somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'জুতো সেলাই ও সূঁচকর্মের মতন কবিতাও হাতের কাজ': ২০১৩ সালে দেয়া সাক্ষাৎকার

১৬ ই অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সপ্তজিজ্ঞাসে—
কবি আফরোজা সোমা


(কবিতাসংশ্লিষ্ট সাতটি নির্ধারিত প্রশ্ন নিয়ে ‘সপ্তজিজ্ঞাসে’ নামের এ আয়োজন। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের পক্ষ থেকে তানিম কবিরের করা প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েছেন কবি আফরোজা সোমা)

কবিতা কেন লিখেন— একজন কবি এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে বাধ্য কি না? যদি বাধ্য নন— তো কেন? আর হোন যদি— আপনার প্রতিও একই প্রশ্ন; কেন লিখেন কবিতা?


কবিতা লেখা কোনো আইন বিরোধী কাজ নয় যে, কবি মাত্রই কারণ ব্যাখ্যা করতে বাধ্য থাকবে। একজন খুনী— সে পেশাদার, অপেশাদার, সিরিয়াল কিলার— যাই হোক, খুনের কারণ ব্যাখ্যা দিতে সে আইনের কাছে বাধ্য থাকে (ব্যাখ্যা সে দিক বা না দিক)।

‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘জনবিরোধী’ কোনো কর্ম বা লেখা প্রকাশের পর— সরকার বা প্রতিষ্ঠানের কাছে জওয়াবদিহি করতে ব্যক্তি বাধ্য থাকে। কিন্তু দু’ চারটা ব্যাতিক্রম ঘটনা ছাড়া কবিতা আইন বা জনবিরোধী কোনো কাজ নয়। তো, কবি কেন বাধ্য থাকবে জওয়াবদিহিতে?

মোজার্ট কেন সুর ভালোবেসেছে, আন্দ্রেই তারকোভস্কি কেন সিনেমাই বানিয়েছে, গ্যোয়েটে কেন সাহিত্যই করেছে, ফ্রান্সিসকো গোয়া কেন চিত্রকরই হয়েছে— এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে কি কোনো বাধ্যবাধকতা হয়?

আমার মনে হয়, বাধ্যবাধকতা জাতীয় শব্দ এখানে খাটে না। বরং একজন কেন লেখেন, আঁকেন, সিনেমা বানান, সুর বাঁধেন— এই বিষয়গুলো আমরা এম্নি জানতে চাই, আগ্রহ বশে। কেন, কী তাড়নায়, কোন বোধে আপ্লুত হয়ে একজন পিয়ানোতে চালাতে পারেন উন্মাদ আঙুল— সেটা তো একটা বিরাট কৌতুহলের বিষয়। সেই কৌতুহল থেকেই প্রশ্নটি করা হয়। কৌতুহলী জিজ্ঞাসুর প্রশ্ন আর জেরাকারী পুলিশ বা আইনের লোকের প্রশ্ন তো এক নয়।

কেন লিখি কবিতা? প্রথমত, সেটা আমি পুরোটা জানি না। প্রথম যখন লিখতে শুরু করেছিলাম, তখন কেন শুরু করেছিলাম— সেটার একটা ঘটনা বা স্মৃতিবহ ব্যাখ্যা তো আছেই। কিন্ত কেন আমি কবিতাই লিখতে শুরু করেছিলাম, কেন আমি কবিতাই লিখি, কেন আমি কবিতাই লিখতে চাই— তার কিছু ব্যাখ্যা আছে তো বটেই, কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় কি জওয়াব পুরোটা রাখা আছে? আমি তো পুরোটা পাই নি কখনো।

খুব শিশুকালে, ক্লাশ ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর, ফাইভে পড়া ছড়া ও কবিতাগুলোর ছত্রে ছত্রে— কেন আমি ‘মিহি মিহি’ হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিলাম, সে তো আমি জানি না। শিশু আমার মধ্যে কেন একা একা অত কথা তৈরি হতো; কেন সে সব কথা বলার জন্য দোয়েল পাখির সঙ্গে, গাছের সবুজের সঙ্গে, কলাগাছের সঙ্গে, বাতাসের সঙ্গে দিনের পর দিন আমি প্রলাপ বকেছি— সে তো আমি জানি না। তারপর একা একা বলা কথারা কখন যে মুখ থেকে খাতায় নেমে এলো, তাও তো জানি না ঠিক; কোনো পূর্ব পরিকল্পনা করে তো আর লেখা শুরু করি নি।

বিশ্বজিৎকে খুন হতে দেখার পর আমার মধ্যে যে চাপ তৈরি হয়েছিল— তা থেকে যে কবিতাটি রচিত হয়েছে তার ব্যাখ্যা হয়তো আমি দিতে পারি, কিন্তু কেন আমি কবিতাই লিখি, সে তো আমি জানি না। কেন যে ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’ তা কি অমলকান্তিও পুরোটা জানতো?

একটা মুভ্যি আছে— সেখানে মূল চরিত্র এক জুয়ারী। জুয়ার নেশায় সে তার আইনের স্কুল, বান্ধবী, জীবনের শান্তি— সব হারায়। সব ফিরে পাবার আকুলতায় জুয়ারী পণ করে যে, জুয়া ছেড়ে দেবে। কিন্তু কিছুদিন গেল কি গেল না, আবার যেই কি সেই। জুয়ারী জুয়াকে ছেড়েছে, কিন্তু জুয়া তো ছাড়েনি তাকে। তাই, পাকে-চক্রে, ঘটনা-দুর্ঘটনায়, জুয়ারী সে ফিরে আসে জুয়ার তাসেই।

এখানে কে কাকে বেছে নিয়েছে? জুয়ারী বেছেছে জুয়ার তাসকে, না-কি জুয়ার টেবিলই ছেলেটিকে টেনে এনেছে চেয়ারে? হতে পারে, এই নিয়ে বিস্তর আলোচনার অবকাশ আছে বটে। তবে, আমি বলি, গন্তব্যকে আমি বেছে নিইনি। গন্তব্যই বেছে নিয়েছে আমায়। আমি যদি তাকে বেছে নিতাম— তবে, আমিই হতাম তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রক। কিন্তু যেহেতু তাকে ছাড়া, না চাইতেও, বোধের ভেতর আমি রিক্ত হয়ে যাই, সেহেতু কী করে বলি: আমিই তার একক প্রভু, একমাত্র হুকুমদাতা?

