হারিকেন শব্দটি আমাদের বাঙালির কানে খুব আদরের সাথেই বাসা বেঁধেছে। একটা সময় ছিল আমাদের গ্রাম বাংলা মানেই হারিকেন আর কুঁপি বাতি। সেই হারিকেনের মোহনীয় আলোর প্রতিটা কনায় কনায় আমাদের দুরন্ত কৈশর কতভাবেই না জড়িয়ে রয়েছে! গ্রাম বাংলায় রাত নেমে আসতো হঠাৎ করে ঝুপ করে কাউকে বলে না কয়েই। সন্ধ্যা থেকেই শুরু হত হারিকেন নিয়ে কতরকম আয়োজন! সলতেটা ঠিক আছেতো? চিমনিটা পরিস্কার করতে হবে যে! কেরসিন মজুদ আছেতো! আর শুধুই কি হারিকেন সেবা? সেই হারিকেন কে ঘিরে কত ছোট ছোট মুখ। সেই মুখ গুলোতে ছিল শুধু বিস্ময় আর বিস্ময়! চোখে হাজার রকম প্রশ্নের ঝলকানি! হারিকেনের লালচে আলোয় পরীক্ষার পড়াটা তৈরি করতে হবে যে! তারপর ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে শুরু করে। হারিকেনের আলোয় খোকার ছায়া পরে ঘরের পুরনো দেয়ালে। সে এক লম্বা ছায়া। খোকা ভাবে এটা কার ছায়া? তাকে আমি কি চিনি?
হারিকেনের আলোয় তৈরি হওয়া ছায়ার প্রতিবিম্বকে কাজে লাগিয়ে আপনারা কি কখনো ছায়াবাজি চিত্রের কাজ করেছেন? ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাসের জনক হিরালাল সেন সে কাজটি করতেন ঠিক তিনি যখন স্কুলে পড়তেন। হিরালাল সেনের আরেক খালাতো ভাই দীনেশচন্ত্র সেন ছিলেন তার সঙ্গী। পরবর্তীতে দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করে বিক্ষ্যাত আর হিরালাল সেন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণের পুরোধা। সে খবর আমরা জানি। কিন্ত মজার তথ্য হল তারা দুজনেই ছেলেবেলায় এই হারিকেন নিয়ে ছায়াবাজি খেলতেন। আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি আপানাদের অনেকেই হয়তো খেলাটা খেলেছেন। আমরা ছেলেবেলায় হারিকেনের আলো আধাঁরী মিষ্টি আলোতে হাতের আঙুলগুলো বিভিন্নরকম কসরত করে দেয়ালের তার প্রতিবিম্ব ফেলতাম। অবাক কান্ড! সেই হাতের আঙুল গুলি কখনো কখনো তোঁতা পাখির মুখ, কখনো ছাগলের মাথা কখনো উড়ন্ত পাখি হয়ে যেত। আমরা ঘরে বসে বসে বিনে পয়সার সেই সিনেমাটা উপভোগ করতাম।
হারিকেন নিয়ে লেখার কি অন্ত আছে? আমার আব্বার ছিল বড়শিতে মাছ ধরার সখ। আর আমি ছিলাম তার একান্ত সহকারী। আমাদের বাড়ি গাজিপুর কাপাসিয়া এলাকায় প্রচুর বিল আর খাল ছিল। কোন বিলে কোন মাছের ফলন ভালো তা আমার আব্বা ভালো জানতেন। আব্বা কলেজে মাস্টারি করতেন বলে তার অনেক কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছিল। তাদেরই একজন খবর দিল। “স্যার ঢুলি বিলে প্রচুর মাছ এসেছে”। আব্বা দিন খন ঠিক করে তার বড়শি আর প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র নিয়ে চললেন ঢুলি বিলে মাছ ধরতে। সে এক মহা আয়োজন। আমি হলাম তার সঙ্গী। ঘর থেকে বেড় হওয়ার সময় আম্মা আব্বার জন্যে পানের খিলি বানিয়ে দিতে ভুললেন না। ঢুলি বিলে যেয়ে সত্যি প্রচুর মাছের দেখা মিললো। আব্বা ছিলেন যাকে বলে পাকা শিকারি। তিনি জানতেন মাছ কোথায় বেশি পাওয়া যা। তিনি বড়শি ফেলেন আর টপাটপ মাছ উঠান। হঠাৎ আব্বার খেয়াল হল সন্ধাতো হয়ে গেল! আব্বা আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমাদের বাড়ি সেই ঢুলি বিল থেকে প্রায় মাইল খানেকের পথ। এদিকে আমাদের সাথে হারিকেনও নেই। এতটা পথ যাব কীভাবে? আমরা বিলের পাশেই এক গৃহস্থের দ্বারস্থ হলাম । বাড়ির কর্তা সব শুনে তিনি তাদের বাড়িতে আমাদের আথিতিয়তার আহ্বান জানালেন। কিন্তু আব্বা রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত একটা হারিকেন জোগাড় হল। সেই হারিকেনের আলোয় আমরা বাপ-বেটা বাড়ির পথে রওনা হলাম। আব্বার এক হাতে হারিকেন আর আরেক হাতে তার প্রিয় বড়শি আর মাছ রাখার ডুলা। আমার ছোট হাতে মাছ ধরার কিছু যন্ত্রপাতি। হরিকেনটা দুলছে আর সেই হারিকেনের আলোয় আমার নাকের সামনে দুলছে গোটা ভুতুরে এক গ্রাম। সন্ধ্যায় সেই গ্রামের গাছপালাগুলো হারিকেনের ভুতুরে আলোয় কেমন যেন অদ্ভুত আর অচেনা দেখায়। গা তখন ছমছম করে উঠে। আব্বা সেই চলার পথে কত যে গল্প বললেন তার কি কোন শেষ আছে? স্পষ্ট মনে আছে হারিকেনের সেই মোহনীয় আলোয় আমি আমার পিতার বুদ্ধিদীপ্ত মুখটা বার কয়েক দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। মুখে তার সেই চিরচেনা হাসি, চোখে ছিল রাজ্যের আনন্দ!!
হারিকেন আমাদের আত্মার এক অন্যতম অংশ। জানি, বিজলী বাতির দেশে হারিকেনের এখন কোন ভুমিকাই হযতো নেই। কিন্তু হায়! বাঙালীর বহুমুখি আনন্দ উৎসবের জীবন হারিকেনের আলো ছাড়া কি চলে? হারিকেনের আলোকে ঘিরে কীট পতঙ্গগুলো যেভাবে চিমনীর গায়ে ধাক্কা খেত ঠিক একইভাবে বাঙালীর হাজার সুখের স্মৃতিগুলোও যেন শততই হারিকেনের চিমনির গায়ে নিত্যই ধাক্কা খায়। সে কারনেই হয়তো হারিকেন শব্দটা শুনলেই আমাদের নষ্টালজিয়াতে পেয়ে বসে। আহা! হরিকেন যেন আমার শৈশবে লুকিয়ে রাখা সেই রাজকুমারী......!! যাকে হারিয়ে বুকের ভেতর পাথরের মত ভারি এক শূন্যতাকে টের পাই।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:০৯