একদিন ক্লাসে শিক্ষক মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পড়াচ্ছিলেন। প্রশ্ন করলেন,
বাংলাদেশে অল্প বয়স্ক মেয়ে বা কিশোরীদের সবচেয়ে বেশি কোন কারনে মৃত্যু হয়?
অনুমান করতে পারেন কি কারনে?
অনেকের মত আমিও ভেবেছিলাম রক্তাল্পতা বা অল্প বয়সে মা হতে যাবার কারনে। কিন্তু না। এদেশে কিশোরী ও অল্পবয়স্ক মেয়েদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারন হল আত্মহত্যা।
হ্যাঁ, আত্মহত্যা।
অবাক হলেন তো? আমিও হয়েছিলাম। কিন্তু একটু ভেবে দেখেছি এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত কারন। মানসিক স্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যে দেশে অবহেলিত, যেখানে আরও শত শত সামাজিক সমস্যা আঁকড়ে ধরে আছে সেখানে অল্প বয়সী মেয়েরা আত্মহত্যা করে মারা যাবে এতে এত অবাক হবার কিছু নেই।
বয়ঃসন্ধিতে একটা মেয়ে বা ছেলে শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি যে মানসিক পরিবর্তনের মাঝে যায় তা সবসময় তাদের জন্য খুব সুখকর স্মৃতি জন্ম দেয় না। কাউকে বলতেও পারেনা নিজেদের সমস্যা গুলোর কথা। ছেলেরা তাও পারে কিছুটা হলেও প্রকাশ করতে, নিজেকে ব্যস্ত রাখতে, কিন্তু মেয়েদের বিষয় গুলো একেবারেই গোপন করে রাখা হয়। এগুলো নিয়ে যেন কথা বলার কিছু নেই, ভাবার কিছু নেই, গুরুত্ব দেবার কিছু নেই।
"মানসিক সমস্যা" কথাটা বলার সাথে সাথে আমাদের চোখের সামনে ভাসে "পাগল" নামক শব্দটি। অতি অপমানজনক ও বিদ্রুপ প্রকাশকারক এই শব্দটি যেমন আমরা নিজের গায়ে লাগবে এই আতঙ্কে তটস্থ হয়ে থাকি, তেমনি মানসিক রোগের চিকিৎসক বা সাইকিয়াট্রিস্ট কে আমরা খুব সহজেই বলে ফেলি "পাগলের ডাক্তার"।
আমরা আমাদের শারীরিক সুস্থতা নিয়ে যতটুকু চিন্তা না করি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তার ১০০ ভাগের ১ ভাগও করিনা। একারনেই এদেশে মানসিক সুস্থতা নিয়ে অবহেলা সেই প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। যদি কোন ভাবে মনে হয় অমুক মানুষের এই মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে ব্যাস, আমরা ব্যস্ত হয়ে যাই তাকে পাগল খেতাব দিয়ে পাগলের ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে রোগী ও ডাক্তার দুজনকে নিয়েই রসিকতা করতে। কয়জনের মধ্যে তাদের সত্যিকার অর্থে সাহায্য করার, একটু পাশে থাকার মত মানসিকতা থাকে? অথচ হয়ত আমরা আরও বড় সমস্যা নিয়ে ভেতরে ভেতরে কাটিয়ে দিচ্ছি।
একটু সচেতন হলেই সাইকিয়াট্রিস্ট এর ওষুধ বা ব্যয়বহুল কাউন্সেলিং ছাড়াই অনেক বড় বড় মানসিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব যদি সময় পার হবার আগেই তাকে সাহায্য করা যায়।
এবার কিছু প্রশ্ন করি, উত্তর গুলো নিজের মনে মনে নিজেকে দিন, নিজেকে নিয়ে একটু ভাবুন।
আপনার পুরো জীবনকালে কতবার আপনার মন খারাপ হয়েছে?কোন কারন ছাড়াই মন খারাপ? কাজ করতে ইচ্ছা করে না, পড়তে ইচ্ছা করে না, কিছু ভাল লাগেনা এমন কতবার মনে হয়েছে?
একবারও এমন হয়নি এমন কেউ আছে বলে মনে হয় না।এমনকি মনের কষ্টে নিজের মৃত্যুচিন্তা করেছেন এমন মানুষের সংখ্যাও খুব কম না।
এমন কি কখনও হয়েছে যে এক মুহূর্তের জন্যেও আপনার মনে হয়েছে আপনার মরে যাওয়া উচিৎ? আপনার বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই?