আর কে নারায়ণের একটি গল্প আছে আন্ডার দি বেনিয়্যান ট্রি নামে। সেই গল্পের যে মূল চরিত্র, সে এক গল্প কথক। প্রতি মাসে তার মনে একটা করে নতুন গল্প তৈরি হয়। প্রতি মাসে, বিরাট বটবৃক্ষের নিচে প্রদীপ জ্বেলে সে গাঁয়ের লোকদের জানায় যে, তার গল্প তৈরি। প্রদীপ দেখে গাঁয়ের ছেলেবুড়ো সব আসে, গল্প শুনে যায়। এভাবেই চলে বছরের পর বছর।

কোনো দিনও এক গল্প দুইবার বলেনি সেই কথক। কিন্তু একদিন গল্প বলার সময় হঠাৎ করেই তার কথা যেন ফুরিয়ে আসে। গল্প বলতে গিয়ে কিছুতেই সে যেন আর ভাষা খুঁজে পায় না। তখন, এইভাবে ভাষাহারা কিছুদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর, গল্পকথক সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, কথা দেবী দেয়; কথা দেবীই নেয় (““it is the Mother who gives the gifts; and it is she who takes away the gifts.”)। অর্থাৎ গল্পের দেবীই কথককে গল্প আর দিচ্ছে না— এই বোধে পৌঁছানোর পর থেকে, সেই বৃদ্ধ কেমন যেন বোবা মতন হয়ে যায়; নিতান্ত বাধ্য না হলে আর কোনো দিনই কথাও বলেনি সে।

আমার কোনো দেবী নেই। কোনো দেবী আমাকে জোগায় না কথা। তবে কি আমিই আমার কথার উৎস? হ্যাঁ, বৈজ্ঞানিকভাবে তো বটেই। কিন্তু আমার ভিতর আমি যে কী করে বিভক্ত হয়ে আছি তার সব উত্তর কি বিজ্ঞানে আছে? ‘মন’ আমার অধীনে না থাকলে, আমি আর আমার মন কেন দূরে সরে সরে গিয়ে নাড়িয়ে দেয় আমার জগত? মন আর আমি কি তবে দুই? দুই যদি হয়, তবে মন সে কোথায় আছে? হৃদপিণ্ডে, মগজে— কোথাও তো বিজ্ঞান তাকে দেখাতে পারেনি। অচেতনের ঘরে গিয়ে দর্শন বা মনোবিদ্যা মনকে খোঁজে। মানে আমার মধ্যেই আছে এক অচেতনের জগত। কিন্তু আমি তাকে জানি না; আমি তাকে নাড়াতে পারি না। বরং সে-ই আমাকে নাড়ায়। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? আমার মধ্যে থাকার পরেও, আমারই অংশ হওয়ার পরেও— আমি আর আমার অচেতন স্বতন্ত্র দুই সত্তা? তবে, সে-কি আমি নয়? যদি নয়— তো সে কে? কে সে এমন শক্তিধর, আমারই ভেতরে আছে, তবু আমি তাকে চিনি না?

এই অচেতনই কি ছিল সেই গল্প কথকের দেবী? যে কথা দেয়, কথা নেয়? যদি সেই দেবী ছিল ওই কথকেরই ভেতর, তবে সেই দেবী কেন শোনেনি তার প্রভুর হুকুম? কেন অনেক খুঁজেও প্রভু তার বাক্য পেল না আর? তবে কি, দেবীকে ধারণ করছে যে দেহ, দেবী সে দেহের মালিকের অধীন নয়? দেহের মালিকই কি তবে দেবীর বাহকমাত্র ছিল? ছিল তার নির্ধারিত, নিয়ন্ত্রিত দাস?

গল্প কথক মানুষটির কেন এমন হলো; কোথা থেকে গল্প এলো, কোথায় চলে গেলো— সে আমি জানি না। শুধু জানি, আমি কেন লিখি— এই প্রশ্নের উত্তরে প্রতিটি কবিতা ধরে ধরে হয়তো তার ঘটনা, ইতিবৃত্ত মনে করে করে একটি করে ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। কিন্তু ‘আমি কেন কবিতা লেখি’ সেটি আমি পুরোটা জানি না।

‘কবিতা কেন লেখি?’— এর উত্তরে শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে যে— কবিতা হচ্ছে আমার এক্সটেনশান। এই এক্সটেনশান কখনো চিন্তার, কখনো শারীরিক। আমি কোথাও পৌঁছাতে না পারলেও আমার কবিতা পৌঁছে যেতে পারে। তার এই পৌঁছে যাওয়ার মধ্য দিয়েই ঘটে আমার চিন্তা ও শরীরের উপস্থিতি। এই উপস্থিতি কেবল স্থানিক নয়। সময়ের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। হাজার বছর পারি দিয়ে রামায়ণ, মহাভারত আমার কাছে এসেছে। কতশত বছর পারি দিয়ে কালিদাসও ঠিক এসে পৌঁছে গেছে আমাদের ঘরে।

কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে আমি আরো পাই ক্যাথারসিস পদ্ধতির মাধ্যমে হিলিং হওয়ার এক প্রকারের সুযোগ। শুধু কবিতাই নয়, গল্প, উপন্যাস, সিনেমা বা সামগ্রিক শিল্পের জগতই হচ্ছে মানুষের হিলিং প্রসেস এর অংশ; মানুষের এক্সটেনশান।

কবিতা বা শিল্পকর্ম করার মধ্য দিয়ে এর স্রষ্টা যেমন তার সমাজ ও পৃথিবীর সাথে যুথবদ্ধ হয়, তেমনি যারা কবিতা বা শিল্পকর্মের অনুরাগী তারাও অনুচ্চারেই যুথবদ্ধ হয় পরস্পরের সাথে; শিল্পস্রষ্টার সাথে। এই যুথবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা— শিল্প স্রষ্টা, শিল্পানুরাগীরা আসলে নিজেদেরই একাকীত্ব ঘুচাই।

কবিতার বা শিল্পের বার্তা দিয়ে, তার দেয়া প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ভাষা দিয়ে, তার থেকে উৎসারিত প্রেম ও বিরহের বোধ নিয়ে— সামগ্রিক অর্থে মানুষ কেবলই একাকীত্ব ঘুচাতে চায়। একাকীত্ব ঘুচিয়ে মনের মধ্যে সাথী হয়ে থেকে মানুষকে সঙ্গ দেয়ার জন্যই কবিতা ও শিল্প। সেই একাকীত্ব ঘুচানোর জন্যই হয়তো লিখি; পড়ি; সিনেমা দেখি।

‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’— এই ‘কেউ কেউ’ বা ‘কারও কারও’ কবি হয়ে ওঠায় ঐশীপ্রাপ্তির কোনও ঘটনা থাকে কি? নাকি পুরো ব্যাপারটাই রেওয়াজ নির্ভর? আপনার কী মনে হয়?

