somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'ইতর আতরাফ বলি '

১২ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘ইতর আতরাফ বলি’
_____________

নিজেকে মানুষ ভাবার বল পাই না মনে। চিত্ত দূর্বল। মানুষগুলো হয়তো কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার মতন। “মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,/ মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়।”

কিন্তু নিজেকে মানুষ ভাবার সাহস নাই মনে। আজন্ম জেনেছি, আমি মেয়ে। মেয়ে মানুষ। ঘরের জিনিষ। মাল। জেনানা। বেগানা আওরাত।

দৌড় বা বিতর্ক বা আবৃত্তি বা আরো অনেক প্রতিযোগিতায় হয়তো প্রথম হওয়া যায়। স্কুল, কলেজে ছেলে-মেয়ে সকল শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে সেরা হওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে হয়তো অর্জন করা যায় স্বর্ণপদক।

তবু, আপনি নারী। আপনি মেয়ে মানুষ। রাত ১২টায় খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে একা একা নক্ষত্রখচিত আকাশ দেখার অধিকার আপনার নাই ।

কাগজে কী অধিকারের কথা লেখা আছে আমার জন্য, সেই সব লেখা আছে বটে। বাস্তবে, আপনার মানুষ পরিচয় নয়, লিঙ্গ-পরিচয়ই প্রধান। আপনি নারী। আপনি দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক।

আপনার স্তন লক্ষ করে ভীড়ের মধ্যে কনুই এগিয়ে দিতে পারে যে কোনো পুরুষ। বাসে আপনার গায়ে গা ঠেসে দাঁড়াতে পারে যে কোনো পুরুষ। তার প্রতিবাদ করলে, এক কথা দুই কথায় তার সাথে আপনিও গলা চড়ালে আপনাকে যে কেউ থামিয়ে দিতে পারে ‘মেয়ে মানুষ আবার এত জোরে কথা বলেন কেন’ এইটুকু বলে!

আপনি মেয়ে মানুষ। তাই, ইনবক্সে আপনার কুশল জানার ছলে ইঙ্গিত দিতে পারে বন্ধু সুলভ সম্পর্ক থাকা যে কোনো পুরুষ।

আপনি বাল বয়সে বিধবা হয়েছেন। বাচ্চা বয়সী ছেলে-মেয়ে নিয়ে আগলে আছেন স্বামীর ভিটা। আপনার জায়গা-জমি কেউ লুটে নিতে চান? ক্ষতি নেই। আপনার চরিত্রের উপরে দিয়ে দেয়া হোক দাগ। বুদ্ধি করে পাড়ায় ছড়িয়ে দেয়া হোক, আপনার চরিত্র খারাপ।

বছর কয়েক সংসার করার পর আপনাকে আর ভালো লাগছে না আপনার স্বামীর? তার আরেকটা বিয়ে করা দরকার? বেশ তো! চিন্তার কী আছে! চরিত্রহীনার অপবাদ দিয়ে আপনাকে একটা তালাক নোটিশ পাঠিয়ে দিলেই হলো। ব্যাস! কেল্লা ফতে।

আপনি নারী। আপনি কোনো পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। কিন্তু প্রথম হবেন বলে মনে-মনে শতভাগ আশা করে রেখেছিলেন আরেক জন পুরুষ। তার আশা পূরণ হয়নি। অতএব আপনিই কারণ। তাই, আপনার নামে পরিচিত পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দেয়া হবে নানান কথা। আপনার চরিত্রের উপরে লেপে দেয়া হবে কালি। এই কালির কাছে আপনার শ্রম-রাতজাগা-প্রার্থনা-চোখের নিচের কালো দাগ কিচ্ছুটি দাঁড়াবার জো নেই।

হুমম। আপনি নারী। আপনি সহজ শিকার। আপনার উপরে আছে সকল পুরুষের কর্তৃত্ব। পুরুষের কাছে পুরুষ হাসি মুখে পরাজয় মেনে নেবে বটে। তাই বলে, পুরুষকে যদি ছাপিয়ে যায় আপনার কৃতিত্ব তবে তা মানতে কষ্টকর বৈকি!

