somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চামেলী হাতে ব্যর্থ মানুষ

০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ সকাল ৯:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবি হতে চেয়ে দৈনিকের সহকারী সম্পাদক হওয়া, গল্পকার হতে চেয়ে বিজ্ঞাপণী সংস্থার গপ্পো লেখক হওয়া, বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়তে চেয়ে হিসাব বিজ্ঞানে পড়ে ব্যাংকের কর্তা হওয়া, সেবক হতে চেয়ে শোষক হওয়া ‘সফল’ মানুষেরাই কলিকালে সংসারে গল্পকথক।

তাই, আমাদের সন্তানেরা পায় চালাক ও চতুর হওয়ার আশীর্বাদ। হৃদয়ের ডাকে অকারণ একটি কুসুম হয়ে দেউরির কোণায় আলগোছে ফুটে থাকা তাই সংসারে অসফলতার গল্প।

অসফল গল্পের এক নায়ককে পরোক্ষে জানি। চোখ ধাঁধাঁনো বিরাট বেতনের ব্যাংকের চাকুরী ছেড়ে তিনি হয়েছেন প্রাইভেট টিউটর। ব্যাংকের জীবন ভালো লাগে না বলে ‘টিউটর’ হওয়া ‘অসফল গল্পে’র নায়কের কোনো আফসোস না থাকলেও তার নিকটজনদের আছে। নিকটজনদের সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাসের ঝড়ে অসফল গল্পের নায়ক কুঁকড়ে যান রোজ।

আমরা কুঁকড়ে যেতে চাই না। ‘অসফল’, ‘ব্যর্থ’, ‘নিম্নমানের মানুষ’-এর তকমা এঁটে নিতে চাই না গায়ে। বিশেষত, যেই সমাজে পদবী, টাকা আর ঠাঁঠ-বাটই মানুষের ‘উচ্চতা’ মাপার কাঠি সেই সমাজে তো আলবৎ নয়।

অতএব, জেল্লা ছড়ানোই আরাধ্য হে। জেল্লা অর্জনই জীবনের পরমব্রত।

সেই ব্রত পালনে আমাদের সন্তানেরা এ প্লাসের নেশাসক্ত হয়ে ওঠে। প্রশ্ন ফাঁস করে হলেও এ প্লাস চাই। অসাধু উপায়ে হলেও পদ চাই, জয় চাই। কেননা কী উপায়ে বস্তু করায়াত্ত হলো, এরচে’ করায়াত্ত হলো কিনা সেটিই মুখ্য জিজ্ঞাসা। অতএব, সোনা-রূপা ও মণি-মাণিক্য খচিত বহুমূল্য পোশাকই নমস্য। খাঁটি মণি-মাণিক্য না থাকলে নকলেই ভরসা। তবু, জেল্লা চাই। সেই জেল্লার ভেতরে বাস করুক তস্কর, লোভী, লুটেরা ও ফন্দিবাজ এক প্রদর্শক, তাতে ক্ষতি নেই।

সদাগরি আপিসের খান্দানি আধুনিক নফর। পালিশ করা জুতো, ইস্ত্রি করা টাই নিয়ে নামেন পথে। ভুল করেও কোনো নম:শুদ্র -- রিকশা চালক, মাছ বিক্রেতা -- তাকে ‘ভাই’ বলে যদি করে সম্বোধন, তবে তার টাইয়ের জেল্লা খসে যায়! ‘স্যার’ না ডাকার অপরাধে ‘সফল’ মানুষেরা এমনকি সারমেয় ছানা বলে অচ্ছুৎ-কে গালি দিতেও করেন না কসুর।

এই পোশাকী কেতার সমাজে হৃদয়ের ডাকে তুচ্ছ আরদালীর সাথেও বন্ধুর মতন যে বড় কর্তা দাবায় তাস জেল্লা প্রিয় এ সমাজে তিনি ‘খাটো’ মানুষই বটে।