অজ পাড়া গাঁয়ের যে বৃদ্ধ লোকটি সারা জীবন পদ্য রচনা করেছেন, যে লোকটি সারা জীবন ধরে কবি হতে চেয়েছেন, যিনি তাঁর লোকালয়ে— পাড়ায়, গ্রামে, এমনকি সাত গাঁয়ের লোকের কাছেও কবি হিসেবেই পরিচিত— সেই গেঁয়ো, বিদ্যালয়ের সীমানা না মাড়ানো আন্‌পড় লোকটি, যার ভাষা বড় গেঁয়ো; পুঁথি, মধুসূদন, আর রবীন্দ্রনাথের আমলের পুরনো শব্দে এই একুশ শতকে বসে যে নিজের কথা লেখে— তিনি কি শহুরে সম্পাদকের কাছে, শহুরে পাঠকের কাছে কবি বলে গণ্য হবেন?

তেমন মানুষকে আমি নগরেও আসতে দেখেছি। মাইক্রোফোনে কবিতাও পড়তে দেখেছি। কিন্তু তার প্রতি নাগরিক শ্রোতার মনোভাবটা ছিল এমন যে: এসেছে গ্রাম থেকে, লিখেছে কি ছাই-পাশ— আহা, পড়ুক না; শুনে দেখি, এটাও তো একটা বিনোদন বটে।

এই আচরণ তো আপনার সেই ‘কেউ কেউ’ কবি, আর ‘সকলেই কবি নয়’-এরই প্রতিধ্বনি। এই যে লোকটির মতই আরো অনেককে না-কবি, ঊণ-কবি, অ-কবি বলে অভিহিত করা, এ কি নয় জাত্যাভিমানের বহিঃপ্রকাশ?

আপনি অনুন্নত বা তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশের কালো চামড়ার, মুসলিম নামের লোক বলে আপনাকে যখন বিদেশের এয়ারপোর্টে আটকায়, তখন, আপনি সেটিকে বলবেন জাত্যাভিমান; আর যে কি-না তার সমস্তটা জীবন পাত করে দিল কেবলি কবিতা কবিতা করে, তাকে আপনি ‘সকলেই কবি নয়’ বলে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন— এটা বুঝি জাত্যাভিমান নয়?

একই সময়ে শত শত মানুষ কবিতার জন্য জীবন পাত করে। কিন্তু সকলেই হয়তো ধারণ করে না যুগের সুর, আর্তি; সবার লেখাই হয়তো হয়ে উঠে না সমান মনোগ্রাহী। সকলের মাঝখান থেকে কেউ কেউ অলক্ষ্যেই ঢুকে যায় আমাদের বুকের ভেতর; কেউ কেউ অলক্ষ্যেই হয়ে উঠে যুগের প্রতিনিধি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেই জাদুকরী, সফল মানুষটি— যে আমাদের হৃদয়ের ভাষা বোঝে, সে ছাড়া তার সময়ের আর সকলেই অকবি।

যে হৃদয় জয় করেছে, এটি তার কৃতীত্ব, তার অর্জন। এটি সমবেত ভাবে আমাদের সকলের প্রাপ্তিও বটে। কিন্তু তাই বলে, যে আমার কথা বোঝেনি, যে আমার কথা লেখেনি, যার কবিতার টেস্ট এর সাথে আমার টেস্ট একেবারেই মিললো না— তাকে কি আমি ‘কবিই নয়’ বলতে পারি?

একজন যাত্রার নায়ক, একজন শাকিব খান আর একজন ব্র্যাডপিট— এদের সুযোগ প্রাপ্তির হিসেবটা এক নয়। ব্র্যাডপিট এর নিরিখে শাকিব, শাকিবের নিরিখে যাত্রার নায়ক— তাদের একটা স্তরায়ন আপসেই হয়ে যায়। কিন্তু এই স্তরায়ন যতই সত্যি হোক, শাকিবেরও যে একটি বৃত্ত আছে, সেও যে কোথাও কেন্দ্র হয়ে আছে; যাত্রার নায়কটিও যে কোথাও হয়ে আছে কেন্দ্রভূমি— সেটি কি আমরা অস্বীকার করতে পারি?

যদি, জবরদস্তিমূলকভাবে, যদি রাজার ছেলের মতো জাত্যাভিমানের বড়াই দেখিয়ে, যদি সাদা চামড়ার গর্বের অধিকারে তুমি ‘কালো’ বলে, লম্বায় ‘খাটো’ বলে, তোমার ‘চোখ নীল নয়’ বলে— তোমাকে ঊণ-মানুষ, না-মানুষ, বুনো আফ্রিকান, নোংরা এশিয়ান হিসেবে ঘোষণা করা হয়, নিষ্পেশন করা হয়— আর এই ঘোষণার পর, অপমানে— আর কে নারায়ণের সেই গল্প কথকের মতো যদি তোমারও ভেতর শূন্য হয়ে যায়, যদি তোমার ভেতরে তুমি কেমন বোবা হয়ে যাও— তবে, সেটা কেমন হবে?

কবিতা কি রেওয়াজ নির্ভর? কবিতাকে ঐশী বাণী ভাবার কোনো কারণ আছে কি? আবার কবিতাকে তো ঠিক রেওয়াজও বলা যাচ্ছে না। কারণ শুধু রেওয়াজ দিয়ে তো আর বাখ্ বা বেটোফেন বা রবীন্দ্রনাথ হয় না। তবে হ্যাঁ, কবিতা হাতের কাজই তো বটে। কিন্তু এই কাজ শুধু রেওয়াজ নয়। এর সাথে ব্যক্তির ‘চেতন’ ও ‘অচেতন’ একে অন্যের মাঝে জারিত হয়ে যায়। এমনকি কখনো কখনো অচেতন হয়ে ওঠে চেতনের চেয়েও প্রখর শক্তিধর। ফলে, চেতন কিছু বুঝে ওঠার আগেই— অনেক সময় শক্তিমান অচেতন কবিকে দিয়ে কতো কথা বলিয়ে নিতে পারে। এই করিয়ে নেয়াটাকে ঐশী বাণী ভাবার কোনো যুক্তি আছে কি?

জুতো সেলাই ও সূঁচকর্ম যেমন হাতের কাজ তেমনি কবিতাও— চর্চা, হাতের কাজ। ছুরিটাকে যত বেশি ঘষা হয় চামড়ার গায়ে, ততই সে হয়ে উঠে তীব্র, তীক্ষ ধার। ভাষাকে যখনই যেভাবে চাওয়া হবে তক্ষুণই তা হবে হাজির।

কবিও জাদুকর। ক্রমাগত নিজের আরাধ্য বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে আমূল জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নিয়ে একাকার হয়ে যায়। তারপর একটা সময় যেন মনে হয়, জাদুই সত্যি; কথার মায়াজালই সত্যি; এতে বুঝি কোনো কারিগরি নাই।

এখনকার কবিদের ছন্দবিমুখতার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার? কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা কতোটুকু? কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত বিস্তারে ছন্দ আপনার কাছে সহায়ক নাকি প্রতিবন্ধক?

