somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জর্জ, উসাইরিমঃ কাজ কম, বিনিময় অশেষ

১৫ ই মে, ২০১২ রাত ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মু’তার যুদ্ধ।

মাত্র তিন হাজার মুসলিম সেনার বিরুদ্ধে এক লক্ষ সুসজ্জিত রোমান সেনা লড়তে এসেছে। রাসুলুল্লাহ সাঃ যখন এ যুদ্ধে বাহিনী পাঠান, তখন তিনি এমন নির্দেশনা দিয়েছিলেন যা তিনি এর আগে কখনও দেননি। তিনি বলেছিলেন, “এ যুদ্ধে তোমাদের নেতৃত্ব দেবে যায়িদ বিন হারিসা (রাসুলুল্লাহ সাঃ এর আযাদকৃত দাস)। যায়িদ যদি শহীদ হয় তাহলে নেতৃত্ব দেবে জাফর বিন আবু তালিব (রাসুলুল্লাহ সাঃ এর চাচাত ভাই এবং আলী রাঃ এর বড় ভাই), আর জাফর যদি শাহীদ হয় তাহলে নেতৃত্ব দেবে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (মদীনার আনসার ও তৎকালীন আরবের বিখ্যাত কবি)। আর যদি আব্দুল্লাহ শহীদ হয়, তাহলে তোমরা নিজেরা তোমাদের পরবর্তি নেতা ঠিক করবে”। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর এই ঘোষণা শুনে অনেকেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো যে, রাসুলের উল্লেখ করা তিন সাহাবা সত্যিই শহীদ হতে যাচ্ছেন।

মুসলিম বাহিনী যখন মু’তায় পৌঁছালো, তারা বিস্ময়ের সাথে দেখলো যে লক্ষ সেনার রোমান বাহিনী প্রস্তুত তাদের মোকাবেলা করার জন্য। এমন নাজুক অবস্থায় অনেকে মন্তব্য করল ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেনাপতি যায়িদ বিন হারিসা সহ অধিকাংশ মুসলিম মত প্রকাশ করলেন যে, আমরা পিছু হটে যাবার জন্য এখানে আসিনি। আমরা শহীদ হবার উদ্দেশ্য নিয়েই মদীনা থেকে বের হয়েছি এবং এটা হয়তো আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা সুযোগ আমাদের জন্য। অবশেষে সুবিশাল রোমান বাহিনীকে অবাক করে দিয়ে মাত্র তিন হাজার অকুতোভয় সাহাবা বাহিনী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলো। আল্লাহু আকবার।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হলো। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর ঘোষণা অনুযায়ী যায়িদ, জাফর আর আব্দুল্লাহ রাঃ একে একে শহীদ হলেন। এরপর মুসলিম বাহিনী যখন প্রায় ছন্নছাড়া, তখন বিখ্যাত সাহাবী সাবিত বিন আরকাম রাঃ মুসলিমদের পতাকা তুলে নিয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতে দেন। খালিদ তখন মাত্র নও মুসলিম, আর সেখানে বিখ্যাত মুহাজির ও আনসারী সাহাবারাও ছিলেন, তাই খালিদ এ নেতৃত্ব গ্রহণে অস্বীকার করলেন। কিন্তু সকল সাহাবা খালিদকে নেতৃত্ব গ্রহণের আহবান জানালেন। খালিদ অনিচ্ছা সত্বেও তুলে নিলেন মুসলিম বাহিনীর পতাকা। দ্রুত তিনি সমর কৌশল পরিবর্তন করে রোমান বাহিনীকে রুখে দাঁড়ালেন। মুসলিমদের এই আকস্মিক রণকৌশল দেখে রোমানরা মুসলিম বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করার পরিবর্তে যুদ্ধ বন্ধ করার পথ অবলম্বন করল। আর এ অবস্থাতেই বুদ্ধিমান খালিদ তাঁর অবশিষ্ট সেনাদল অক্ষত রেখে মদীনা ফিরে চললেন। বস্তুত মু’তার এ যুদ্ধে কোন বাহিনীর জয় হয়নি। তবে সমর বিশ্লেষণ অনুযায়ী এটা ছিল মুসলিম বাহিনীর জয়, যেভাবে তারা মাত্র তিন হাজার হয়েও এক লক্ষ সেনার মোকাবেলা করে পিছু না হটে একরকম যুদ্ধ বিরতি আদায় করে বীরের মত ফিরে এসেছিলো। বস্তুত এ যুদ্ধ রোমান সাম্রাজ্যের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। মুসলিমদের এই দুঃসাহস তাদের ভীত করে তুলেছিল।

মু’তার যুদ্ধ থেকে যখন এ বাহিনীটি ফিরে এসেছিলো, রাসুলুল্লাহ সাঃ মদীনা থেকে বেশ খানিকটা বাইরে গিয়ে এ দলটিকে বরণ করে এনেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, “খালিদ হলো সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তলোয়ার)”। আর সেদিন থেকেই খালিদ সাইফুল্লাহ উপাধি লাভ করেন। এই খালিদ পরবর্তি যতগুলো যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা অংশ নিয়েছেন, আল্লাহ তাঁকে বিজয় দিয়েছেন। এ লোকটির মাধ্যমে আল্লাহ এমনকি মানব ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়া সব যুদ্ধজয় মুসলিমদের দিয়েছেন।

