somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিজের কাছে ফেরা

৩১ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানুষ বোধহয় তার নিজেকেই চেনে সবচে’ কম। মানে আমার মতন গড়পড়তা মানুষের জন্য নিজেকে না-চেনাই অলঙ্ঘনীয় সত্য বুঝি!

নিজেকে যে চিনি না সেটি বুঝি কখন?



আমি যে আমাকে চিনি না সেটি খুব প্রবলভাবে প্রথমবার অনুভব করি জার্মানীতে থাকার সময়। একদিন হঠাৎ আমার রিয়েলাইজেশান হলো, আরে! আমি দেখি ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বাজারে ঘুরছি। ঘুরে ঘুরে রান্নার সদাই-পাতি কিনছি।

এটা-ওটা-সেটা টুকি-টাকি কততো কিছু!

যে বস্তু আজ বা কাল লাগবে বা লাগতে পারে বা লাগা উচিত সেটা কিনছি।

যে বস্তু আজ-কাল-পড়শু বা আগামী সপ্তাহ বা এমনকি আগামী মাসেও হয়তো লাগবে না তেমন জিনিষ কিনছি। বেহুদা জিনিষও কিনছি। কিনতে-কিনতে ট্রলি ভরে ফেলছি।

কিন্তু ঘুরে-ঘুরে সবজি কেনা, বোতল বোতল রেড ওয়াইন কেনা, গাট্টি গাট্টি চকলেট কেনার মধ্যে যে আনন্দ পাচ্ছি সেটা আচনক টের পেলাম ঘুরতে-ঘুরতে, ঘোরার মধ্যেই। এর আগে দেশে থাকতে কখনো এটা বুঝিনি আমি। কখনো এমন করিওনি আমি।

জার্মানীতে প্রতি উইকেন্ডের আগের রাতে সারা রাত ধরে আমি রান্না করতাম। একটা সময়ে আমার কিচেন-মেটরা সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেলো যে, আমি বৃহস্পতিবারে রাতভর রান্না করি আর লো ভলিউমে গান ছেড়ে রেখে কিচেনের দুয়ার আটকে রাখি। কিন্তু মাঝে-মাঝেই জানালা খুলে রাখতাম একটুখানি। হাল্কা করে হিম ঢুকতো ঘরে। কিন্তু রান্নার চক্করে আমার শীত লাগতো না।

আমি আট, নয়, দশ, বারো, চোদ্দ পদ রেঁধে ফ্রিজ ভরে রাখতাম। অনেক সময় ফ্রিজের তাকে জায়গা হতো না। ঠেলে-ঠুলে ভরতাম ছোটো ছোটো বাক্সো। কখনো-কখনো আমার কিচেন মেটদের অনুমতি নিয়ে তাদের জন্য নির্ধারিত তাকেও কিছু রাখতাম। ডিপেও ভরে রাখতাম দুই-চারটা পদ।

এমনো হতো, কতো খাবার নষ্ট হয়ে গেছে! এতো খাবার খাওয়ার জন্য অত সময়ো থাকতো না। আর ইচ্ছেও হতো না। কিন্তু আমি যে রাত ভর রান্না করতাম আর রান্নার মধ্যে যে অদ্ভুত আনন্দ পেতাম সেটি রান্নায় মজে না যাবার আগে আমি বুঝিনি! অথচ ঢাকায় আমার কত যে দিন গেছে! শুধু রান্নার ভয়ে দিনের পর দিন আমি নুডুলস খেয়েছি!

এখনো যে এমন হয় না তা নয়। জার্মানী থেকে ফিরে এসেও রান্নার ভয় ছিল। দিনের পর দিন আমার খালি পাস্তা খেয়ে কেটেছে; রাতভর এতো এতো রান্নার অভিজ্ঞতা থাকার পরেও!

আমি যে নিজেকে চিনি না তার আরেকটা অদ্ভুত এবং আজব প্রমাণ পেয়েছিলাম বছর দু’য়েক আগে। শ্রীলঙ্কায় গিয়ে।

ছোটোবেলা থেকেই আমি সাধারণত শব্দ করে বিশেষ হাসি না। মানে হাসতাম না। মানে, কোনো কারণে আমার ধারণা হয়েছিল যে, আমার সশব্দ হাসি বড় কুৎসিৎ, কদাকার। এই বোধ কবে কখন কীভাবে যেনো আমার ভেতর থেকে সশব্দ হাসিকে মুছে দিয়েছিল। আমি বোঝার আগেই। তাই আমার ধারণাই ছিল না যে আমিও খুব জোরে, সশব্দে, ভুবন কাঁপিয়ে হাসতে পারি।