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলো উপন্যাসে ভূমিসূতা নামে একটি মেয়ের চরিত্র আছে। মেয়েটি ভাগ্য বিড়ম্বিত। সে মেয়ের জীবনের গল্প অনেক বড়। কিন্তু তার চরিত্রের ছোট্ট একটি বৈশিষ্ট্য ছিল— সে নাচ ভালোবাসতো। একা ঘরে ঠাকুরের সামনে, নিজে নিজে অকারণেই একাকী নাচতো সে। যারাই দু’একবার তার নাচ কোনোভাবে দেখেছে, বুকের ভেতর থেকে খুব তারিফ করে তারা সকলেই যেন বলতে চেয়েছে— আহা কী সুন্দর। কী তার নিবেদন।

ভূমিসূতা কোথাও প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে নাচ শেখেনি। কিন্তু নাচ তার অঙ্গে অঙ্গে ছিল; ছিল তার নিজের মধ্যে গোপন। এই নাচ এসেছে তার গহীন থেকে। যাকে বলা যায়, ‘কাম ফ্রম উথইন’।

মানুষ যখন হাঁটে, শিশু হয়ে সে যখন হাঁটতে শেখে— তখন সে ছন্দ শিখে হাঁটা ধরে না। হাঁটার এই স্বাচ্ছন্দ্য আসে নিজে নিজেই। ছন্দ না জেনেই হাঁটতে শেখা সে মানুষের হাঁটা হয়ে উঠে নিপুণ ছন্দময়। এটি তবে কী করে হয়? আমার মতে, ‘ইট কামস ফ্রম উইথ ইন’। এটা ভেতর থেকে আসে; অটো; আরোপিত নয়। হতে পারে, চর্চায় তা হয়ে উঠে আরো বর্ণময়, আরো মনোগ্রাহী।

একজন কম্পোজার যখন মিউজিক তৈরি করে, সে নিশ্চয়ই গ্রামার মেনেই কাজটা করে। কিন্তু শ্রোতা— যে কি-না সুরটা শোনে, সে গ্রামার ধরার জন্য কান-খাড়া করে বসে থাকে না। সে সুরটাই শোনে। কানের মধ্য দিয়ে সুর মরমে পৌঁছে গেলো কি-না সেটাই তার কাছে প্রধান।

‘ওম’ শব্দের তরঙ্গের ভেতর নিজেকে খুঁজে পেয়েছে মানুষ। আমাদের যা যা চাই তার সকলই পেয়েছি এই আওয়াজের ভেতর। তাই, এই মরমে পশে যাবার ব্যাপারটাকেই আমি গুরুত্ব দেই সব থেকে বেশি।

আমি দেখতে চাই, কবিতাটা আছে কি-না? মানুষের জীবন, জীবনের গল্পটা আছে কি-না? এখন আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করেন যে, তাহলে কবিতা কী? সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য দেয়া কঠিন। শুধু বলতে পারি— কবিতা হচ্ছে ‘ওম’ ধ্বনি, যে মরমে পশে যায়। মরমে পশে যাবার জন্য ছন্দ আছে না নাই, তা মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে ভেতরের দোলা।

এই ক্ষেত্রে একটা ছোট্ট ঘটনা মনে পড়লো। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। গণরুমে থাকি; এক রুমে আঠরো জন। আমার লাগোয়া বিছানাতেই ছিল সাচি নামের একজন। সে ময়মনসিংহের মেয়ে। স্কুল কলেজ পাশ করেছে ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজ থেকে। তো, একদিন সে যখন জানতে পায় যে আমি কবিতা লিখি, তখন সে তার কলেজ জীবনের একটা ঘটনা বলে। ওদের কলেজে একবার দেয়াল পত্রিকা বের হবে। তো ঠিক হলো কে কী লেখা দেবে। লেখা দিতে গিয়ে সাচির এক বান্ধুবির দশা খুব খারাপ। সে কিছুতেই কবিতা লিখতে পারছে না। তাই, অবশেষে ঠিক করলো, ছন্দ মিলিয়ে কিছু একটা লিখে দিলেই হবে, কবিতা হয়ে যাবে।

ছন্দ মিলিয়ে সাচির সেই বান্ধুবি যা লিখেছিল তার পুরোটা আমার মনে নেই। শুধু দুইটা লাইন মনে আছে: “আমার বিড়ালের নাম পুষি/ খায় খালি ভুষি”

আমরা সাচিকে বললাম, কিন্তু বিড়াল কি ভুষি খায়? উত্তর এলো: আরে খায় না তো। কিন্তু কী করবো, মিলাইতে পারতেছিলো না, তাই জোরপূর্বক খাওয়াইতে হইলো!

আমি বলছি না, ছন্দ মানেই সাচির বান্ধুবির মতো শব্দের সঙ্গে শব্দের প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক মিল। আল মাহমুদ-এর সোনালী কাবিন পড়তে পড়তে ভেতরে কোথায় যে একটা ঝরনা ধারা বইতে থাকে তাতে তো ছন্দেরও মহিমা আছে। অতএব দুই-ই সত্যি।

ছন্দ বিষয়ে কবি টোকন ঠাকুরের একটা কথা আমার বেশ পছন্দ। তিনি একদিন আলাপের সময় বলছিলেন, তিনি ছন্দ জানেন না। আর জানেন না বলে লোকে তাকে নিন্দা-বদনামও করেছে এবং করে। তাই, এককালে বাধ্য হয়ে ছন্দ শিখতে বসলেন; কিছুদূর শিখলেন এবং সেই মোতাবেক লেখার চেষ্টাও করলেন। তারপর একটা সময় তার মনে হলো: আরে ধুর! এটা কী! ‘আমি তো কবিতা লিখছি। আমার কবিতায় ছন্দ আছে না নাই, সেইটা তো মূল বিষয় না। মূল বিষয় হলো কবিতাটা মানুষের ভালো লাগলো কি লাগলো না।’

আমিও তাই বলি। কবিতাই মুখ্য, ছন্দ নয়। কবিতা লেখা কোনো পরীক্ষা কর্ম নয় যে— ছন্দ শিখল না বলে সে পরীক্ষায় ফেল। ছন্দ দিয়ে হোক, না দিয়ে হোক, কথা যদি মরমে পৌঁছে যায়, পাঠকের যদি মনে হয়— এ তো আমারই কথা, তো সেটাই বড়।

যে কবিতায় টেকনিকটাই সকলের আগে চোখে পড়ে, ব্যক্তিগতভাবে সেই জিনিস আমার পছন্দ হয় না। এই ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে, ধরেন— একজন তরুণী বেশ করে সেজেছে। কিন্তু তার সাজের মধ্যে আর সব ছাপিয়ে কেবলি ঠোঁটের লাল লিপস্টিকটা এমনই অতি উজ্জ্বল হয়েছে যে— মেয়েটি ম্লান হয়ে গেলো তার ঠোঁটের লালের কাছে; বা অন্য অর্থে ঠোঁটের অতি লালটা মেয়েটিকে সুশ্রী করার চেয়ে বরং তাকে এক ধরণের ইম্ব্যাল্যান্সড করে তুলেছে।