খালিদের স্মরণীয় সকল জয় আর তাঁর সাইফুল্লাহ উপাধি কাফিরদের ভিতরেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এদের অনেকেরই এ ধারণা ছিলো যে, খালিদের কাছে একটি ঐশী তরবারী আছে।

ইসলাম ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও বিজিয় নির্ধারণী যে যুদ্ধটি হয়েছিলো তা হলো ইয়ারমুকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মাত্র তেত্রিশ হাজার মুসলিম সেনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলো তিন লক্ষ রোমান সেনা। যুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি। এমন সময় রোমান বাহিনী থেকে জর্জ নামে এক জেনারেল খালিদকে সবার সামনে এসে তার মোকাবেলার আহবান জানায়। খালিদ দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। খালিদ অগ্রসর হলেও জর্জ তখনও অস্ত্র বের করেননি, এমনকি দুজনের ঘোড়ার ঘাড় অতিক্রম করার পরও জর্জ তরবারী বের করলেননা। খালিদ একেবারে কাছে এলে জর্জ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,

“ওহে খালিদ, আমার কাছে সত্য গোপন করোনা। মহৎ লোকেরা কখনও মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়না। এটা কি সত্য যে, সৃষ্টিকর্তা তোমার রাসুলের নিকট একটা তরবারী পাঠিয়েছেন যা তিনি তোমাকে দিয়েছেন, এবং তুমি তা কখনও উন্মুক্ত করোনি অথচ তোমার শত্রুরা তোমার সামনে দাঁড়ালেই পরাজিত হয়?”
“না”। খালিদ বললেন।
“তাহলে তোমাকে আল্লাহর তলোয়ার বলা হয় কেন?”
খালিদ মু’তার যুদ্ধ ও তারপরে সে প্রেক্ষাপটে কিভাবে রাসুল সাঃ তাঁকে সাইফুল্লাহ উপাধি দেন তা বর্ণনা করলেন। জর্জ কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। এরপর বললেন,
“বলো আমাকে কি করতে হবে?”
“তুমি সাক্ষ্য দান করো যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাঃ হলেন আল্লাহর রাসুল এবং তাঁর কাছে আল্লাহর যে বাণী এসেছে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে”।
“যদি আমি তাতে সম্মত না হই?”
“তাহলে জিজিয়া প্রদান করতে হবে এবং তুমি নিরাপত্তা পাবে”।
“যদি আমি তাতেও সম্মত না হই?”
“তাহলে তলোয়ারই আমাদের মধ্যে মিমাংসা করবে”।
জর্জ খালিদ রাঃ এর কথাগুলো নিয়ে কিছুক্ষন চিন্তা করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন-
“আজকে যে তোমাদের বিশ্বাস গ্রহণ করবে তার মর্যাদা কি”?
“আমাদের বিশ্বাসে সবার মর্যাদা সমান”।
“তাহলে আমি তোমাদের বিশ্বাসকে গ্রহণ করলাম”।

খালিদ আর জর্জ মুসলিম বাহিনীর দিকে এগিয়ে চললেন। উভয়পক্ষ এ দুজনের দ্বৈত যুদ্ধ দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল। এবার সবাই অবাক হয়ে দেখলো রোমান জেনারেল জর্জ মুসলিম বাহিনীর ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালো। কেবল মুসলিম সেনারা শুনতে পেলো তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা দিচ্ছেন “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই আর আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ সাঃ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুল”। মুসলিম বাহিনী আল্লাহু আকবর তাকবীর দিয়ে উঠলো, আর রোমান বাহিনী বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করল যে তাদের বিখ্যাত জেনারেল জর্জ আজ তাদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সাধারণ মুসলিম সৈন্যদের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জর্জ বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই জর্জকে মুসলিম হিসাবে শহীদ হবার মর্যাদা দিয়েছিলেন।

জর্জের এ ঘটনা মুসলিমদের উহুদের যুদ্ধের সে ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছিল। উহুদের যুদ্ধের দিন সকালে কাফির বাহিনী থেকে তাদের বিখ্যাত নেতা উসাইরিম রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছে ভীষণ আবেগ প্রবণ হয়ে হাজির হলেন। তিনি রাসুল সাঃ কে বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি কি আপনার সাথে যুদ্ধে যাব নাকি আগে আপনার কাছে ঈমানের সাক্ষ্য দেব?” তিনি বললেন, “তুমি আগে ঈমানের সাক্ষ্য দাও এবং তারপর যুদ্ধে চল”। তিনি তাই করলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় সে যুদ্ধেই তিনি শহীদ হলেন। যুদ্ধ শেষে রাসুলুল্লাহ সাঃ যখন তাঁর মৃতদেহের কাছে আসলেন তিনি বললেন, “উসাইরিম কাজ করল কম কিন্তু বিনিময় পেলো অনেক বেশী। সে এমনকি এক রাকাত সালাতও আদায় করেনি কিন্তু আল্লাহ তার জন্য জান্নাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন”।

আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আমাদেরকে তাদের সাথে মিলিয়ে দিন যাদের উপর তিনি অনুগ্রহ করেছেন।


রেফারেন্সঃ আল্লাহর তলোয়ারঃ এ আই আকরাম, আসহাবে রাসুলের জীবন কথাঃ আবদুল মা’বুদ
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×