উত্তর নিজের মনেই রাখুন, খুব কম মানুষই আছে যাদের এমন সারাজীবনে একবারও মনে হয়নি। আপনারও হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি ভাবেন এটা আপনার দুর্বলতা, পাছে লোকে কি বলবে, এই ভেবে নিজের কষ্ট বুকে চেপে দিন পার করতে থাকেন, তখনই ভুল করবেন, ক্ষতি কিন্তু আপনারই হবে।
বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।
সবাই ভাবে তাকে অন্যরা দুর্বল ভাববে, হাসাহাসি করবে কিন্তু এতে যে নিজের কত বড় সর্বনাশ আমরা করে চলি তা বোঝার আগেই অনেক দেরী হয়ে যায়।
মজার ব্যাপার যে, দিনের পর দিন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত মানুষকেও যখন দেখি নিজের মানসিক অবস্থাকে দিব্বি এড়িয়ে গিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টদের "পাগলের ডাক্তার তো নিজেও আরও বড় পাগল হয়" ইত্যাদি কথা বলতে থাকে। অন্যের অসুস্থতা নিয়েও যেন মজা করা তাদের জন্য অনেক সময় খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এগুলো করে নিজেকে জোর করে একটা বুঝ দিয়ে যাবার আপ্রান প্রচেষ্টা করে যায় যে সে সুস্থ। তার কোন অসুবিধা নেই, যাদের আছে তারা পাগল তাই তারা পাগলের ডাক্তারের কাছে যাক এবং সেই ডাক্তাররাও আরও বড় পাগল।
এটাই যেন স্বাভাবিক। এটাই চলছে চারপাশে।
কিন্তু এভাবে মজা করার আগে একটু নিজের দিকে একবার তাকান, আপনার কি কখনও একটুও কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ হয়নি? কষ্ট হয়নি? তারপরেও আরেকটা মানুষের কষ্ট নিয়ে কৌতুক কীভাবে করেন? জীবনে কষ্ট পায়নি কোন না কোন বিষয়ে এমন মানুষ কে আছে? কাজেই কারো কষ্ট নিয়ে কৌতুক পেতে পারেন কিছুক্ষণের জন্য, কিন্তু এতে আপনিও যে ভিতরে ভিতরে দুর্বল তাই প্রকাশ পাবে মাত্র।
শুধু কিশোর কিশোরী নয়, ইদানিং আত্মহত্যার প্রবণতা সব বয়সের মানুষের মধ্যেই দেখছি গত কয়েক বছরের তুলনায় বেড়ে গিয়েছে। কারন বলে শেষ করা যাবেনা। প্রেমে ব্যর্থতা, পরকীয়া, পড়াশোনায় খারাপ করা, বাবা মা ভাই বোন বা অন্য কোন পারিবারিক সমস্যা আরও কত কিছু। কিন্তু আসলে এগুলো মূল কারন নয়। মূল কারন অন্য জায়গায়। আর তাহল আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অবহেলা।
একটা মানুষ যখন বিষণ্ণতায় ভুগে তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে সে এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অনেকদিন ধরে অনেককিছু হয়ে যাবার পর, শক্ত থাকার চেষ্টা করে করে একটা পর্যায়ে যখন মানুষ হাল ছেড়ে দেয়, বিষণ্ণতার শুরু সেখানেই।
তারপরেও আমরা কিন্তু বলি না। ভাবি এটা জরুরী কিছু নয়। শরীরের অসুখে ঘা হয়, ব্যথা হয়, জ্বর হয়, রক্ত ঝরে তাই আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরি চিকিৎসা করতে। কিন্তু মনের অসুখ হলে একটা মানুষ ধীরে ধীরে মানসিক পঙ্গুত্বের দিকে এগুতে থাকে। আর শারীরিক পঙ্গুত্বের চেয়ে মানসিক পঙ্গুত্ব অনেকগুন ভয়াবহ। এতে না পারে একজন মানুষ স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে, না পারে সত্যিকার অর্থে সুস্থ জীবন যাপন করতে। নিজেই হয়ে যায় নিজের কাছে একটি বোঝা। আর যে মানুষ নিজের জন্যেই একটি বোঝা সে না পারে পরিবারের কোন উপকারে আসতে, না পারে সমাজের জন্য তথা দেশের জন্য কিছু করতে। কেউ নেশাগ্রস্ত হয়, কেউ অপরাধে জড়িয়ে পরে, কেউ কষ্ট চেপে চেপে একদিন আর না পেরে জীবন শেষ করে দেয়।