কবিতাও তাই, কবি অনেক সময় নিয়ে, অনেক কিছু দিয়ে-টিয়ে কবিতাকে সাজায়। কিন্তু সেই কবিতা দেখলেই যখন কোনো একটি বিশেষ বিষয়— ছন্দ, শব্দ, মিল-অমিলের চেষ্টা ইত্যাদি কোনো একটি বিশেষ কিছু অতি প্রকট হয়ে লাগে, তখন সেটি যতই ছন্দময় হোক আমার তা ভালো লাগে না।

বরং ওই যে বললাম— কবিও জাদুকর। জাদুকর নিপুণভাবে লুকিয়ে ফেলে তার সমস্ত কৌশল। জাদু দেখতে দেখতে মানুষ ভাবে— আহা! কী সত্য, এতে বুঝি কোনো টেকনিক নাই। কবিতাও তাই। কবিতার গায়ে রাখা ছন্দ অছন্দের যাবতীয় কৌশল থাকবে এমনি অলক্ষ্যে যে মনে হবে— আহা কী সত্য, কী স্বতঃস্ফূর্ত; এতে যেন কোনো টেকনিক নাই। কবিতাকে এই ক্ষেত্রে সিনেমার সাথে খুব বেশিভাবে তুলনা করা যেতে পারে।

একটি সিনেমা নিমার্ণের পুরো কাজটাই কলাকৌশল নির্ভর। নিপুণ পরিকল্পনা করে পরিচালক সিনেমায় বেড সিন, মারামারি, হাস্যরস, রহস্য ইত্যাদি রাখছে; দৃশ্য ধারণের ক্ষেত্রে ক্যামেরা ব্যাবহারের সময় নানান সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে; ছবি সম্পাদনা করার সময় যোগ করছে আরো সব নতুন নতুন কারিগরি বিদ্যা; দর্শকের আবেগকে উস্কে দেবার জন্য মিউজিক দিয়ে যোগ করছে আবহ। কিন্তু সব মিলিয়ে সিনেমাটা সম্পন্ন হবার পর মানুষ যখন সিনেমাটা দেখে, তখন আর কেবল মিউজিক বা ক্যামেরার কাজ বা ডায়লগ বা অভিনয় বা এডিটিং টেকনিক দেখে না। মানুষ দেখে একটা গল্প। আরেকজনের জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। তো, সেই ঘটনাকে সকল টেকনিকের সমন্বয়ে— সকল কলাকৌশলকে নিপুণভাবে আড়াল করে যখন গল্পটা বলা হয়; সকল টেকনিক থাকা সত্ত্বেও কোনো টেকনিক প্রধান না হয়ে সামগ্রিক গল্পটা যখন হৃদয় ছুঁয়ে যায়— তখনই তা দর্শকের কাছে হয়ে উঠে একটি অনন্য সিনেমা। কবিতাও তো তাই। সকল কলাকৌশল বুকে ধারণ করলেও গায়ে তার টেকনিকের কোনো আড়ম্বর নাই। অর্থাৎ কবিতা হচ্ছে সেই মেয়েটির সাজ— যে সেজেছে কিন্ত তাকে ছাড়িয়ে তার সাজ কিছুতেই প্রধান হয়ে ওঠেনি; গহনার আড়ম্বরের আড়ালে ঢাকা পড়েনি সেই মেয়ে, বরং সাজ তাকে আরো করেছে মনোগ্রাহী, আরো মোহনীয়।

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? দাঁড়ালো ভাইসি-ভারসা। একটা মনোহর কবিতায় সকল গুণ আপনিই যোগ হয়ে থাকে। আর উল্টো করে বললে, সকল গুণ যোগ হলেই একটি কবিতা হৃদয়ে পশে। আর আমি তো মনে করি, কবিতা নির্মাণে মগজের ব্যবহার যতই হোক না কেন— কবিতা মূলত হৃদয়েরই ধন; হৃদয়ই তার ধারক-বাহক।

তাই, আপনি যে সিদ্ধান্তমূলক প্রশ্ন করলেন এই বলে যে— ‘এখনকার কবিদের ছন্দবিমুখতার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?’ সেই প্রশ্নের উত্তর তো আমি দিতে পারছি না। কারণ আমি তো মনে করি না এখনকার কবিরা ছন্দ বিমুখ।

আমি তো দেখি ছন্দ আছে। আমি বলছি না অধিকাংশ কবিতা, বেশির ভাগ কবিতায় ছন্দ আছে; কিন্তু দেখছি যে, ছন্দ আছে। কারণ কবিতা তো হৃদয়ে দাগ কাটছে। সেই দাগ কাটা কবিতার সংখ্যা যত কমই হোক— তাই বলে হচ্ছে যে না, এ কথা তো বলা যাবে না।

আপন মাহমুদ যখন তার কবিতায় বলতে শুরু করে ‘জানি না একটাও প্রজাপতি কখনো মায়ের খোঁপায় বসেছিল কি-না’, তারপর যখন সে গল্পটা ফেঁদে এনে আমাদের বুকের মধ্যে একটা ব্যথা ছড়িয়ে দেয় সেখানে তো আমি দেখি কী নিপুণ ছন্দ!

যখন ‘জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যে নয়’ বলে জুয়েল মোস্তাফিজ রচনা করে ব্যথার গাঁথা, আমি তো সেখানে অনেক কবিতাতেই— গল্পের শুরু থেকে শেষ অব্দি দেখি প্রবল ছন্দের টান। ফেরদৌস মাহমুদ তার ‘সাতশ ট্রেন এক যাত্রী’তে কিছু কিছু কবিতায় তো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়ে এগিয়েছে কবিতার শেষ লাইন অব্দি। কয়েক দিন আগে সোহেল হাসান গালিবের কিছু কবিতা পড়লাম কোনো একটা অনলাইন পত্রিকায়। কবিতাগুলো তো খুব ভালোলাগায় দুলিয়েছে। যখন সঞ্জীব পুরোহিত তার ‘আমার বই প্রথম ভাগ’ কবিতার বইয়ে বলে: “আমাকে এক চিমটি নাও তোমার আঙুলে, ...নিয়ে মাখো— ভালোবাসার পাতে”, তার সেই নিবেদনের ভাষায় তো মুগ্ধ হয়ে যাই। যখন মৃদুল মাহবুব তার কবিতা দিয়ে কোন কোন জগত তুলে ধরে চোখের সামনে, সেখানে তো দেখি না ছন্দের কোনো কমতি। যখন শুভাশিস সিনহা “এই গৃহে তোমারও হবে না বাস” বলে একটা গল্প তৈরি করে, যখন গল্পের শেষটা জানার জন্য আমি ছত্রে ছত্রে এগিয়ে যাই— কই, সেখানে তো দেখি না ছন্দের অভাব। মাদল হাসান যখন তার এপিটাফ কবিতায় আমাদের জড়িয়ে নেয় তখন তো বোধ হয় না যে এখানে কোথাও ছন্দের অভাব আছে।

এখন আমার মনে হচ্ছে, ছন্দ বলতে আমি যা বুঝিয়েছি আর আপনি যা বোঝাচ্ছেন তার মাঝে বোধ হয় বিস্তর ফারাক থেকে যাচ্ছে। কেননা আমি তো কবিতা পড়তে গিয়ে অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, পয়ার, সনেট— ইত্যাদি খুঁজিনি। কিন্তু আপনি তো ‘ছন্দ’ বলতে এই সব ছাঁচগুলোকেই বোঝাচ্ছেন। তাই, আপনার ছন্দ আর আমার ছন্দে মিলছে না।

হ্যাঁ, ছাঁচ দেয়া কবিতা এখন কিছু কমই হচ্ছে বটে। আমি ভাবি, এই যে প্রচল ছন্দের প্রতি আগ্রহ কম বা কমছে এর পেছনের কারণ কী?

