা হয়েছে। চ্যানেলগুলির স্ক্রলে দেখানো হচ্ছে, "করেছে দুর্বৃত্তরা। কোটাবিরোধী স্লোগান ঝুলিয়ে দিয়েছে!" এখানে একই সাথে ভীতু-দালাল চ্যানেলগুলি দুইটি ভুল করেছে। প্রথমত, অন্যায় প্রথার প্রতিবাদকারীদের অপবাদ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, "মেধাবী" ও "দেশপ্রেমিক" হ্যাকারদের অপমান করা। এই হ্যাকাররা আর যাই করুক, জাতীয় রিজার্ভ চুরি করেনি। বরং, গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটগুলির দুর্বলতা দেখিয়ে দিয়েছে। দেশের ছেলেরা করতে পারলে, উন্নত বিশ্বের হ্যাকারেরা চাইলে নিমিষেই তা করতে পারে, অপূরণীয় ক্ষতিও করতে পারে! এই সোনার ছেলেদের খুঁজে বের করে দেশের সাইবার সিকিউরিটি খাতের চাকরি দিয়ে সম্মাননা দেওয়া হোক।
যতই ভালোর মুখোশ পরে থাকুক না কেন, ভিতরে ভিতরে সবাই অনিয়মের অমৃত রস খেতে চায়। সাময়িক চাপে পরে যতই সাহসিকতার সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক না কেন, জায়গামতো গিয়ে সবাই মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ হয়ে যায়।
এরই নাম "বাংলাদেশী"!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৪০