আমার মা, আমার ভাই-বোনেরা বা আমার স্বামীও আমাকে অমন ভুবন কাঁপানো হাসিতে কখনো জগত কাঁপাতে দেখেনি। দেখবে কী করে! আমি নিজেই তো নিজেকে ওভাবে হাসতে দেখিনি কখনো।

কিন্তু বছর দু’য়েক আগে শ্রীলঙ্কা গেলাম। সেখানে গিয়ে একটা টিমের সাথে আমার দারুণ বন্ধুতা জমে গেলো! সেই গ্রুপের প্রত্যেকেরই আছে অনন্য একেকটা গুণ। তো তাদের সাথে থাকতে-থাকতেই হঠাৎ আমি টের পেলাম আমার হাসির শব্দে ওরা সব বোকা বনে গেছে।

কেমন বোকা? এমন বোকা যে ওদের কাছে মনে হয়েছে, একটা হাসির মেশিনের সুইচ দিয়ে তারপর সেটা কেউ অফ করতে ভুলে গেছে।

অতএব মেশিন বেজে যাচ্ছে তো যাচ্ছে.. যাচ্ছে তো যাচ্ছে... থামার আভাস নেই।

অকারণে, তুচ্ছ কারণে, নাই কারণে সে-কী হাসির হুল্লোড়!

আর হাসির শব্দ কেমন? কলম্বোর সাগরপাড়ে বিরাট বিরাট পাথরের গায়ে তুমুল শব্দ করে অঢেল পানি আছড়ে পড়ার শব্দকেও ছাপিয়ে গেছে কলের মেশিনের মতন আমার সেই হাসির লহর!

আমার সেই হাসিকে বন্ধুরা নাম দিয়েছিল ‘ভাইরাল হাসি’। কিছু হলেই ওরা ভয়ে বলে উঠতো, এই বুঝি শুরু হলো সোমার ভাইরাল হাসি!

অথচ এর আগে আমি তো জীবনের ৩২ বছর পাড় করেছিলাম। কই! কখনো তো হয় নি এমন। কোথায় ছিল এই সশব্দ হাসি? কলম্বোর সাগরপাড়ে?

কী জানি! মানুষ বড় আজীব! আর অচেনাও। সবচে’ বেশি অচেনা সে নিজের কাছেই।

এবার যেমন কলম্বোতে গিয়ে আমি নিজেই নিজের কাণ্ড দেখে বেকুব বনে গেছি! আমিও এতো সেল্ফি তুলতে পারি!

মানে এতো এতো সেলফি তোলার ইচ্ছা আমার মতন ম্যাড়-ম্যাড়া কিসিমের মানুষেরো হয়! এই সফরের আগে যে কয়েকবার আমি সেলফি তোলার এটেম্পট নিয়েছি তার ৭০ ভাগের বেশি সময় আমি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে ব্যার্থ হয়েছি। হয় ছবির ফ্রেমিং হতো না। নয় হাত কাঁপতো, ছবি ঘোলা হয়ে যেতো। নয় কিছু একটা।

কিন্তু এবার দেখলাম আমি সেল্ফি তুলছি। রাশি রাশি। একা একাই। সুন্দর সব সেল্ফি। অনেক সেল্ফি তোলার পর হঠাৎ খেয়াল হলো, আরে! আমি এতো সেল্ফি তুলছি কেন! আগে তো কখনো আমার এমন ইচ্ছে হয়নি!

কী জানি মানুষের সব কিছুর জন্যই বোধ হয় একটা কিছু ট্রিগার হিসেবে কাজ করে। কখন যে কোন ট্রিগারে কোন ঘটনায় কীভাবে চাপ লেগে যাবে আর নিজের ভেতরে থাকা ল্যাবিরিন্থ থেকে কোনটা বেরিয়ে আসবে আচনকভাবে সেটা বেরিয়ে না আসার আগ পর্যন্ত আমরা কেউ তা জানতেও পারবো না।

আমি যার প্রেমে পড়ে আছি, তুমুলভাবে তার প্রেমে পড়ার আগে কখনো বুঝতেই পারিনি প্রেমের বোধ এতো গভীর! এতো গভীর!