সময়টা তো পাল্টাচ্ছে। সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মানুষের জীবন যাত্রা, জীবনাচার— সব কিছুতেই হুড়মুড় করে ঢুকে গেছে ধুন্দুমার পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তন কেবল সৃষ্টিশীল, ভাবুক বা বুদ্ধিজীবীর জীবনে নয়— আপামর জনতার সামগ্রিক জীবনেই এসেছে।

সেই পরিবর্তিত ‘কেওটিক’ জীবনই তো কবিতার উপাদান। তাই, কবিতায়ও ছাঁচ বিযুক্তির লক্ষণ প্রবল হচ্ছে। ছাঁচ না থাকাকেই যারা বলে ‘কেওয়স’ তাদের অবশ্য আরেকবার স্মরণ করা উচিত যে, ‘কেওয়স’ এর মধ্যেও রয়েছে অদ্ভুত এক ‘ইউনিটি’; কেওয়েসকে কেবল সুতোয় গেঁথে দিতে হয়। ঠিক মতো গেঁথে দিলে কেওয়স-ও গীতল হয়ে যায়।

গেঁথে দেয়ার নৈপুণ্যই হলো ছন্দ। এই ছন্দের জন্য ছাঁচ জরুরি নয়। ছাঁছ দিয়ে হোক, না দিয়ে হোক— আপনি যদি অপূর্ব মাদকতায় ভরা কবিতার বিষপাত্র তুলে দিতে পারেন মানুষের হাতে, সেই বিষই ভালোবেসে অমৃত সুধা বলে তারা পান করে নেবে।

দশকওয়ারী কবিতা মূল্যায়নের প্রবণতাটিকে কিভাবে দেখেন? আপনার দশকের অন্যান্য কবিদের কবিতা থেকে নিজের কবিতাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার উপাদানসমূহ কী বলে মনে হয় আপনার?

পাথর যুগ, তাম্র যুগ, লৌহ যুগ যেমন ইতিহাসের একেকটি বিরাট সময়কে নির্দেশ করে, তেমনি দশক বিভাজন হলো নিজেদের পরিচয়ের সুবিধার্তে এক প্রকারের সীমানা নির্ধারণ।

দশটি বছর একটি মানব জীবনে তো কম সময় নয়। তো, সেই ক্ষেত্রে দশকওয়ারী কবি পরিচয় ব্যক্তিকে কিছু সুবিধা দেয় বৈকি।

ম্যাক্রো থেকে মাইক্রো লেভেলে যেতে পারেন আপনি। ক্যামেরার ল্যান্স জুম ইন করে যেতে পারেন আরো আরো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিটেইলে। এক সহস্র বছরের কবিতা, এক শত বছরের কবিতা, এক দশকের কবিতা যেমন খুঁজে নেয়া যেতে পারে, তেমনি সময় নিরিখে খুঁজে নেয়া যেতে পারে সেই সময়ের কবিকেও।

তবে, একটি ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস তো আর দশ বছরের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার বয়স বেড়ে পঞ্চাশ, একশ, হাজার হয়। তো, সেই শত শত বা হাজার বছরের ইতিহাসে তো আর দশকের হিসেব করে লাভ নেই। ছন্দ-অছন্দের হিসেব কষে লাভ নেই। কেননা হয়তো কোনো কারণে নিজের দশকে যে কবি ছিলেন উজ্জ্বল সেই আবার হয়ে যায় শতকের অতলে হারিয়ে যাওয়া নাম।

আমার কবিতাকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার উপাদান... নিবিষ্ট পাঠকেরা নিশ্চয়ই টের পান কার কবিতা কোথায় আলাদা। অন্য দশজনের আরো দশটা কবিতার সাথে, আমার নাম ছাড়া কবিতাটা পড়তে গিয়ে কেউ যখন বোধ করেন, কবিতাটায় আমি আমি গন্ধ আছে, সেই গন্ধটাই কি নয় আমার পরিচায়ক?

এখন আমার কবিতার কী এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যা বাকি পঞ্চাশ জন থেকে বিশেষভাবে আমার কবিতাগুলোকে আলাদা করেছে, সেটা তো আমার পক্ষে বলাটা একটু মুশকিলই বটে। বরং যাদের কাছে আমার কবিতা ভালো লাগে এবং যারা আমার কবিতা নিয়ে আগ্রহী, যদি তাদের ইচ্ছে হয় তো তারাই হয়তো খুঁজে বের করবে কবিতার আলাদা সূচক চিহ্নাবলী।


তিরিশের দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত— প্রত্যেকটি দশক থেকে যদি তিনজনের নাম করতে বলা হয় আপনাকে— কারা আসবেন? উল্লিখিত কালখণ্ডে কোন দশকটিকে আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?


কেবলি তিরিশের দশক থেকে কেন যে নাম বলতে বললেন, সেটা একটু কেমন ঝাপসা মতন লাগলো। আবার প্রত্যেক দশক থেকে তিন জন কবির নাম বলতে বলায় আরেকটা প্রশ্নও জেগে উঠলো মনে। বাংলা কবিতার জগত থেকে তিনজন, নাকি বাংলাদেশের কবিতা জগত থেকে তিনজন কবির নাম বলতে বলেছেন— এটি ভেবে আমি একটু দ্বিধান্বিত হলাম। কারণ পঞ্চাশের দশকের আগে পর্যন্ত বাংলা কবিতা ছিল পূর্ব-পশ্চিম নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের কবিতা। কিন্তু ভারত পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দশকওয়ারী বিবেচনা করতে গেলে তো রাজনৈতিক ভূখণ্ডের বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না।