তবু, আবুল হাসানের চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ পড়তে-পড়তে মনে হয়, আজ আমাদের ব্যর্থ ও নিম্নমানের আরো মানুষ চাই। সেই মানুষের পথপ্রদর্শক হবে না শয়তানের কাছে আত্মা বেঁচে দিতে মন্ত্রনাদানকারী ধূর্ত ম্যাকিয়াভেলী; সেই মানুষের পথপ্রদর্শক হবেন চামেলী হাতে দাঁড়ানো একজন ‘ব্যর্থ’ ও ‘নিম্নমানের মানুষ’।

------------------------
দৈনিক সমকালের সাহিত্য-পত্রিকা কালের খেয়া'র গত শুক্রবারের সংখ্যায় কবি আবুল হাসানকে নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে এই সময়ের তিন কবির তিনটি নাতিদীর্ঘ রচনা। প্রিয় এই কবির লেখা যে কবিতাটি নিয়ে আমি লিখেছি সেটির নাম 'চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ'। মূল কবিতাটি এখানে জুড়ে দেয়া হলো:
------------------------

চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ
– আবুল হাসান

আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে সরকারী লোক,পুলিশ বিভাগে চাকরি কোরেও
পুলিশী মেজাজ কেন ছিলনা ওনার বলুন চলায় ও বলায়?
চেয়ার থেকে ঘরোয়া ধূলো,হারিকেনের চিমনীগুলো মুছে ফেরার মতোন তিনি
আস্তেকেন চাকরবাকর এই আমাদের প্রভু নফর সম্পর্কটা সরিয়ে দিতেন?
থানার যত পেশাধারী ,পুলিশ সেপাই অধীনস্থ কনেস্টবল
সবার তিনিএকবয়সী এমনভাবে তাস দাবাতেন সারা বিকেল।

মায়ের সঙ্গে ব্যবহারটা ছিল যেমন ব্যর্থপ্রেমিক
কৃপা ভিক্ষা নিতে এসেছে নারীর কাছে।

আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে দেশে তাঁর ভাইয়েরা জমিজমার হিশেব কষছে লাভঅলাভের
ব্যক্তিগত স্বার্থ সবার আদায় কোরে নিচ্ছে সবাই
বাবা তখন উপার্জিত সবুজ ছিপের সুতো পেঁচিয়ে মাকে বোলছেন,এই দ্যাখোতো
জলের রং এর সাথে এবার এই সুতোটা খাপ খাবেনা?

আমি যখন মায়ের মুখে লজ্জা ব্রীড়া,ঘুমের ক্রীড়া
ইত্যাদিতে মিশেছিলুম,বাবা তখন কাব্যি কোরতে কম করেননি মাকে নিয়ে
শুনেছি শাদা চামেলী নাকি চাপা এনে পরিয়ে দিতেন রাত্রিবেলা মায়ের খোপায়।

মা বোলতেন বাবাকে তুমি এই সমস্তলোক দ্যাখোনা?
ঘুষ খাচ্ছে,জমি কিনছে,শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,
কত রকম ফন্দি আটছে কত রকম সুখে থাকছে,
তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?

বাবা তখন হাতের বোনা চাদর গায়ে বেরিয়ে কোথায়
কবি গানের আসরে যেতেন মাঝরাত্তিরে
লোকের ভীড়ে সামান্য লোক,শিশিরগুলি চোখে মাখাতেন।

এখন তিনি পরাজিত,কেউ দ্যাখেনা একলা মানুষ
চিলেকোঠার মতোন তিনি আকাশ দ্যাখেন,বাতাস দ্যাখেন
জীর্ণ শীর্ণব্যর্থচিবুক বিষন্নলাল রক্তে ভাবুক রোদন আসে,
হঠাৎ বাবা কিসের ত্রাসে দুচোখ ভাসান তিনিই জানেন।

একটি ছেলে ঘুরে বেড়ায় কবির মতো কুখ্যাত সব পাড়ায় পাড়ায়
আর ছেলেরা সবাই যে যার স্বার্থ নিয়ে সরে দাঁড়ায়
বাবা একলা শিরদাঁড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন,কী যে ভাবেন,
প্রায়ই তিনি রাত্রি জাগেন,বসে থাকেন চেয়ার নিয়ে

চামেলী হাতে ব্যর্থ মানুষ, নিম্নমানের মানুষ।
________________________________

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ সকাল ৯:২১
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×