আপনি, আমি আমাদের সবারই কারনে অকারণে মন খারাপ হয়, যখন সেটা কোন কারনে হয় এবং আমরা তা সমাধান করতে পারি তখন আর খারাপ লাগে না। কিন্তু যখন কোন কারন ছাড়াই মন খারাপ দিনের পর দিন থাকে, বুঝেও উঠা যায় না কেন মন খারাপ, কেন ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে যাচ্ছে সব কিছু তখন ব্যাপারটা কিন্তু চিন্তার বিষয়। এর সাথে আরও কিছু উপসর্গ যোগ হয় যেমন খাবারে হঠাৎ করে অরুচি দেখা দেয়া অথবা উল্টোটা অতিরিক্ত খাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা, বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, অল্পতেই ক্লান্ত লাগা, কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা ইত্যাদি। এমন অনেক উপসর্গ আছে একসাথে বা আলাদা আলাদা ভাবে আসতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থার বাইরে এই লক্ষণগুলো আমরা যতই এড়িয়ে যাই না কেন, এগুলো এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়। আর যদিও বা কোন ভাবে চাপা রাখা যায় সেটার ফলাফল অন্য কোন ভাবে প্রকাশ পায়। তা ভিতরে ভিতরে আমরা সবাই বুঝলেও মুখে স্বীকার করতে চাইনা।
উপরে বলা উপসর্গগুলো প্রায় সব রকম মানসিক রোগেই কম বেশি থাকে। এবং এই সব উপসর্গ গুলো বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকা মানুষের মধ্যে প্রকট আকারে দেখা যায়। প্রতিটা মানুষই জীবনে কোন না কোন পর্যায়ে নিজেকে বিষন্নতায় ভুগতে পারে। কেউ কেউ সেটা কাটিয়ে উঠতে পারে, কেউ পারেনা। যখন পারেনা আর দিনের পর দিন এই অদৃশ্য বোঝা বয়ে বেড়িয়ে জীবন পার করে। অনেকেই এক পর্যায়ে ভেঙ্গে পারে, অনেকে কাউকে দেখায় না, কাউকে বলতেও পারেনা। এভাবেই চলতে থাকে।
কিছু আত্মহত্যার কথা শুনলে মনে হতে পারে যে হঠাৎ করেই ছেলেটি বা মেয়েটি আবেগপ্রবন হয়ে এমন কাজ করে বসেছে। কিন্তু প্রতিটি আত্মহত্যার বীজ কোন মানুষের মধ্যে এক দিনে জন্ম নেয় না। কোন এক ঘটনায় এই বীজ তার ভিতরে বপন হয়, দিনের পর দিন নিজের অজান্তেই মানুষ একে চারাগাছ থেকে ডালপালা সহ বৃক্ষে রুপ দেয় এবং নিজেই একদিন সেই বৃক্ষের ডালে আত্মাহুতি দেয়। বড় গাছ কেটে ফেলার চাইতে ছোট থাকা অবস্থায় সরিয়ে ফেলা অনেক সহজতর।
প্রতিকার কি?
নিজেকে জানুন, আপনার পাশের মানুষটিকে জানুন। নিজেকে ভালবাসুন। সুস্থ দেহ যদি সুন্দর জীবনের চাবিকাঠি হয় তবে সুস্থ মন সেই চাবিকাঠির অন্তঃপ্রান। কাছের বন্ধুটিকে বলুন আপনার কষ্টের কথা। সমাধান পাবার জন্য নয়, শুধু নিজেকে হালকা করার জন্য বলুন। আত্মহত্যা করে পালিয়ে যাওয়া খুব সহজ, বেঁচে থেকে অবস্থা, পারিপার্শ্বিকতা কে নিজের উপযোগী করে নেয়া কঠিন, কিন্তু তারপরেও চেষ্টা করুন। সফল হলে কোনদিন মরতে ইচ্ছা হবে না। আর বিফল হলে আবারও চেষ্টা করুন।
জন্মানোর পর থেকে আমরা সবাই তো বেঁচে আছি তাই না? তাই মাঝে মাঝে যদি আর কোন কারন ছাড়াই মরে যেতে ইচ্ছা করে ধরে নিবেন এটা এক প্রকার অবসাদ বা ক্লান্তি থেকে হয়েছে। কিন্তু তা ভিতরে চেপে না রেখে কাউকে বলুন। আপনাকে নিয়ে মজা করবে, হাসবে? তাতেও ক্ষতি নেই, বলুন। কারন যারা হাসবে তাদের নিজেদেরও কোন সমস্যা কোথাও না কোথাও আছে। মনে রাখবেন, দুঃখী মানুষ মাত্রই অন্যের দুঃখ থেকে সান্ত্বনা নিয়ে নিজেকে মিথ্যে প্রবোধ দেয় যে সুখে আছে। কাজেই এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। হয়ত সে আপনার চেয়েও বড় সমস্যায় ভুগছে।
সুখি হওয়া খুব সহজ কাজ এক অর্থে। যতক্ষন না পর্যন্ত আপনি আপনার নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট, ততক্ষণ অন্য কোন বস্তু, মানুষ, পরিস্থিতি আপনাকে সুখি করতে পারবেনা।
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সময় থাকতে সচেতন হন। সুস্থ থাকুন।
-ডাঃ নাজিয়া হক অনি