দশক ওয়ারীই নামগুলো মনে করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আশঙ্কা আছে দুই-চারটা হয়তো এদিক-সেদিক হয়ে যেতে পারে। আবার কোনো কোনো দশকে হয়তো দেখা গেলো তিনজনের জায়গায় আমি পাঁচজনের নামও বলে ফেলতে পারি। কারণ হয়তো পাঁচজনের কবিতার প্রতিই আমার এক ধরণের আকর্ষণ আছে।
তিরিশ দশক: জীবননান্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
চল্লিশের দশক: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্ট্রাচার্য, আবুল হোসেন।
পঞ্চাশের দশক: শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ।
ষাটের দশক: রফিক আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, সিকদার আমিনুল হক।
সত্তর দশক: রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবিদ আজাদ
আশির দশক: আলতাফ হোসেন, মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ।
নব্বই দশক: টোকন ঠাকুর, চঞ্চল আশরাফ, সরকার আমিন।

আর একবিংশ শতকের প্রথম দশকের অনেক কবির নাম তো ইতোমধ্যে আগেই উল্লেখ করেছি। সেই নামগুলো থেকে কাউকে বিয়োগ না করেই আমি বরং আরো দুই একটা নাম জুড়ে দিতে চাই।

এই দশকগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে তিরিশের দশক তো বিভিন্ন কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। রবীন্দ্রঘোর থেকে বেরিয়ে আসাটাই তো এক বিরাট সংগ্রাম তখন। সহিত্যের পঞ্চপাণ্ডবেরা তো সে সংগ্রামে লড়েছেন।

আর তিরিশের পর দশকের হিসেবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার একটা ভালোলাগা আছে পঞ্চাশ দশকের প্রতি। কারণ এই একটি দশকেই রয়েছে একগুচ্ছ কবি— যাঁরা প্রায় সকলেই আমাকে তুমুল আন্দোলিত করে।

দেশভাগোত্তর দুই বাংলার কবিতায় মৌলিক কোনও পার্থক্য রচিত হয়েছে কি? এ-বাংলায় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন। ওপার বাংলায়ও নকশালবাড়ি আন্দোলনসহ উল্লেখযোগ্য কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন— এসমস্ত কিছুর আলাদা আলাদা প্রভাব কবিতায় কতোটা পড়েছে বলে মনে করেন?

মৌলিক পরিবর্তন মানে কী? কবিতার আধেয় বা বিষয়বস্তু বা সেই বিষয়বস্তুকে বয়ানের ক্ষেত্রের পরিবর্তন তো? মানুষের জীবন যখন পাল্টে যায়, জীবনের আচার ও লড়াইয়ের ধারা যখন পাল্টে যায় তখন তার শিল্পের আধেয়ও তো পাল্টায়; পাল্টাবে; না পাল্টে উপায় নেই।

বলশেভিক বিপ্লবের আগের রাশিয়া আর পরের রাশিয়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার আগের জার্মানী আর পরের জার্মানী তো এক নয়। তাহলে কী করে এক বা অভিন্ন বা অপরিবর্তিত থাকবে তাদের জীবনের প্রকাশ?

বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ; সশস্ত্র যুদ্ধ জয় করে আসা একটা দেশ। এই দেশের মানুষের মানসিক গড়ন, তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশায় একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনের ছাপ কবিতায়, সাহিত্যে, শিল্পে এসেছে, আসছে, আসবে সেটা খুবই স্বাভাবিক।

আর সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের যে কী তীব্র প্রভাব তা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। আজ অব্দি সেই আন্দোলন কবিতায় আসছে এবং ভাষা অন্দোলন, শহীদ মিনার তো ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে আমাদের জাতীয় জীবনের মিথ-এ।

তার আগে যে দেশভাগ হয়েছে, সেটি নিয়ে তো সিনেমা ও সাহিত্যও কম হয়নি। কবিতায়ও তো এসেছে দেশ বিভাগের বেদনার ছাপ। “তোমরা যারা বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো” তো মুখে মুখে আজও প্রচলিত। দেশ বিভাগের কথা তো এখনও কবিতায় আসে। দেশ বিভাগ নিয়ে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারেরও একটা চমৎকার কবিতা আছে।

নকশাল আন্দোলনের যে ঘাত তা তো পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায়, সাহিত্যে ভীষণভাবে উঠে এসেছে। হয়তো সামনেও আরো আসবে।

সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার ঘাতের গল্প তো পৃথিবী জুড়ে চিরকালই সাহিত্যে ও শিল্পের অন্যান্য শাখায় বিভিন্ন আঙ্গিকে উঠে এসেছে। এই আসাটা অনিবার্য। কারণ মানুষ যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায় তা তাকে আবিষ্ট করে, আক্রান্ত করে; এমনকি বেদনাদায়ক, করুন বা বিরক্তিকর স্মৃতি হলেও সেটিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলুন। কবির কি পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিৎ? বর্তমানে বাংলা কবিতার পাঠক কারা?

বাংলাদেশে এখন একটা বেশ উল্লেখযোগ্য ইংরেজি সমাজ রয়েছে। এই সমাজ ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়া; যাদের অনেকেই বাংলা ঠিক মতো বোঝে না। তাই, দুই চারটা ব্যতিক্রম ছাড়া তারা বাংলা কবিতার পাঠক নয়।

বলা হয়, মূলধারার ঢাকাই সিনেমার দর্শক হচ্ছে রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টসকর্মী আর নিম্নবর্গের মানুষ। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি— তারা সিনেমার দর্শক হলেও, দুই চারটা ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের কেউ বাংলা কবিতার পাঠক নয়।

তাহলে বাংলা কবিতার পাঠক কারা? উচ্চবিত্ত? না-কি মধ্যবিত্ত?

অভিজ্ঞতায় যতখানি বুঝতে পারি, দুই চারটা ব্যতিক্রম ছাড়া উচ্চবিত্তের সমাজে কবিতার চল কম। অভিজ্ঞতা বলছে, মধ্যবিত্তই গড়পড়তায় বাংলা কবিতার পাঠক। কিন্তু বাংলা কবিতা বলতে আপনি যদি “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে একেবারে হালের টোকন ঠাকুর” পর্যন্ত বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে কিন্তু আবার একটু ঘাপলা তৈরি হবে। কারণ, শহরের, মফস্বলের মধ্যবিত্ত সমাজে, আলমারিতে যে সব কবির কবিতার বই সংরক্ষণ করা আছে তারা প্রায় সকলেই মৃত বা নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমান ও আলমাহমুদ এর মতো বিখ্যাত নাম।

তাহলে, সাম্প্রতিক সময়ের বাংলা কবিতার পাঠকি কি নেই? হ্যাঁ, আছে। এই যে পত্রিকা মারফত ঘরে ঘরে যে সকল কবিতা যায় শহর, নগর ও মফস্বলের লোকেরাও তা পড়ে; প্রায় নিয়মিত পড়া কবিদের দু’একজনের নামও মনে থাকে তাদের। বই মেলায় কিছু বই বিক্রি হয়। তবে, মূলত সাম্প্রতিক সময়ের কবিতার মূল পাঠক হলো যারা কবিতা লেখে বা এক কালে লিখতো বা ভবিষ্যতে লেখতে চায় বা লিটল ম্যাগাজিন করে বা অন্য কোনোভাবে শিল্প, সাহিত্য জগতের সাথে জড়িত— মূলত তারাই।

যে কোনো কারণেই হোক, এখানে যেহেতু কবিতা পাঠের একটি উল্লেখযোগ্য পাঠকসংখ্যাই নেই, সেখানে আপনি যদি কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ আনেন, সেটা কি যৌক্তিক হয়? এখানে কবিতা তো বিচ্ছিন্ন হয়ে নাই; জনতাই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।

আর সবচেয়ে বড় কথা কবিতা খুব জনসম্পৃক্তই ছিল বা কবে, কোন কালে? সংবাদপত্রের মতো ঘরে ঘরে কবিতা পঠিত হয়েছে কবে?

