আমার বরের একটা ডায়ালগ আমার মনে ধরেছে- “বউ বড় হয়ে গেছে”!
গতমাসে যখন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহনের জন্য সুইডেন যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন মাকে ফোন করে জানাতেই মা বললো, জামাই যাবে? আমি বললাম না, আমি একাই যাবো। বুঝলাম, মা মোটেই খুশি না। ফোন রাখতে না রাখতেই বাবার ফোন, একা একা কীভাবে যাবো, কি হবে না হবে এসব প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে আমি মুসকিল আসান আমার বরের হাতে ফোন তুলে দিলাম। যথারীতি উনি সবাইকে বোঝালেন, বুঝিয়ে শান্ত করলেন যে “ইহা সম্পূর্ণ নিরাপদ”। বাংলাদেশের মতো একটা বিচ্ছিরি, পদে পদে ঝামেলা/ অনিরপদ একটা দেশ থেকে সুইডেন অনেক নিরাপদ এবং যাচ্ছিতো টার্কিশ এয়ার-এ, লোকাল বাসে না; সুতরাং সমস্যা হওয়ার কিছু নাই।
এই জিনিসটা আমার বরের খুব ভালো, সে কীভাবে কীভাবে যেন ওড জিনিসগুলি ম্যানেজ করে ফেলে।
তার মানে এইটা ভাবার কিচ্ছু নাই যে সে উদারনৈতিক! উনিও কন্ট্রোলিং এবং আমি নিন্দুক বলে বলি পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন ! প্রয়োজন অপ্রয়োজনে বাসা থেকে বের হতে ইনার পারমিশন লাগে না বটে, কিন্তু জানায় যেতে হয়, এবং সম্পূর্ণ আইটেনারি সহ। রিক্সা নিলাম না সি এন জি, নাকি উবার কল করবো, প্রতি মুহুর্তের জিপিএস অন রাখার মত ইনাকে টেক্স করে অবস্থান জানাতে হয়। ইনার ধারনা বাংলাদেশের ঘরের বাহিরে সিরিয়া পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যেকোনো মুহুর্তে হামলা হতে পারে। তো এই পরিস্থিতির মধ্যে আমি যখন সুইডেন যাচ্ছি, ইনি শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র প্রোভাইড করেই ক্ষ্যান্ত দিলেন। কোথায় ঘুরবো, কী করবো এইসব বিষয়ে কোন মন্তব্য করা দূরে থাক, আমার রিসার্চ করা কোন কিছু ছুঁয়েই দেখলেন না। আমি বললাম, কী হইলো তোমার মন খারাপ? খোঁচা দিয়েও জানতে চাইলাম জেলাস কীনা?? শুধু হাসে, হেসে হেসে বলে “আমার বউ বড় হয়ে গেছে” / একা একা ইউরোপ যায়। আমি বললাম, একটু দেখ না কোথায় কোথায় ঘুরবো? ইনি আন্তরিকতা সহ জবাব দিলেন, ‘তুমি নিজে করো, তাহলে মাথায় সব কিছু থাকবে’।
বলা ভালো যে এই সময় বাঙালি আত্মীয় স্বজন, উভয় পক্ষের এবং বন্ধুরাও তাকে অস্থির করেছে, জ্বালিয়েছে। সবচেয়ে কমন প্রশ্ন, তুমি/তুই কিভাবে যাইতে দিচ্ছ/দিচ্ছিস? ইনি সব অত্যাচার হাসি মুখে সহ্য করে বলেছেন,‘ও যাচ্ছে’!
অবশেষে যখন যাত্রার দিন ঘনিয়ে এলো, তখন ইনি ইনকাম ট্যাক্সের কাগজপত্র গোছাতে ব্যস্ত! আমি শুধু পুরোনো অফিস থেকে চালানপত্র নিয়ে ইনার হাতে দিয়েই ‘বহুত কাজ করে ফেলেছি’ এমন ভাব নিয়ে জামা কাপড় গুছাতে থাকলাম।
যাওয়ার দিন যখন এয়ারপোর্টে পৌছে চেক ইন করলাম, তখন আমার নার্ভাসনেস বেড়ে গেল এবং বাড়াবাড়ি রকম টেনশন শুরু হলো। বিরহে নাকের পানি চোখের পানিও একাকার করে ফেললাম, আমার কান্না কাটির জোরে বেচারা আশেপাশে কে একদম সুইডেন পর্যন্ত যাবে সেটা খুঁজে বের করতে শুরু করলো। এবং দুইজন আপুকে পেয়েও গেল। ওনারা সুইডেনে সেটলড, পৌঁছানোর পর ওনারা আমাকে গন্তব্যে পৌঁছাতেও হেল্প করেছেন।
উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে আমি এই উন্নত দেশের নাগরিক সেবায় মুগ্ধ। আরাম করে ঘুরে বেড়াই আর অভ্যাসমত ইনাকে মেসেঞ্জারে আপডেট দিতে থাকি। বাংলাদেশে যেটা না করলে ঝাড়ি খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেইটা ফলো করে দেখলাম, ভদ্রলোক উল্টা ঝাড়ি দিয়ে বললো- এত মেসেজ দিলে তুমি আশে পাশে কী আছে সেটা দেখবা কী করে! আমি টাসকি খেয়ে, সেই ভাবটা গোপন করে বললাম, দিচ্ছি তোমাকে জেলাস করতে!!
ফিরে এসে বললাম, খুব তো আরামে ছিলা এই কয়দিন, কেউ জ্বালায় নাই। ইনি বললেন, কেউ জ্বালায়?!! নাই বটে; কিন্তু কেউ বলেও নাই, ‘শোন, চা দিবো?’/ ‘কিছু লাগবে?’
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:০৫