মাথার উপর শরৎ। মাথার উপর আশীর্বাদের মতন শান্ত স্বচ্ছ নীলাকাশ। আকাশের কোল ভরা থোকা থোকা ধবধবে সাদা মেঘ। শরতের শুভ্র নীল আকাশের নিচে রাস্তায় প্রাণ আঁইঢাঁই করা জ্যাম। এই জ্যামে বাইকের পিছনে বসে-বসে কত যে গল্প চোখে পড়ে!
ভুঁড়িওয়ালা বড় কর্তা পুলিশের স্ফীত বপুর চাপে নাভির নিচে নেমে আসা কোমরবন্ধনী। তিনি তাতে বারে বারে পরশ বোলাচ্ছেন। দেখে মনে হয়, মুদ্রা দোষ। তার পাশেই হাড় জিরজিরে, তোবড়ানো গাল, আর প্রায় কোটরাগত কিন্তু বড় বড় টলটলে চোখের কনস্টেবল। তারা দু’জনে একসঙ্গেই খাড়া।
তাদের মতই একঠাঁয় দাঁড়িয়ে এই ক্লান্ত নগর। নগরের পেটের ভেতর একদল পোকামাকড়ের মতন আমরা কিছু মানুষ। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত এক বাবুকে দেখলাম পেছনের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আর লোকেরাও যে যার মতন। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে ভিখিরির হাত। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে হাঁক দিয়ে উঠছে হকারের গলা।
এরই মধ্যে দেখি, প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনের ফুটপাথ ধরে প্রাণ খুলে হাসতে হাসতে হেলে-দুলে এগিয়ে আসছে এক আলুথালু পাগলিনী। মন খুলে সে খিল খিল হাসছে আর খুব আহ্লাদ ভরে কারো সাথে বলছে কথা। বুকের ডান পাশে তার দুইটা হাত এমনভাবে ধরে রাখা, দেখে মনে হয় কিছু একটা বুকের মধ্যে গভীরভাবে জড়িয়ে রেখেছে যেনো।
তার খিল খিল হাসি, আহ্লাদে গলে যাওয়া আলাপ আর বুকের মধ্যে কিছু একটা জড়িয়ে রাখার ভঙ্গি সবাইকে তার দিকে টেনে নেয়। খুব কাছাকাছি এলে দেখি তার বুকের মধ্যে একটা হাঁসের ছানা। হলুদেটে গা। মাঝে মাঝে দু’য়েকটা জায়গায় পাখনার রং একটু ঘিয়া-ঘিয়া। এই দেখে আমার রাইডার বলেন, ওহ! এইটা তো হাসের বাচ্চা! পাইলো কই এমন ছোটো বাচ্চা!
আর কেউ কী বলেছে অতো কথা কানে আসেনি। কিন্তু শরতের আকাশ ভুলে সবার নজর তার দিকেই। যেনো সে জ্যামবন্দী নগরে মুহূর্তের শীতল বাতাস।
আলাপ থেকে উদ্ধারকৃত মনোলগের দুই একটা এরকম: খিক খিক খিক . .. হি হি হি. .. তুমারে থইয়া অহন যাইগা .. যাইগা . . হিহিহি .. কী করবা তুমি .. আমি যাই গা. . যাই গা হি হি হি আমি . ..
এইসব বলতে বলতেই ছানাটিকে হুট করে বুক থেকে নামিয়ে রাখে আমার সামনেই একটা গাছের গোড়ায় সবুজ ঘাসের উপর। ছানাটিকে রেখে পাগলিনী চলে যাবার ভান করে। যেতে যেতে দুষ্টুমিচ্ছলে ফিরে ফিরে চায়। চেয়ে হাসে। খিল খিল। খিল খিল।
কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে সে ফিরে আসে। হাসের ছানার কাছে। ছানা চিঁ চিঁ করে আওয়াজ করে। পাগলিনী উবু হয়ে হাত বুলায় হাসের ছানার মাথায়, গালে ও পাখনায়। হাত বোলাতে বোলাতে বলে, হি হি হি .. তুমি থাকো। আমি যাই গা। হি হি হি করে হাসতে হাসতে সে চলে যেতে থাকে। যেতে যেতে পেছনে তাকায়।
এমন সময় হাঁসের ছানা পাগলিনীর পিছু নেয়। টলমল টলমল করে সে ছুটতে থাকে পাগলিনীর পিছু। পাগলিনী এই দেখে খুশী হয়। খুশী হয়ে আরো হাসে। হাসতে হাসতে বলে: যাও। যাও।
কিন্তু হাঁসের ছানা টলমল করতে করতে তার পিছে যায়। পিছুটানের দিকে চেয়ে পাগলিনী আবার সশব্দে হাসে। হেসে খপ করে আবার বুকে তুলে নেয় ছানাটিকে। নিয়ে সে হাসতে হাসতে হাঁসের ছানার সাথে আলাপ করতে করতে এগিয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনের বাঁধানো ফুটপাথ ধরে। তার যাওয়ার রেখা ধরে কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ চেয়ে থাকে। পাগলিনী সেসব দেখে না।
আমি দেখি। আর ভাবি রবিন্দ্রনাথের কবিতা:
পাগলিনী, তোর লাগি কী আমি করিব বল্।
কোথায় রাখিব তোরে খুঁজে না পাই ভূমণ্ডল
আমার তাড়া নেই। তাই দেখি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ভালোবেসে। দেখি, পাগলিনীর বুক আলো করে আছে এক হাঁসের ছানা। দেখি, পাগিলীনির বুকের মধ্যে হাঁসের ছানার দৃশ্য দেখে নগরবন্দী মানুষেরা ক্ষণিকের জন্য ভুলে যায় জীবনে বিতৃষ্ণা ধরানো জ্যাম ও হর্নের উৎপাত।
দেখি, শরতের আকাশের নিচে আমরা পাগল ও পাগলিনী দল। ছুটছি। আমাদের পিষে মারছে এই শহর। আমরা ছুটছি। আমাদের অনেকেই বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখছি হাঁসের ছানা। আমরা ছুটছি। আমাদের খা খা বুক। অলক্ষ্যে আমাদের প্রার্থনার আড়ালে লুকিয়ে থাকে হাসের ছানা।
২৫.০৮.১৭
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:৪১