অতএব, এ জন্ম শিখিয়েছে আমাকে আমি মানুষ নই। মেয়ে মানুষ।

এ জন্মে জেনেছি আমি, এই ভূখন্ডে মানুষ দুই রকম। পুরুষ মানুষ আর মেয়ে মানুষ।

নারী জন্মে জেনেছি আমি, পুরুষ মাত্রই আশরাফ আর নারী মাত্রই আতরাফ।

আতরাফ। এই একটিই পরিচয় আমার। আর সব মিছে। আমার শিক্ষা-দীক্ষা-রুচি-প্রজ্ঞা এসবে কিছু এসে যায় না।

হায়! আতরাফ জনম আমার! এ জীবন এমনি অচ্ছুতের যে, প্রিয়তম পিতা মারা গেলেও এমনকি তার কবরে এক মুঠো মাটি দেওয়ার আমার নাই অধিকার!

ইতর আতরাফের হৃদয় বলে কিছু নেই। তার অধিকার নাই কোনো।

এইটুকু বলে হয়তো টেনে দেয়া যেতো দাঁড়ি। টেনে দেয়া যেতো সমাপ্তি রেখা। কিন্তু যাচ্ছে না। পৃথিবী আশরাফ-আতরাফের নয়। পৃথিবী মানুষের। মানুষই তা প্র্রমান করেছে বারবার।

যে দেশে গরু পেটানোর মতন করে বউ পেটানো ছিল সংস্কৃতির অংশ, যে দেশে স্ত্রীকে নিয়ে আছে প্রবাদ ‘ভাগ্যবানের মরে বউ আর দুর্ভাগা মনে গরু’ সেই দেশেই মানুষ জেগে উঠছে।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা নিচুজাতের মানুষেরা উঁচু জাতের মানুষের হাতে এই ভূখন্ডে যত না হয়েছে নির্যাতিত, তার চেয়েও অধিক হারে এইখানে নিগ্রহের শিকার হয়েছে নারী। লঘু-গুরু নির্বিশেষে সকল ধর্মে, ব্রাক্ষণ-কায়স্থ-নম:শুদ্র নির্বিশেষে সকল বর্ণে এবং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীতেই নারীই ছিল একমাত্র নিপীড়িত।

কিন্তু আজ সেই নিপীড়ন সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়ে উঠছে। শুধু লৈঙ্গিক কারণে নারী যে নিগ্রহ ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাত্রা বাড়ছে।

আর এইটুকুই আমাকে আশাবাদী করে।

‘হোক প্রতিবাদ’ লিখে ফ্যাস্টুন হাতে রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন আফসানা কিশোয়ারের মতন নারী। তার আবেগে সামিল হয়ে ‘হোক প্রতিবাদ’ লিখে রাস্তায়-রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় দু-চার জন করে হলেও প্রতিবাদ করছেন। আওয়াজ ওঠাচ্ছেন। এই আওয়াজই আমাকে আশাবাদী করছে।

যৌনসন্ত্রাস প্রতিরোধে গণ কনভেনশান হচ্ছে। যৌন নিপীড়নের শিকার নারী এবং তার পরিবার সামাজিক কলঙ্ক ও লোকলজ্জার ভয় তাচ্ছিল্য করে সামনে এগিয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে-বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন-নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে। এই সব ছোটো-ছোটো ঘটনাগুলো আমাকে আশাবাদী করছে।

কবিতায় যেমন লেখা আছে, ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালু কণা, বিন্দু বিন্দু জল/ গড়ে তুলে মহাদেশ সাগর অতল’ ঠিক তেমনিভাবেই এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মিলেই একদিন বড় কিছু হবে। একদিন আমূল পরিবর্তন আসবে আমাদের সংস্কৃতিতে।

আমাদের সংস্কৃতিও হয়ে উঠবে নারী নিপীড়ন বিরোধী। আর একদিন আমাদের দেশ থেকে সকল রকম লৈঙ্গিক নিগ্রহ তিরোহিত হবে। এমনকি হয়তো একদিন এই বঙ্গীয় সংস্কৃতি এমনি মানবিক হয়ে উঠবে যে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল সন্তান পাবে তার বাবা-মা বা প্রিয়জনের কবরে একমুঠো মাটি দেবার অধিকার।

১১.০৫.১৮
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৮ সকাল ৯:৩৯
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×