ডেভিড গুডউইল। অস্ট্রেলিয়ান বোটানিস্ট ও ইকোলজিস্ট। ১০৪ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হয়েছে।
গুডউইলের মৃত্যু যে কোনো একটি সাধারণ ঘটনা বা দূর্ঘটনা নয়।
তাঁর মৃত্যু একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা।
মি. গুডউইল দরিদ্র বা দু:খী বা অসুস্থ্য বা অসুখী ছিলেন না। তাহলে কেন তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নিতে চেয়েছেন?
ব্রিটিশ কাগজ টেলিগ্রাফ-এর অনলাইন সংস্করণে মি. গুডউইলের একটি ছোটো সচিত্র প্রতিবেদন মতন দেখলাম।
সেখানে তাঁর পরিবার-পরিজনেরা তাঁকে ঘিরে রেখেছেন। তাঁর জন্মতিথি উদযাপন করছেন।
সেই জন্মদিনেরই ছোট্ট একটি ক্লিপিংস জুড়ে দেয়া আছে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনটিতে। যেখানে তিনি বলছেন, এই দীর্ঘ জীবন নিয়ে তিনি আর আহ্লাদিত বা পুলকিত নন।
নিজের দীর্ঘ জীবনকে আর বয়ে নিতে সম্মত ছিলেন না ডেডিভ গুডউইল। তাই, সানন্দে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিতে চেয়েছিলেন।
‘বন্দী’ নামে আমার লেখা একটি গল্প আছে। সেই গল্পের মূল চরিত্র বয়সের ভারে নুব্জ্য একজন পুরুষ। দীর্ঘ জীবন তার কাছে বোঝার মতন মনে হয়। বুকের উপরে ভার হয়ে চেপে বসে। সেই ভার মুক্তির জন্য সে বেছে নেয় তার মতন একটা উপায়।
গল্পটি সমকাল পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল।
কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যুর মতন গুরুতর সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়।
পরিবার-পরিজনেরা গুডউইলের এই মৃত্যুর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। টেলিগ্রাফের ওই প্রতিবেদনেই একজনকে এই কথা বলতে দেখলাম।
পশ্চিমা দুনিয়ার অনেক জায়গাতেই খুব গুরুতর অসুস্থ্য ব্যক্তি যার আর সেরে উঠবার কোনো সম্ভাবনাই নেই এবং যার বেঁচে থাকাটাও মৃত্যুর চেয়ে কষ্টকর সেসব ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নেয়ার আইনি বৈধতা আছে।
কিন্তু মি. গুডউইলের তেমন কিছু ছিল না।
তবু কেন তবে তিনি জীবন থেকে ছুটি নিতে চেয়েছিলেন? দার্শনিক জিজ্ঞাসাই বটে।
দীর্ঘজীবনে তার ক্লান্তি ধরে গিয়েছিল। এই জীবন তিনি আর বহন করতে চাইছিলেন না। এটাই ছিল তার বক্তব্য।
হতে পারে, জড়ভরৎ শরীর তার চেতনাকে ক্লান্ত করেছিল।
হতে পারে, দীর্ঘ জীবনে ভালোবাসার মানুষদের হারাতে হারাতে চিত্তে তার জমেছিল অমোচনীয় ক্লান্তির ক্লেদ।
হতে পারে, এ জীবনে যা কিছু দেখা যেতে পারে সব তিনি দেখেছেন। তাই, আরবার সেই স্বাদ তিনি নিতে চাননি।
যা কিছুই হোক, সতর্ক ও সচেতন মনে সজ্ঞানে তিনি মৃ্ত্যুকে তার বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
ব্রিটেনে জন্ম নেয়া এই বিজ্ঞানী অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হয়েছিলেন। কিন্তু সহজে মৃত্যুকে বেছে নিতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিলেন সুইৎজারল্যান্ডে। কারণ অস্ট্রেলিয়ায় এভাবে মৃত্যু অনুমোদিত নয়, সুইৎজারল্যান্ডে অনুমোদিত।
সেখানেই ডাক্তারেরা ইনজেকশান দিয়ে তাকে পাড়িয়ে দিয়েছে চিরঘুম।
পরম পরিতৃপ্তি নিয়ে তিনি ঘুমিয়েছেন প্রশান্তিতে।
কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা নয়, নিজের মৃত্যুদিনটি ছিল আর যে কোনো উৎসবের দিনের মতই পরিকল্পিত, প্রার্থিত।
প্রার্থিত এই সুখী মরন জীবনের এক নিপুণ সমাপ্তি বৈকি!