প্রেমে পড়লে মানুষের জগতের রং বদলে যায়। প্রেমে পড়লে খালেদ হোসেইনির উপন্যাসের বর্ণনার মতন মানুষের চোখের ভেতর উদিত হয় রংধনু। প্রেমে পড়লে মানুষ গড়পড়তা থাকে না আর।

গড়পড়তা মানুষের বাইরে যে জীবন সে জীবন পেতে গেলে টাকা দিয়ে পাওয়া যায় না। শঠতা দিয়ে পাওয়া যায় না। পরিকল্পনা করে পাওয়া যায় না। সেই জীবন মিলে যায়। হঠাৎ করেই। সাগর পাড়ে পাওয়া অপার হাসির মতই সেই জীবন। সহসাই গ্রাস করে নেয় সমস্ত স্বত্ত্বা যেনো।

আমি নিজে প্রেমে পড়ার পর থেকে আমার প্রেমে যারা পড়েছিল সেই সব মানুষদের জন্য আমার মায়া বেড়ে গেছে।

হাইস্কুলে পড়ার সময় যে আমাকে দেখার জন্য পথের পাশে গাছের মতন দাঁড়িয়ে থাকতো, যে আমাকে প্রথম পাঠিয়ে ছিল প্রেমের চিঠি, কলেজে যে আমার পিছু পিছু ঘুরতো, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আমাকে বলতেও পারেনি যে সে আমাকে ভালোবেসেছে তাদের সবার জন্য আমার বড্ড মমতা জেগেছে।

আমি নিজে প্রেমে পড়ার পর বুঝেছি প্রেমে পড়া মানুষ কতটা অসহায়! কতটা কাতর!

কিন্তু সত্য স্বীকারে বাধা নেই যে, কেউ আমাকে দেখার জন্য পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকছে সেটা অল্প বয়সে নিজের প্রতি কিছুটা ভালোলাগা তৈরি করে দিয়েছিল হয়তো। হয়তো, না চাইতেই লোকে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে দেখে প্র্রেমের প্রতি আমার কোনো বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। মনে হতো, এ আর এমন কী! এ তো না চাইতেই মেলে।

কেউ কেউ আমাকে ভালোবেসেছে। প্রেমে পড়েছে। কিন্তু আমি তাদের প্রেমে পড়িনি। উল্টো তাদের অনেকের সাথেই রুঢ় স্বরে কথা বলেছি।

কিন্তু মানুষ পাল্টায়। তার বোধ পাল্টায়। তাই, আমি ভালো না বাসা সেই প্রেমে পতিত মানুষদের জন্য আমার মায়া দেখা দিয়েছে আমি নিজে প্রেমে পড়ার পর।

সেই সব প্রেমে পড়া পুরনো মানুষ--যারা সত্যিকার অর্থে আমাকে ভালোবেসেছিল-- যাদের সাথে আমার যোগাযোগ নেই এক কি দেড় দশক বা তারো বেশি, আজো আমি তাদের নাম ধরে প্রার্থনা করি।

প্রার্থনা করি এই জন্য যে, আহা! না জেনেও যদি আমি তাদের দু:খ বা মনোকষ্টের কারণ হয়ে থাকি তারা যেনো সেই কষ্ট ভুলে যায়। তাদের যেনো কল্যাণ হয়।

এই বোধটা মনে হয় এরকম যে, একমাত্র নিজে মা বা বাবা হবার পরই প্রকৃত অর্থে অনুভব করা যায় মা ও বাবার অনুভূতি।

আমি যে একজন গড়পড়তা মানুষ তা আমি এখন জানি। মানিও। সেই জানায় কোনো কষ্ট নেই। মন খারাপ নেই। কিন্তু আগে হলে গভীর মন খারাপ হতো।

কারণ আগে আমার নিজেকে মনে হতো আমি আলাদা কিছু। বিশেষ কিছু। সবার চেয়ে আলাদা কিছু। কিন্তু এখন আমি জানি, আমিও একটা নুড়ি; সামান্য নুড়ি সাগর পাড়ে।

আমি যে অতি সামান্য, অতি গড়পড়তা তা-ও জানতাম না। ক্রমে জেনেছি। দিনে দিনে আমি পৌঁছেছি আমার না-জানার কাছে।

জানায় আনন্দও আছে, টের পাই। নিজেকে নিয়ে ভ্রমের মাঝে থাকার চেয়ে নিজের ক্ষুদ্রত্ব, অহং, লোভ আর নিজের অচিনজনকে জানাটাকে বড় অমূল্য মনে হয় আজকাল।

জীবনের আসছে দিনগুলোতেও আরো কত না জানাকে জানবো নিশ্চয়ই! অচিনকে চেনা, অপ্রিয় হলেও নিজের সত্যকে জানা সত্যিই আনন্দময়!

৩১ জুলাই ২০১৮ # মঙ্গলবার
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:১০
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×