পাঠকেরও প্রয়োজন প্রস্তুতির...

গ্রাম দেশে দেখবেন পুকুরে কাঠ ভিজিয়ে রাখে। এই ভিজিয়ে রাখাটাকে বলে সিজনিং করা। মানুষের ক্ষেত্রেও এই রকম সিজনিং দরকার হয়।

ঢাকাই সিনেমার যে সব দর্শক কেবল রিয়াজ-শাবনূর, শাকিব খান-অপু বিশ্বাসের সিনেমা দেখে অভ্যস্ত যদি হঠাৎ তাকে শঙ্খনাদ বা কীর্ত্তণখোলা জাতীয় সিনেমার সামনে বসিয়ে দেয়া হয়, সে কি প্রাথমিকভাবে একটু বেদিশা বেদিশা ভাবে পড়বে না? কিংবা হলিউডি বাণিজ্যিক ছবির যে একনিষ্ঠ দর্শক হঠাৎ তাকে যদি বসিয়ে দেয়া হয় লুই বুনোয়েল বা ইঙ্গমার বার্গম্যান এর ছবির সামনে তাহলে সেই দর্শক কি ভাববে না: কী বানাইলো সিনেমা, কিচ্ছু তো বোঝা যায় না!

এখানে সিনেমার গ্রেড করা অর্থে ঢাকাই সিনেমা বা শঙ্খনাদ এর কথা আমি আনি নাই। আনলাম এই কারণে যে, ঢাকাই সিনেমায় গল্প বলার ধরণ আর শঙ্খনাদের ধরণ এক না; তাদের গল্প উপস্থাপনের ধরণও ভিন্ন ভিন্ন।

তো, যে দর্শক এই ভিন্নতা সম্পর্কে কিছুই জানে না তার কাছে তো মনে হতেই পারে যে, কিছু বোঝা গেলো না।

ওই সিনেমার মতই সাহিত্যের ব্যাপারটাও তো একই রকম। যে পাঠক এখনো শরৎ চন্দ্রতেই আছে তার হাতে একদিন হঠাৎ করেই আউটসাইডার বা অ্যালকেমিস্ট ধরিয়ে দিলে এর মাথামুণ্ডু বোঝা তো তার জন্যে একটু দুরূহ ব্যাপারই ঠেকবে, বটে।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত ছাড়া যে পাঠক আর কারো কবিতাই পড়ে নাই, আপনি যদি হঠাৎ তার হাতে সিকদার আমিনুল হক বা বিনয় মজুমদারের কবিতার বই ধরিয়ে দেন— তার কাছে কি প্রথমেই ভালো লাগবে সেই কবিতা? ওই পাঠক কি বলবে না যে, কী সব লিখলো— কিচ্ছু বোঝা যায় না?

দুর্বোদ্ধতার অভিযোগ...

আবার এই অভিযোগটা কিন্ত পুরোপুরি মিথ্যেও নয়। এই আমাদের সময়েরই বয়োজেষ্ঠ্য, সমবয়সী, কনিষ্ঠদের অনেকে আছেন— কখনো কখনো মনের মাধুরী মিশিয়ে একগুচ্ছ শব্দ একটার পর একটা জোড়া দিয়ে একটা কবিতা বানায়। কিন্তু লাইন বাই লাইন গেলে সেই শব্দাবলির সমাহারে না দাঁড়ায় কোনো একটা অর্থ পূর্ণ বাক্য; সামগ্রিক কবিতাটা না দেয় একটা কিছু বক্তব্য বা গল্প। কিন্তু তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়: ও ভাই, তুমি কী লিখেছো এইখানে? কী বলতে চেয়েছো তুমি? সে তখন ঝেড়ে দিবে বিরাট এক লেকচার। যার অর্থ দাঁড়াবে— হুম, আপনিই বোঝেন নাই।

তো, এই জাতীয় কোনো অর্থই না দেয়া কবিতাগুলো পড়ে মানুষ যদি বিরক্ত হয়, চারটা কবিতা কষ্টেসৃষ্টে পড়ার পর হাতের বইটা যদি বন্ধ করে দূরে রেখে দিয়ে ভাবে: ধুর, কী লিখছে! তাকে কি দোষ দেয়া যায়?

আর পাঠকের রুচির সাথে মিলিয়ে তো কবিতা লেখার কিছু নাই। কবিতা কি চলতি ফ্যাশনের পোশাক না-কি, যে এই ডিজাইনটা চলছে ভালো, তাই এটাকেই একটু ইম্প্রোভাইজ করে, এদিক সেদিক করে বাজারে ছেড়ে দেবে কবি?

জনে জনে মন জুগিয়ে চলা যায় না। সকলের মনের মত সাজতে গেলে কারো ইচ্ছেই কি পূর্ণ হয়? অতএব, পাঠকের রুচির সাথে মিলানোর কিছু নাই। কবি তো তার নিজের মতোই লিখবে। তার লেখা যদি মানুষের মনের সাথে মিলে যায়, তো মিললো। না মিললে তো জবরদস্তির কিছু নাই। যেখানে দুইটা মানুষের মনকেই ঠিক মতন মেলানো যায় না, সেখানে একজন মানুষের সাথে সমাজের অচেনা অগুন্তি মানুষের মনকে মিলিয়ে দেয়াটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!

।।
আফরোজা সোমা
জন্ম: ০২ অক্টোবর ১৯৮৪
জন্মস্থান: কিশোরগঞ্জ, বাংলাদেশ
পেশা: সাংবাদিকতা
প্রকাশিত বই: অন্ধঘড়ি (২০১০)
সম্পাদিত কাগজ: চন্দ্রদীপ, শূন্য (যৌথ সম্পাদনা)
।।

(অন্য বস্তু খুঁজতে গিয়ে এই লিংক পেলাম। তাই, কপি করে রেখে দিলাম এই ডিজিটাল ডাইরিতে।)

https://www.banglanews24.com/art-literature/news/bd/201467.details
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:১১
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×