ডেভিড গুডউইলের এই সিদ্ধান্তকে আমি সশ্রদ্ধায় সম্মান জানিয়েছি।
আমিও মনে-মনে চাই আমাদের দেশ ও সমাজ আরো মানবিক হয়ে উঠুক।
ক্লিবের মতন, জড়ের মতন, কীটের মতন যে কোনো একটা উপায়ে কেবল শরীরটাকে পেলে-পুষে বয়ে বেড়ানোটা যে জীবন নয় সেই সত্য সকলে হৃদয় দিয়ে অনুভব করুক।
মৃত্যুকে কেবলি একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা হিসেবে না দেখে একটি বিকল্প হিসেবেও দেখা হোক।
মৃত্যুকে যখন মানুষ আরো গুরুত্ব দিতে শিখবে তখন জীবনও তার কাছে আরো প্রার্থিত হয়ে উঠবে বৈ-কি!
রোগ থেকে যার সেরে উঠবার আর কোনো দাওয়াই নেই, কোনো উপায় নেই তারা সরকারের কাছে চাইলে ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য সজ্ঞানে আবেদন করবেন। মেডিকেল গ্রাউন্ডে তাদের এই মৃত্যু গ্রহণযোগ্য করা হবে।
এইসব মৃত্যুর জন্য থাকবে কিছু সেন্টার। সেখানে পরিজন পরিবৃত্ত হয়ে সুখী মুখে মানুষ জীবনের বিকল্পকে বেছে নিতে যাবেন।
মেডিকেল গ্রাউন্ডের বাইরেও ডেভিড গুডউইলের মতন কেউ যদি জীবন থেকে ছুটি নিতে চান তাহলে তার জন্যেও একটা ব্যাবস্থা রাখতে হবে।
আমি মনে করি মানুষের সামনে সবসময়ই বিকল্প খোলা থাকা উচিত। বিকল্প খোলা ছিল বলেই মৃত্যুকেও জন্মদিনের মতনই হাসিমুখে আনন্দময় ঘটনার মতন বরন করে নিতে পেরেছেন গুডউইল।
কিন্তু বিকল্পের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলেই মানুষের মন বিকল হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশেও সামনের দিনে নীতি নির্ধারকেরা এই বিষয়গুলো নিয়ে আরো ভাববেন বলে আশা করি।
তাই বলে এটি ভাবার কারণ দেখি না যে, ইউথনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমোদন থাকলেই দলে-দলে মানুষ মৃত্যুর জন্য আবেদন করবেন বা প্র্রেমে ব্যার্থ হলেই, ব্যাবসায় বিরাট লোকসানের মুখে পড়লেই চরম হতাশ হয়ে কেউ স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করে বসবেন।
কারণ স্বেচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রেও ক্রাইট্রেরিয়া সেট করা থাকবে।
আর বিভিন্ন বয়সী মানুষের হতাশা ও বিষণ্নতা সারাতে থাকবে অন্য ব্যাবস্থা।
তবে, বিকল্প অবশ্যই খোলা থাকা প্রয়োজন। বিকল্প খোলা থাকলে মানুষ তার জীবনকে নিয়ে আরো মমতা ও সতর্কতার সাথে নাড়া-চাড়া করবে বলে মনে হয়।
#Euthanasia #স্বেচ্ছামৃত্যু #ইউথেনেসিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৮ দুপুর ২:৩০